fiture
শেখ ফরিদ, লেখক ও সমাজকর্মী, বাংলাদেশ:

ইরানে ফারসি ভাষায় কোরআন অনুবাদের  প্রায় আটশত বছর পর; শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভি  প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবীদ যখন ভারতবর্ষে ফারসি ভাাষায়  কোরআন অনুবাদ করেন। তৎকালিন সময়ে অনেক আলেম তাকে  কাফের ফতোয়া দেয়। কারন তিনি কোরআন অনুবাদ করে তিনি অনৈসলামিক  কাজ করেছেন! শাহ আব্দুল কাদীরকেও ১৮ শ শতকের শেষ দিকে উর্দুতে কোরআন অনুবাদ করার দায়ে(?) কাফের ফতোয়া দেয়া হয়। এ রকম একটি নীচ(?) ভাষায় (উর্দু) কোরআন অনুবাদ তার সময়ের আলেম, মুফতি, শায়খরা মেনে নিতে পারেননি।  শায়খুল হাদিসদের ফতোয়ার প্রভাবে তুরস্কে প্রায় দুশ বছর মূদ্রণ যন্ত্র নিষিদ্ধই ছিলো! যখন প্রতিবেশী ইউরোপে ছাপাখানা ও অনুবাদের ধূম পরেছিলো।  
এ উপমহাদেশ কে সবচেয়ে বেশি ফতোয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছিলো? এমন  প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে যার নাম পেলাম ; তিনি হলেন "স্যার" সৈয়দ আহমদ খান। যিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ  শিক্ষানূরাগী। ভারতবর্ষের মুসলিম সম্প্রদায়ের  শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নেয়ায় তার অবদান অনস্বীকার্য। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বৃটিশ সরকারের উচ্চপদের চাকরী ছেড়ে দেন। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে থাকে ভারতে। অথচ এই, "স্যার" সৈয়দ আহমদকেই ভারতের শীয়া, সুন্নী, দেওবন্দী, বেরেলভি সহ এমন কোন  মুসলিম উপসম্প্রদায় ছিলো না যারা তাকে কাফের ফতোয়া দেয়নি। ভারতবর্ষের সকল টাউন থেকে তাকে নাস্তিক, মুরতাদ, ইসলামের শত্রু বলে ফতোয়া দেয়। কেবল ভারতের আলেম উলামারা ফতোয়া দিয়েই খান্ত হয়নি। মক্কার ঈমামের কাছ থেকে ফতোয়া আনা হয় সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে। তাকে হত্যা করা ওয়াজিব ঘোষনা করা হয়! অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য স্যার সৈয়দ আহমদ একবার চাঁদা তুলতে বাইজদের নিকটও যান। তারা তাকে অপমান করতে প্রস্তাব দেয়, তিনি যদি বাইজীদের পোশাক পরে পায়ে ঘুংড়ু পরে নাচেন তবেই তারা চাঁদা দেবে। তিনি তাই করেন! এমন অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে তিনি আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। 

ভারতবর্ষে ইসলাম অবমাননার দায়ে অনেকেই অভিযুক্ত হয়েছেন। অনেককেই কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের "বাবা এ কওম" মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে যেমন "কায়েদে আজম " বলে।  তেমনি "কাফের এ আজম" ও  বলতো এক শ্রেনীর মৌলভী। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রস্টা "স্যার" "আল্লামা"  কবি ইকবালকেও কাফের ফতোয়া দেয়া হয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কারনে। কাজী নজরুল ইসলাম আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও কাফের মুরতাদ নাস্তিক বলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিলো। 
ডক্টর আহামদ শীরফকে কাফের মুরতাদ বলে ফতোয়া দেয়া তো হয়েছিলোই। তিনিই এক মাত্র লেখক যাকে জেলায় জেলায় গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতেও হতো! অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কাফের ফতোয়া দিয়ে দেশ,ছাড়া করা হয় কবি দাউদ হায়দারকে। একটি কবিতা লেখার জন্য।  এ ছাড়া তসলিমা নাসরিনকে উপন্যাস ও কলাম লেখার কারনে মুরতাদ, কাফের আখ্যা দেয়া হয়। তাকেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।  তবে প্রথম শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হন প্রথাবিরোধী লেখক, ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক  হুমায়ুন আজাদ। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোপানো হয়। তিনি সে সময় গুরুতর আহত হলেও, প্রাণে বেঁচে যান। তবে জার্মানিতে তার মৃত্যু আজো রহস্যজনক। এ ছাড়া বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ২৩ জন লেখক ব্লগারকে হত্যা করা হয়। কাফের, মুরতাদ, ইসলাম বিদ্বেষী ঘোষনা দিয়েই। 
বর্তমান সময়ে ভারত উপমহাদেশে বিতর্কিত জনপ্রিয় ইসলাম ধর্মপ্রচারক  জাকির নয়েককেও মক্কার একজম ঈমাম কাফের ফতোয়া দিয়েছেন বলে শোনা যায়। এবং ভারতবর্ষে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ থেকে জাকির নায়েককে  কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের একটি টিভি লাইভ শোতে জাকির নায়েকের পক্ষে কথা বলায় টিভি পর্দায় উপস্থাপককে উঠে যেতে দেখেছি। 
এবং সেই টিভি শোতে উপস্থিত আলেমেরা এক যোগে জাকির নায়েকের বিরোধীতা করে বক্তব্য দেয়।
মওলনা আকরাম খাঁর মত ব্যাক্তিকেও কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো। গোলাম মোস্তফা ও ইসমাইল হোসেন সিরজীর মত কট্টর ইসলামপন্থীও বাদ যাননি কাফের ফতোয়ার আক্রমন থেকে।
দেওবন্দীরা, বেরেলভিদের কাফের বলে, বেরেলভিরা কাফের বলে দেওবন্দীদের।  এরা দুইদল ওহাবীদের কাফের বলে। ওহাবীরা তাদের সকলকে কাফের বলে! আহলে হাদীসেকেও কাফের বলে। আহলে হাদীস সহ এরা সবাই আবার শীয়াদের কাফের বলে। শীয়া সহ সকলে আবার কাফের বলে আহামদীয়া মুসলিমদের। বিস্ময়কর বিষয় হলো মুসলিমদের প্রায় প্রত্যেক উপসম্প্রদায় পরস্পরকে কাফের সম্বোধন করে থাকে।
ইসলামের চার মাজহাব (স্কুল) কে কাফের মনে করে  যারা মাজহাব মানেন না। আবার যারা মাজহাব মানে তারা মাজাহাব না মানাদের কাফের মনে করে। নবী এখনো জীবীত নাকি মৃত এ নিয়ে মুসলিমরা দুদলে ভাগ হয়েও পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে থাকে। 

চার মাজহাবের চার  ঈমাম প্রত্যেককেই জুলুম, নির্যাতন, অপমান শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেউ জেলে মরেছেন। কাউকে পায়ে লোহার শেকল পরানো হতো। কাউকে জেলের পাশাপাশি নিয়মিত চাবুক দিয়ে পেটানো হতো প্রকাশ্যে। ঈমাম আবু হানিফা,,মালেক, শাফেয়ী, হাম্বল, ইসলামি পন্ডিত হলেও প্রত্যেককে ইসলামের নামেই শাস্তি দেয়া হয়েছে।
বাগদাদে আব্দুল কাদের জিলানী, আজমীরে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি, দিল্লীতে নিজামউদ্দীনের মত ইসলাম প্রচারকদের  বিরুদ্ধে "কাফের" ফতোয়া ছিলো শত শত! 
মওলনা মওদূদী ও তার দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দেওবন্দীরা  "কাফের" ফতোয়া দিয় রেখেছে। মওলনা মওদূদী ও তার দলে সমর্থকদের থেকে দুরে থাকতে বলা হয়েছে মুসলিমদের।  তাদের মতের ও  অনুসারিদের পেছন নামাজ পরতে নিষেধ করা হয়েছে। যদিও দেওবন্দীদের বিরুদ্ধে কাদিয়ানী মত অমুসলিম ও কাফের ঘোষনা করার পোষ্টারও পাকিস্তানে  ছাড়ানো হয়েছিলো এক সময়!  

অদ্ভুত বিষয় হলো, পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে, পরস্পরের সাথে চলা ফেরা উঠা,বসা, বিয়ে-শাদী এমন কি অসুস্থ হলে দেখতে যেতে  পর্যন্ত নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধ করা আছে তাদের যানাজায়  তথা মৃত্যুর পর শেষ ক্রিয়াকর্মতে উপস্থিত হতেও!

পাকিস্তানি আমলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার, পার্লামেন্টে বক্তব্য দেয়ার সময়, তার বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।  জবাবে, তিনি বলেন, আমি ইসলাম অবমাননা করিনি। যদি করে থাকি আল্লাহ আমাকে আখারাতে শাস্তি দেবেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই (২০১৪/১৫ সালে) উত্তর বঙ্গে মসজিদে নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মিদের তওবা পরানো হয়েছিলো! আওয়ামী লীগ করলে নাকি সে আর মুসলমান থাকে না,  কাফের, হিন্দু, ইহুদী হয়ে যায়! বিষয়টি পত্রিকায় এলে;  উচ্চ আদালত সে অঞ্চলের ডিসিকে তলব করেন। ডিসি কি জবাব দিয়েছেন, তা জানা যায়নি! 
আসলে এই কাফের ফতোয়া দেয়া না দেয়া নিয়ে রাজনীতি অর্থনীতি ধর্মব্যবসার খেলা চলে আসছে শত শত বছর ধরেই।

 আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দীকির হজ্ব নিয়ে মন্তব্য করায়, তার মন্ত্রীত্ব এমপিত্ব নেতৃত্ব সবই গেছে। অথচ কিছু দিন আগে কোন কোন দেশের ইসলামের শায়খরা মুসলিমদের সৌদী আরবে গিয়ে হজ্ব না করার  আহব্বান জানিয়েছেন। কেনা না ইয়েমেনে হামলা ও কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের জন্য সৌদী আরব দায়ী বলে তারা মনে করেন। মুসলিম মোঘল শাসকের একজনও হজ্ব করেনি কোন দিন!  ভারতের মুসলিম শাসকদের নিয়ে মুসলিমদের গর্বের সীমা নেই। অথচ ইতিহাস বলে; ভারতের কোন মুসলিম সম্রাট, সুলতান, বাদশা, নবাব একজনও হজ্বে বিশ্বাস করতেন না। অথচ ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজ্ব।  হয়তো তারা হজ্বে আস্থা রাখেননি। তবে, কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো একজনকে তিনি হলেন সম্রাট আকবর।

বরিশালে আরজ আলী মাতুব্বরের মায়ের জানাজা পরাতে অস্বীকার করে আলেমরা। কারন মৃত্যুর সময় তার মায়ের ছবি তোলা হয়েছিলো! এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আরজ আলী মাতুব্বর চারণ দার্শনিকে পরিণত হন। শয়তানের জবানবন্দী তার মৌলিক রচনার অন্যতম। আমি ছোট বেলায় হুজুরদের দেখেছি ছবি তোলা ভিডিও করা,পাপের কাজ বলে ফতোয়া দিতেন। ছি! ছি!  নাউজুবিল্লা, আস্তাগ ফেরুল্লাহ বলেতন ছবি তোলা ও ভিডিও করতে দেখে। একবার সাংবাদিকেরা হাফেজ্জি হুজুরের ছবি তুলতে গেলে পত্রিকায় মুখ ঢেকে ফেলেন! সেই ছবিই পত্রিকায় ছাপা হয়! অবশ্য এখন তার উত্তরসূরীরা ও এ দেশের হুজুরেরা নিজেরাই ছবি তোলে, ভিডিও করে নিজেদের প্রচার চালায়!
 সৌদী আরবে এই সে দিনও মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে দেয়া হতো না, ফতোয়া দিয়ে। ড্রাইভিং করতে দেয়া হতো না। এখন বিদেশে যেতেও আর পুরুষের অনুমতি লাগবে না। আর  সৌদী আরবে একটি কঠোর নিয়ম রয়েছে। নামাজের সময় দোকান বাধ্যতা মূলক বন্ধ রাখা। যা খুব দ্রুতই তুলে দেয়া হবে। বাংলাদেশের পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়নি। বরং এখবরটা চেপে যাওয়া হয়েছে।
ফতোয়া বড়ই বিচিত্র। ইলাসটিকের মত যখন যেটুকু যে ভাবে ইচ্ছা নিজের সুবিধা মত বাড়ানো কমানো যায়!  এ উপমহাদেশে মুসলিমরা সব যুগেই  ফতোয়ায় আটকে ছিলো এখনো আটকে আছে। যত শিক্ষিতই হোক না কেন আইন আদালত থেকে ফতোয়াকে মুসলিমরা বেশি ভয় পায়।আসলে  ভয় পাওয়ানো হয়, হয়ে থাকে। পাকিস্তানী শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো সে ভয় ভেঙ্গে একবার বলেছিলেন;  মৌলভীদের দিয়ে তিনি নিজের বুট পালিশ করাবেন!  মৌলভলভীরা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে জেনারেলদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিলো। তার কন্যা বেনজির ভুট্টো চোরের হাতকাটার মত  শরীরয়ার কঠোর, অমানবিক  আইন মানে না বলাতে, তাকেও কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো।  প্রকৃত পক্ষে কাফের ফতোয়ার এত ছড়াছড়ি কে যে কাফের কে যে কাফের নয় ; তা খুজে বের করতে গেলে কম্বলের পশম বাছার মত বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours