politics
মুজতবা আল মামুন,  সাংবাদিক, কলকাতা :

সংসার হোক বা দল....  একজন ধার-ভার লোকের প্রয়োজন,  যিনি নিপুন দক্ষতায় হাল ধরে, বাধাবিপত্তি কাটিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সবাইকে। সেখানে বয়স বা পূর্ব অভিজ্ঞতা যে ক্ষমতাবান হতেই হবে,  তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। খুঁটিটা শক্ত করে পোঁতা প্রয়োজন। রাহুল গান্ধী সেই খুঁটি হয়ে ওঠার বদলে, প্রয়োজনকালে অভিমান করে সরে থাকছেন। রাজনৈতিক মহলের মতে,  এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। রাহুলের নিজের পক্ষে, দলের পক্ষে, দেশের পক্ষেও। 

দলের সর্বোচ্চ পদ থেকে রাহুলের সরে যাওয়া,  এমনকী সংসদীয় কাজকর্ম থেকে নিজেকে একরকম সরিয়ে নেওয়ায়, এই মুহূর্তে কংগ্রেস দল এক গভীর আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাতে দলের আভ্যন্তরীণ রাশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এক মহাশূণ্যতা।  দলের অবস্থানের সঙ্গে নেতাদের কাজ ও বিবৃতির ফারাক থেকে যাচ্ছে। এর পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে শাসকদল বা সরকার। রাজ্যসভায় এখনও বিজেপি সংখ্যালঘু। তারপরও ভয়ংকর সব সর্বনাশা বিল পাশ হয়ে যাচ্ছে। ছত্রভঙ্গ বিরোধীদের কাউকে কাউকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারছে বিজেপি। এই সময় ছাতা হয়ে একজন কারুর দাঁড়ানো প্রয়োজন। অভিমানে রাহুল সরে দাঁড়ানোয়,  সে রকম কেউ নেই লোকসভা ও রাজ্যসভায়। দুই কক্ষে বিরোধীদের বহু নামি-দামি সদস্য আছেন। শুধু দরকার একজন নেতার। যিনি সঠিক ভাবে তাদের চালনা করবেন। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতায় লাগাম টানবেন। কিন্তু না,  বিরোধীদের টুটে যাওয়া ঐক্য ফেরাবার কেউ নেই। ছাতা হওয়ার মত কেউ নেই।  সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন অমিত-মোদিরা। 

এর জন্যে রাহুল গান্ধীকে দায়ী করাই যায়। তাঁর দল সর্বভারতীয়। তাঁর নেতৃত্বে দল নাজুক অবস্থা থেকে ক্রমশ  ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। সবচেয়ে বড় কথা,  বিজেপি রাহুলকে ভয় পেতে শুরু করেছিল। সত্যিই রাহুল পদে পদে বিপদে ফেলছিলেন মোদি-অমিতদের। দেশবাসীকেও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতে সমর্থ হচ্ছিলেন। বিপদ বুঝে, এই সময় থেকে বিজেপি রাহুলবধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কংগ্রেসের মস্ত ভুল, এমন আঘাত আসতে পারে, এটা ভাবেই নি ! বা কোন পথে আসবে,  তা আন্দাজ করতে পারে নি ! 

রাজনীতিতে যেমন সুদিন আছে বা আসে,  তেমনি দুর্দিনও আছে বা আসে। এই সত্য উপলব্ধি করে, নেতৃত্বে অনড় থাকতে হয়, আর সময় সময় নিজেকে আপডেটেড করতে হয়। ভুলগুলো শুধরে নিতে হয়। কংগ্রেসকে প্রায় মুছে দিয়ে, বিজেপি এখন মহাশক্তিধর।  তারা বহুত্ববাদ তথা বহু জাতি,  বহু ধর্মের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে,   দেশকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন এক ভয়ংকর সময়ে আইনসভায় একজন সর্বসম্মত নেতার দরকার,  যিনি বিরোধী এক্যকে পুণরায় প্রতিষ্ঠা করে,  লড়াইটা অন্তত জারি রাখতে পারবেন। দেশবাসীর বড় অংশ সেদিক দিয়ে রাহুলকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু লোকসভায় ধাক্কা খাওয়ার পর,  রাহুল হঠাৎ একগুঁয়ে হয়ে দলের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন এবং লোকসভার দলনেতার পদ নিলেন না। সব জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালেন। এটা বড় ভুল। বিশেষত এই সময়ে। 

তাঁর অভিমান বা রাগ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি যখন বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন,  তখন বিরোধীদের একাংশ ধরে নিলেন, বিজেপির ভরাডুবি হলে,  প্রধানমন্ত্রীত্ব চলে যাবে রাহুলের কোলে। তাঁদের কতদিনের সাধ,  ওই পদে বসার। অতএব আঞ্চলিক দল হয়েও, পকেটে বা আঁচলে সাকুল্যে ২০-২৫টা আসন  থাকলেও, তাঁরাও পি এম পদের দাবিদার হয়ে প্রচার শুরু করলেন। বিজেপি বললো, পি এম পদ নিয়ে ওরা মারামারি করবেন। আমরা কিন্তু মারামারি করবো না। ওরা এলে খেয়োখেয়িতে সরকার অস্থায়ী হবে, আমাদের হবে স্থায়ী। মানুষ সেটাই বুঝলো। শেষ পর্যন্ত নিজেরা হতে পারলেন না,  রাহুলকেও হতে দিলেন না। দ্বিতীয়ত, দলের মধ্যে,  প্রবীণরা রাহুলের সব সিদ্ধান্তে সায় দিলেন না। কেউ কেউ পরিবারতন্ত্রের কথা তুলে ঠেস দিলেন। রাহুলের রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু নেতা তিনিই,  যিনি অল্পে ভেঙে পড়েন না। দলে প্রতিকুলতা থাকলে, তা যুক্তি দিয়ে কাটানো এবং সহমতের দলগুলোর মধ্যের বিভ্রান্তি ধৈর্য ধরে দূর করা। 

রাহুল সে সব না করে, কার্যত হঠকারি সিদ্ধান্তে রাজনীতির সক্রিয়তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। এতে সমালোচকদের মুখের ওপর জবাব হয়তো দেওয়া গেল বা যাচ্ছে  কিন্তু ক্ষতি হলো বা হচ্ছে কংগ্রেসেরও। বিজেপি এটাই চেয়েছিল। রাহুলহীন বিরোধী ঐক্যহীন, ছত্রভঙ্গ আইনসভায় সহজেই পাশ করিয়ে নিচ্ছে ভয়ংকর সব বিল। যা দেশকে ভয়ংকর এক বাঁকের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকের ধারণা,  রাহুল এখনও ফিরে এলে, আইনসভায় সক্রিয় হলে,  বিরোধী ঐক্য আবার গড়ে উঠবে। কাঁকড়ার মত যাঁরা তাঁকে টানছিলেন,  কোমর ভেঙেছে তাঁদেরও। তাঁরা এখন কোনও এক নেতার ছাতার তলায় আসতে ব্যগ্র। সময় তাঁদের ঘাড় ধরে কিছু মহাসত্য শিখিয়েছে। 

 তারুণ্যর অভিমান খানিক কাঁচা, খানিক চক্ষুহীন হয়। কিন্তু দলের সর্বোচ্চ পদে বসে,  সমালোচনা সহ্য করতে না পারা,  বাইরের বিরোধীদের বুঝিয়ে নিরস্ত করতে না পারা কখনই বড় নেতার লক্ষণ নয়। এখানে ব্যর্থ রাহুল। তিনি নিজেও বুঝছেন,  দলের নেতা বা সাংসদের চালিত করার জন্যে সর্বভারতীয় একজন মানুষের দরকার। যাঁর রক্তে ঐতিহ্য আছে,  দলের জন্যে ত্যাগ আছে, আছে ধীশক্তি। এই মুহূর্তে রাহুল গান্ধীর  সবগুলো থাকলেও,  ধীশক্তি নেই। তাঁর নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, সে কথাই বলে। ঠিক সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাহুল। 

এখনও সময় আছে,  লোকসভায় ফিরলে, বিরোধীরা অনেকটাই এককাট্টা হয়ে যাবেন। কমন অ্যাজেন্ডায় একসুরে কথা বলতে পারবেন। তাতে রাজ্যসভায় অন্তত ভয়ংকর বিলগুলো আটকানো যেতে পারে। আজ রাহুল এই সত্য অনুধাবন না করলে,  একদিন,  দেশ যখন জ্বলবে,  তাঁকে জবাবদিহি করতেই  হবে। 
এর পাশাপাশি, রাহুল  এখনই  রাশ হাতে না নিলে, দলটাও ভেঙে যাবে। দুর্বল হয়ে যাবে। এখন ৩৭০ ধারার পক্ষে দলের কিছু নেতা যা বলছেন,  তা দলের সিদ্ধান্ত নয়,  তবু বলছেন। এটা ঘটছে,  শতবর্ষ প্রাচীন সর্বভারতীয় দলটা এখন মুন্ডুহীন বলেই। 
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours