কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
"তুম ইতনা জো মুস্কুরা রহে হো
কেয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রহে হো!"
মনে পড়ে তো, জগজিত সিংয়ের সেই গজল?
"হাসি
দিয়েই ঢেকে ফেলতে চাইছো মনের যন্ত্রণা। আজ আবার যেন একটু বেশিই হাসছো।
কথায় কথায় হাসি। আচ্ছা, ব্যাপারটা কী? কিছুই বলবে না জানি। তবু! হাসিটা
থামাও প্লিজ। আর নিতে পারছি না। বরং একটু কাঁদো তুমি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে না,
হাউমাউ করে। চোখের জলে ভেসে যাক, বুকের ভেতর গুমরে ওঠা কষ্ট। দেখ, বেশ
হালকা লাগবে।"
"ওরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছো কেন? শূন্য দৃষ্টি। বুঝতে পারছো না কিছু? হাসছো তুমি আমাকে দেখে। আবার সেই হাসি।"
এবার ওই হাসি দেখে মেজাজ বিগড়ে যায়। কোন রকমে রাগ চেপে, বেরিয়ে যাই আমি।
কেন, রাগের কী হলো?
খুশি
হলেই হাসতে হবে, আর দুঃখে কান্না, এমন মাথার দিব্যি দিয়েছেটা কে শুনি?
হাসির এই রহস্য ফাঁস করতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন
গেলোটোলজিস্টরা। হাজারো গবেষণা, সমীক্ষা, তথ্য সংগ্রহ সবকিছুই সারা। তবু
কিছুতেই কিছু নয়। কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখা হাজির করতে পারেননি তাঁরা। বলতে
গেলে, তাঁরাও যেন উড়ে গেছেন ওই হাসির দমকেই। এখনও খুব একটা কিছু করে উঠতে
পারেননি। তবে হাসি আসলে শরীরের ডিফেন্স মেকানিজম। বলা যায় শরীরের বর্ম।
এমনটাই মত আমেরিকার জর্জিয়ার এমোরি ইউনিভার্সিটি সাইকোঅ্যানালিটিক
ইনস্টিটিউটের সাইকোঅ্যানালিস্ট জেন ইয়েটসের।
জীবকুলের
মধ্যে মানুষই সবেধন নীলমণি, যারা হাসে। আপনি বলবেন হায়নার হাসি। ওটা হাসি
না। সাঙ্কেতিক ডাক। কারণ মুখে ভাষা নেই। গ্রেট এপসরাও এমন কিছু আওয়াজ করে,
যা শুনলে হাসি মনে হয়।
তবে হাসির মতো হাসি হেসেছিল বটে একজনা। চার দশকের বেশি হয়ে গেলো। তবু সেই হাসি আজও অম্লান। বড্ড কানে বাজে।
"আরে ও শাম্ভা, কিনতে আদিম থে?"
"ফিরভি
লওট আয়ে। খালি হাত !" তারপরেই রামগড় পাহাড় উপত্যকা কাঁপানো সেই অট্টহাসি।
আতঙ্কের হাসিতে পরমানন্দ আসমুদ্রহিমাচল। ব্যাস, ওই এক হাসিতেই কামাল। এক
নবাগতের সেই হাসি এমন ঝড় তুলল, উড়ে গেলেন অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা
মালিনীর মতো সুপার- ডুপার স্টাররা। ওই এক হাসিতেই বেঁচে রইলেন 'শোলে'র
গব্বর সিংরূপী আমজাদ খান।
গব্বরের
সেই হাসি ছিলো নিষ্ঠুরতার। আবার তা গভীর আত্মবিশ্বাসেরও হতে পারে। গবেষকরা
এমনটাই বলছেন। আতঙ্ক, যন্ত্রণা, ঘেন্না, উপেক্ষা, অবহেলাতেও মানুষ হাসে।
যেমন ধরুন ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্নিযুদ্ধের সেনানী খুদিরাম। কবির রচনায়,
'হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি !' সেই হাসি ছিলো উপেক্ষা, অবহেলার। আবার অনেক সময়,
যে কথা হাজারো শব্দে প্রকাশ করা যায় না, একটুকরো হাসিতেই বলা হয়ে যায়
তারচেয়ে অনেক, অনেক বেশি।
গোড়াতেই যে ঘটনার কথা
বলছিলাম, সেটাও সেরকমই এক ঘটনা। সে এখন সবকিছুর উর্ধ্বে। হাসির জন্য ওর আর
কোনও কারণ লাগে না। কারণ, অকারণে হাসি। কোনও আলাদা অনুভূতির প্রকাশ না। ওর
মনের চাপা ক্ষোভ, উদ্বেগ, হতাশা বেরিয়ে আসে হাসির দমকে। কিন্তু সেই হাসির
ভাষা বোঝে কে? তখনই মেজাজ বিগড়োয়।
এই
রোগেই ভুগছেন অসংখ্যজন। উদ্বেগ, হতাশায় ভোগা এই রোগীর সংখ্যাটাও কিন্তু
ভয়াবহ। পৃথিবীতে ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীর সংখ্যায় ভারত এক নাম্বারে। দাবি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। সংস্থার হিসেবে প্রতি একশোজন ভারতীয়র মধ্যে, সাড়ে
ছজন ভয়ঙ্কর রকমের মানসিক রোগে ভুগছেন। আবার ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভের
এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, গড়পরতার হিসেবে প্রতি ছজন ভারতীয়র মধ্যে একজন কোন
না কোনও ভাবে, মারাত্মক রকমের হতাশায় ডুবে আছেন। সমীক্ষা চালানো হয়েছিলো
2015-16 সালে। হতাশায় ডুবে থাকা রোগীর মধ্যে সংখ্যায় বেশি কমবয়সীরাই।
পরিস্থিতি
এরকমও দাঁড়ায়, রোগী অনেক সময় ডিপ্রেশনে ভোগার কথা নিজেও বুঝে উঠতে পারেন
না। আবার উল্টোটাও হয়। কথায় কথায় হেসে ওঠেন। আমরা সেই হাসিটাই দেখি। আর
ভাবি দিব্য আছেন। আসলে ওই মানুষটি জ্ঞানপাপী। তিনি সব জানেন, সব বোঝেন। তবু
নিজের সঙ্গে কানামাছি খেলে চলেন অবিরত।
যাঁরা
স্মাইলিং ডিপ্রেশনে ভোগেন, এক অদ্ভুত স্পিরিট কাজ করে তাঁদের মধ্যে,
বিশেষজ্ঞদের মত। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁরা বেশ মানিয়ে চলেন। চাকরি-
বাকরিও করেন। এমনকি পাড়ার ক্লাবে তাসের আড্ডায়, বা মহিলা মহলেও বসেন।
ঘর-সংসারও করতে পারেন। কিন্তু তলে তলে চলেছে অন্য খেলা। একেবারে নিঃসঙ্গ এক
পুরুষ অথবা নারী তিনি। নিজেতেই সমাহিত। ক্রমে দূরে সরতে থাকেন পার্থিব
দুনিয়া থেকে। গভীর রাতেও একাকী জাগেন তিনি। 'আঁখি হতে ঘুম নিল হরি!'
বড়ো মারাত্মক এই রোগীরা। কখন কী করে বসেন, কেউ জানতেও পারেন না। আবার মনের কথা জানতে চাইলে, রেগে যান। চাই কী তেড়েও আসতে পারেন।
মানুষের
হাসি দেখে কপালে ভাঁজ গবেষকদের। ব্যাপারটা কী! এতো হাসির কারণটাই বা কী!
চললো গবেষণা। দেখা গেল, মানুষের ভেতরে উৎসাহের জোগান দিতেই হাসি। এই হাসি
এমন এক শারীরিক প্রক্রিয়া যা এনডোরফিন সিস্টেমকে সক্রিয় করে উৎসাহ স্রোত
তৈরি করে। পাশাপাশি শরীরকে তৈরি করে মানসিক, শারীরিক উদ্বেগের চোট মোকাবিলা
করতে।
উদ্বেগ, হতাশা,
সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার- এর রোগী বাড়ছে হু হু করে। ভারত এক
নাম্বারে থাকলেও, দ্বিতীয়, তৃতীয়তে আছে চীন আর আমেরিকা। তবে আমাদের দেশের
সমস্যা রোগী বাড়ছে, চিকিৎসক বাড়ছে না। সাইকোলজিস্ট, সাইক্রিয়াটিকের খরা দেশ
জুড়ে। 2014 সালের এক হিসেবে, এক লক্ষ মানুষের জন্য সবেধন নীলমণি মাত্র
একজন স্বাস্থ্যকর্মী। সাইক্রিয়াটিস্টের সংখ্যা হাজার পাঁচেক। আরও দৈন্যদশা
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের। এই সংখ্যাটা দেশে দু হাজারের বেশি নয় বলে 2014
সালের এক সমীক্ষায় জানিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তার
ওপর আছে মানসিক চিকিৎসার খরচ খরচার বহর। আর আমাদের দেশে তো মানসিক রোগী
মানেই পাগল, আছে এরকম এক ভ্রান্ত ধারনাও। যার খেসারত দিতে, মানসিক রোগের
কথা চেপে যায় রোগীর পরিবার।
হাসির
যেমন নানা কারণ আছে, তেমন আছে নানা রকমফেরও। অট্টহাসি, মুচকি হাসি, কাষ্ঠ
হাসি, ফিচলেমি হাসি। কেন? মানুষটা যেরকম হাসিটাও সেরকম। ব্যাক্তিত্বের
প্রকাশ। এমনটাই ধারনা।
হাসি মানে আশ্বাস। অঙ্গীকার।
"আমি তোমার ক্ষতি করবো না। তোমায় পছন্দ করি। ভালবাসি।" সভ্যতার বিকাশের
সঙ্গে অবশ্য হাসির মানে বদলে গেছে। বাজারে এসছে বাণিজ্যিক হাসি।
হাসো
প্রখর সূর্যের আলোয়। হেসে চলো চাঁদের আলোয়। বড্ড মোহময় বস তোমার ওই
হাসি। আর যদি কাঁদতেই হয়? কেঁদো, যখন বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর। আর ছিলেন এক
মহামানব, যে দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের বধ্যভূমি, পারমাণবিক শক্তিধর বিশ্বটাকে
শুধু হাসিয়েই গেলো। চার্লি চ্যাপলিন।
বলেছিলেন, "love to walk in the rain, because no one can see me cry!"
চোখের জল বৃষ্টির জল, সব মিলেমিশে একাকার।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours