স্বাতী রায়, লেখিকা ও চিত্রগ্রাহক, কলকাতা:
'এই
সিজনে প্রচুর লস হয়ে গেলো বুঝলে শ্যাম, অন্যবার এই সময়ে ট্যুরিস্টের মেলা
লেগে যায় পাহাড়ে, আর এই বছর...' খুবই আক্ষেপের সাথে বলছিলেন সুনীল দাজু।
আমারও একই অবস্থা, পুরো সময় জুড়ে এই সময়ে আমার একটা দিনও কোনো রুম খালি যায়
না, আর এ বছর!
অক্টোবরের
শেষের দিকে পাহাড়ে তখন অসময়ের বৃষ্টি নেমেছে, ট্যুরিস্টের চাপ না থাকায়
বেশ আলসেমি করেই দিন কাটছে। বিগত দিন দুয়েক ধরে যখন তখন বৃষ্টি পড়েই চলেছে,
হঠাৎ ঠাণ্ডা বেড়ে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে। এর মধ্যেই সুনীল দাজুর ডাকে
মহেশের বোলেরো নিয়ে আমায় যেতে হয়েছিলো রাভাংলায়। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ বেশ
পরিষ্কার। আমার বাড়ি থেকে নাথুলার রেঞ্জ, বরফে ঢাকা পাহাড় আর ঝকঝকে নীল
আকাশ দেখে বেশ খুশী হয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম, ইচ্ছে ছিলো সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি
ফিরে যাবো।
কাজে- গল্পে
মেতে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন রাত আটটা ছুঁয়ে ফেলেছে, তখন হুঁশ হলো অনেকটা
ড্রাইভ করে আমায় একাই ফিরতে হবে। রাত আটটা মানে পাহাড়ে নিঝুম রাত। দূরে
পাহাড়ের গায়ে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আলো গুলো তখন এক এক করে নিভে যেতে
শুরু করেছে। আপনাদের শহরের মত এখানে স্ট্রিট লাইট নেই অধিকাংশ জায়গায়। তার
জন্য অবশ্য আমাদের এই পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় না। এসব
রাস্তা আমাদের নিজের হাতের তালুর চেয়েও বেশী চেনা।
সিটে
বসে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি চালু করে বুঝলাম আজ কপালে দুঃখ আছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির
সাথে প্রবল হাওয়া, শীতের কামড় গায়ে দাঁত বসাচ্ছে। সব কাচ তুলে দিয়ে আমি
এগোতে শুরু করলাম। ঘণ্টা তিনেক লেগে যাবে বাড়ি পৌঁছতে। তারকু বস্তি পার করে
যখন বার্মিওক রোডে উঠলাম তখন বৃষ্টি সমস্ত পাগলামো জুটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
দু হাত দূরের রাস্তা'ও আবছা। দমচাপা অন্ধকার রাস্তায় দু পাশের বড় বড় গাছ
গুলিও সঙ্গত মিলিয়ে প্রবল পরাক্রমে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। এই সময়ে গাড়ির সামনে
একটা গাছ ভেঙে পড়লে বা রাস্তায় ধ্বস নামলেই সোনায় সোহাগা। সারা রাত গাড়িতেই
কাটাতে হবে যতক্ষণ না রাস্তা সাফ করার লোকজন এসে পৌঁছোয়। আমি ইষ্টদেবতা
স্মরণ করে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরলাম। মনে পড়লো বোকামো করেছি সুনীল দাজুর
সাবধান বাণী না শুনে, দাজু বলেছিলো 'এই আবহাওয়ার আজ বাড়ি যেতে হবেনা শ্যাম,
এখানে রাত টা থেকে যাও', তাড়া থাকায় আমি ' ও কিছু চিন্তা করোনা দাজু, ঠিক
পৌঁছে যাবো' বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তারকু শেষ হওয়ার পরেই ঘন জঙ্গল,এখানে
একটাও বাড়ি নেই। বৃষ্টি না থাকলে এই সময় পুরো জঙ্গলে মিটমিট করে জোনাকি।
হাওয়ার শব্দ তখন অবিকল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। মাঝে মাঝে শোনা যায় কোনো রাতচরা
পাখির ডাক। এদিকে সন্ধ্যে সাতটার পরেই প্রায় কোনো গাড়িই চলে না, এক
মিলিটারী ট্রাক বাদে। সামনে একটা পাহাড়ি ঝোরা আছে, আমরা বলি খোলা। তার উপরে
লোহার পোক্ত ব্রীজ, বেশ খরস্রোতা, তার উপরে এই বৃষ্টি। খোলায় আজ দ্বিগুণ
জলের ঢল। এই খোলা টা পেরিয়ে সাধারণ দিনে আর মোটামুটি ৩০ মিনিট গেলেই আমার
বাড়ি। খোলা পেরিয়ে চড়াই উঠতে হবে। বাড়ির খুব কাছাকাছি এসে গেছি ভেবে বেশ
স্বস্তিতেই ছিলাম। খোলার উপরের ব্রীজে গাড়ি তুলতেই গাড়ি অস্বাভাবিক একটা
শব্দ করে থেমে গেলো। ঝমঝমে বৃষ্টি, প্রবল ঠাণ্ডা আর হুহু হাওয়া। চারপাশে
কোত্থাও একটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে না। রাত তখন পৌনে এগারোটা, বেশ
কয়েকবার চাবি ঘুরিয়েও কিছুতেই গাড়ি চালু করতে পারছিনা। ওই শীতেও ঘামছি,
গাড়ি থেকে নামার অবস্থা নেই। কাল সকালেই গাড়ি টা ফেরত দিতে হবে, এনজেপি
থেকে ট্যুরিস্ট আনতে যাবে মহেশ সক্কাল সক্কাল। না হলে আজ আমি থেকেই যেতাম
দাজুর বাড়িতে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে জয় শ্রী কৃষ্ণ বলে আরেকবার চেষ্টা
করলাম গাড়ি চালু করার। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি চালু হয়ে গেলো। ওয়াইপারের
চাবি টা ঘুরিয়ে চালু করে সামনের দিকে তাকাতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো।
শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো একটা হিমেল স্রোত।
সমস্ত
জানালার কাচ তোলা। চলন্ত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে হেড লাইটের ছিটকে আসা
আলোয় দেখছি ওয়াইপারের পাশাপাশি গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন মুছে দিয়ে যাচ্ছে একটি
কুচকুচে কালো লোমশ হাত, ঠিক ওয়াইপারের উলটো ডিরেকশনে একই গতিতে কাচ থেকে জল
সরাচ্ছে একটি কনুই অবধি কুচকুচে কালো হাত...
Post A Comment:
0 comments so far,add yours