দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
“একজন বিপন্ন মানুষ, আরেকজন বিপন্ন মানুষের হাত ধরেছে। চিকিৎসকের ক্ষেত্রে সেই হাত ছাড়ানো যায় না”। কথাগুলো স্বগতোক্তির মত যিনি সারাজীবন আওড়ে যান তিনি একজন ‘এক টাকার ডাক্তার’। নাম ডঃ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি বোলপুরের হরগৌরীতলায়। যখন রাজ্যের সমস্ত সরকারী হাসপাতালে পরিষেবা আন্দোলনে বন্ধ রেখেছিল। বেসরকারি হাসপাতাল নিশ্চয় খোলা ছিল। কিন্তু সেখানে গ্রামের গরিব গুর্বো মানুষের পৌঁছাবার উপায় ছিল না। সেখানে অনায়াসেই স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত হরগৌরিতলায় হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটিতে। সামনে অগুনিত মানুষের ভিড়। ঐকদিন একটু বেশিই রোগী ছিল। রুগী মনোজ হাজরা জানান, সব দরজা বন্ধ থাকলেও ভগবানের দরজা বন্ধ থাকে না। তাই আমার মত অনেকেই এখানে চিকিৎসা পাচ্ছে।
কিন্তু ‘এক টাকা’ কেন? যেখানে বাসে উঠলেই ১০ টাকা! তার উত্তরে তিনি বলেন, একসময় দেখেন গরীব মানুষেরা গামছা পেতে মুড়ি খাচ্ছে। তখন মনে হয়েছিল এই মানুষদের কাছে ১ টাকার বেশী নেওয়া যায় না। কোলকাতায় নীলরতন সরকার হাসপাতালে
চিকিৎসকদের উপর আক্রমণের সময় সুশোভনবাবু যথারীতি চিকিৎসকের উপর আক্রমণে প্রতিবাদ জানাতে সহকর্মীদের সাথে মিছিলে হেঁটেছেন। তাঁর বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তিনি বলেন, মানুষ বিপদে পড়ে বাঁচার আশায় চিকিৎসকের হাত ধরেন। তাই প্রতিবাদের মাধ্যম পরিষেবা বন্ধ করে নয়। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে। একজন চিকিৎসক চেষ্টা করে রোগীকে বাঁচাতে। কোন সময় পারেন। আবার কোন সময় পারেন না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা গর্হিত কাজ। আমাদের শিক্ষিত হতে হবে।
ভেবে দেখুন, যে ভাবী চিকিৎসক সমস্ত ক্ষেত্রে টপার হয়ে, একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। তাঁর কাছে জীবনের শুরুতেই এটা কীরকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা! এটা বুঝলে হাসপাতালে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটবে না।
বোলপুরে সুশোভনবাবুর তিনপুরুষের বাস। বাবা বিনয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অফিসে কর্মরত ছিলেন। মা মণিবালা বন্দ্যোপাধ্যায় গৃহবধূ। স্ত্রী গৃহবধূ ছায়া বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হত। মেয়ে জামাই দুজনেই চিকিৎসক। অনায়াসেই আয়াসে জীবন কাটাতে পারতেন। কালের নিয়মে প্রিয়জনদের অনেকে এক করে তাঁকে ছেড়ে গেছেন। কিন্তু, না! আজ রুগীই সুশোভনবাবুর একমাত্র পরিবার। তাঁদের জন্য তিনি অপেক্ষায় থাকেন। ১৯৬২ সালে সুশোভনবাবু এম বি বি এস পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এস সি ( গোল্ড মেডালিস্ট)। তাঁর বিষয় ছিল হেমাটোলজি। তিনি ছিলেন শেফিল্ডের সিনিওর রেজিস্ট্রার এবং সিনিওর ইনচার্জ। তখন তাঁর বার্ষিক বেতন ছিল ষোলো হাজার পাউণ্ড। আজ চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে এক টাকার ডাক্তার। ১৯৭৮ সালে শেফিল্ড থেকে চাকরী ছেড়ে বিশ্বভারতীতে যোগদান করেন ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে। সেটাও এক সময় ছেড়ে দিয়ে গ্রামের অসহায় মানুষের জন্য চেম্বার খুলে বসেন। ছোট্ট একটা সেবা নিকেতন। তাতেই চলে দান খয়রাত। রাজনীতিতে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে। তিন থেকে চার বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৮৩ সালে জয়ী হন। একসময়ে জাতীয় কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক ও সভাপতি হন। এ আই সিসির সদস্যও হন। ১৯৮৩ সালে জ্ঞানী জৈল সিং, তারপর ক্রমান্বয়ে, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, প্রতিভা পাটিল, প্রনব মুখোপাধ্যায় এবং বর্তমানে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বভারতীতে দায়িত্বের সাথে কার্যভার সামলান। ১৯৯৮ সালে ইস্ট ওয়েস্ট ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি ২৫জনকে বেস্ট সিটিজেন এওয়ার্ড দেয়। তার মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
এমন একজন সুনাগরিকের জীবন দর্শন আব্রাহাম লিঙ্কনের এক বিশেষ উক্তিঃ এই জগত অনেক কষ্ট পায়। খারাপ লোকেদের হিংসার জন্য নয়। কিন্তু ভালো মানুষের নিরবতার জন্যই।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours