choto golpo
চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যানেজিং এডিটর, দ্য অফনিউজ, কলকাতাঃ

পারুল সাইকেলটা গেটের ভিতরে ঢুকিয়ে স্ট্যান্ড করে রাখলো । ঘড়িটা খুলে দু-চার বার বাঁ হাতের পাতায় ঠুকে নিল ।
--নাহ চলছে না, ঘড়িটার বেট্রি বোদয় শেষ, মনে মনে স্বগতোক্তি করে পারুল !  ঘড়িটা ব্যাগে ঢুকিয়ে কলিং বেল টিপলো । মল্লিক গিন্নী গেট খুলে বলল
---কিরে আজ এত দেরি ?  কখন অফিস বেরবো আমরা ? 
--চিন্তা করনি গো বদি ,  টপাস করে সব সেরে ফেলবো, ঘড়িটা বন্দ হয়ে আচে  তাই টাইম বুজিনি গো । সিঁড়ির কোণে ব্যাগটা রেখে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেল পারুল ।
সামনে পুজো,  অনেক বাড়িতেই ঠিকে কাজ করে পারুল,  মল্লিক বাড়ি বাসন মাজা আর সবজী কাটার কাজ করে, মাইনেটাও বেশী নেয়,  সাত বাড়ি থেকে বোনাস পাবে, সবাইকে বলেছে সে টাকা নেবে, শুধু মল্লিক বাড়ি থেকে একটা টাচ ফোনের আবদার করেছে ।
মল্লিক গিন্নী একটু গুই গাই করছিল ,  কিন্তু মল্লিক বাবু ওর চকচকে গতর দেখে আপত্তি করেনি ।
-- নিঃসন্তান  তারা,  কোনো আদি নেই বাদি নেই, গরীবের মেয়ে আবদার করেছে ,  বৌদি বলে ডাকে, দিলেই বা ক্ষতি কি ,,  এমনটাই বুঝিয়ে ছিলেন মল্লিকবাবু তার স্ত্রীকে ।
মল্লিক গিন্নী পারুলকে বলেছিল, -- লেখা পড়া জানিস নাতো,  কি করে ব্যবহার করবি,  আর কিইবা করবি টাচ ফোন নিয়ে ?
পারুল বললো --- ইস্টাইলের জন্ন গো বদি । তোমরা ফেচবুক না কি কর,  আমারও খুব সক করবার ।
--- ফেসবুক করে, কি করবি তুই ? 
--- কেন, নিজের ফটক দেব । সবাই দেয় গো বদি । ফেচবুক করলে ফোনে পয়সা ভত্তে হয়না গো, পয়সা ভরে দেয় গো।
মল্লিক গিন্নী চোখ কপালে তুলে বললেন -- মানে ?  
কে ভরে দেয় ?
-- ওই ফেচবুক ওউলারা গো । 
--- কে বললো তোকে ?
--- কেন,  বিউটি পাল্লারের মনিকা বললো,  ওকে তো ফোনে পয়সা ভরে দেয় ।
মল্লিক গিন্নী শাষনের গলায় বললেন --- এ সব করিস না,  গোল্লায় যাবি  ।
-----নাগো বদি,  কত  শিক্কিত লোক করে জানো !!
দাক্তার,  ইঞ্জিয়ার,  মাস্টার  সব্বাই করে  হেব্বি  
বেপার । হেগো বদি,  তুমি করনা ? 
---- নারে, আমার সময় হয়না ।
---- সেকি গো !!!  পারুল এমন ভাবে বললো যেন অনেক অজানা তথ্য থেকে মল্লিক গিন্নী বঞ্চিত  ।
কাজ শেষে, যাবার সময় পারুল বললো --- বিকেলে আসব না গো বদি ।
---কেন  রে ?
---- অনেক গুলো কুত্তি কিনেছি, ফিটিং করতে নে যাবো  অচ্চনাদির দোকানে ।  পুজোত এসেই গেল ।
--- ঠিক আছে কাল সকাল সকাল আসিস,  কাল মহালয়া,  আমি আর তোর বাবু গঙ্গার ঘাটে যাব ।
--- আচ্চা গো বদি,  মনে মনে পারুল বলে,  বূড়ো বয়সে ঢ্যামনামি দেকো, ভোর হতে না হতেই গঙ্গার হাওয়া খেতে যাবে । 
অন্য সময় হলে পারুল ঝাজি মেরে কথা বলতো,  অনেক সকালে অন্য বাড়ি কাজ থাকে,  কিন্তু টাচ ফোনটা নেওয়া হয়নি  তাই,  দেঁতো হাসি হেসে বলে,
--- হাওয়া খেতে ?
--- নারে তোর বাবুর তর্পণ করতে যাবে,  শরীর ভালো না বাবুর তাই আমি সাথে যাব । 
পারুলের এই হঠাৎ পরিবর্তন মল্লিক গিন্নী ভালোই বুঝলেন,  সাথে কারণটাও ।
গঙ্গার ঘাট থেকে এসে বাসন মেজে রান্না সারতে অনেক  বেলা মল্লিক গিন্নীর । খুব রেগে আছেন পারুলের উপর,  এত করে বলা সত্ত্বেও  সকাল সকাল তো দূর অস্ত, কাজেই এল না । তিনি সমাজ সেবক মুলক কাজে যুক্ত আছেন একটা সংস্থায় । সেখানে গরীবদের শাড়ি  বন্টনের কথা আজ। যেতে পারলোনা, ওই  পারুলের জন্য । দূর করে তাড়িয়ে দেবে এবার কাজ থেকে,  মাস মাস একগাদা মাইনে নেবে তার উপর কামাই ।  টাচ ফোন না কচু কিনে দেবে, মনে  মনে স্থির করে নিলেন মল্লিক গিন্নী।।
চার- পাঁচ দিন কেটে গেলো, এল না পারুল । মল্লিক বাবু পারুলের খোঁজে গেলেন, বস্তির এপাশটায় খুব নোংরা,  কর্পোরেশনের কল থেকে সমানে জল পড়ে  যাচ্ছে  , তা জমে আছে জায়গায় জায়গায় । গা ঘিন ঘিন করে ওঠে মল্লিক বাবুর । মল্লিক বাবু নাকে রুমাল চেপে এগিয়ে গেলেন পারুলের খোঁজে ।  
--- বাবু কাউরে খুসতিসেন ?  বস্তিবাসী বৃদ্ধার মুখে বিস্ময় সূচক জিজ্ঞাসা । 
--- হ্যাঁ , পারুলের ঘর কোন দিকে জানো ?
--- সেতো ঘরে নেই বাবু , তিন দিন হল হাসপাতালে ভত্তি ।
--- কেন,  কি হল তার ?
--- ডেংগু গো বাবু, মেয়েটা হয়ত আর বাচবেনি ।
--- খুব খারাপ অবস্থা নাকি?  পারুলের বাড়ির লোক কে ডেকে দাওতো !! 
---- এখানে পারুলের কেউ থাকেনে বাবু, অর বাড়ি আবাদে, সেখানে এক বিধ্বা মা আছে । আর কেউ নেই,  মেয়েটা মরি গেলি আর কেউ নেই অর মা'রে দেকার ।
কিছু একটা ভেবে মল্লিক বাবু বলেন,--- কোন হসপিটালে আছে জানো ?
---- সরকারি হাসপাতালে বাবু ।
       
  সেদিন ষষ্ঠী,  সকাল বেলা,  মশারির ভিতর দিয়ে, কপালে একটা ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায়, চোখ খুলে তাকালো পারুল, দেখে মল্লিক গিন্নী উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে ।
মল্লিক গিন্নি বললেন,--- কেমন আছিস রে, এত শরীর খারাপ আগে বলিসনি কেন ?  উঠে আয় মা, তোকে এখানে রাখবো না, নার্সিংহোমে তোকে ভর্তি করবো, সব ব্যবস্থা করে এসেছি,  শরীর সুস্থ না হাওয়া পর্যন্ত আমার কাছেই থাকবি, তোর মা'কেও দেশ থেকে আনতে পাঠিয়েছি, তোরা আমার কাছেই থাকবি ।
পারুল কোন কথা বলতে পারেনা আবেগে , চোখ বেয়ে মুক্তোর ফোঁটা গড়য়ে এলো কান বরাবর ।
এই প্রথম সে জ্যান্ত দুর্গা দেখলো ।। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours