কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
এও এক উন্নয়নের গল্প।

কৃষকদের জমি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত। বন কেটে সাফ করে আরও ফসল ফলানো। মাটির বুক চিরে খনিজ সম্পদ চুরি। এই বেড়ে চলা সর্বগ্রাসী লালসার আগুনেই আমাজন দহন। একরোখা শাসকের গলায় সেই যাবতীয় অভিযোগ ওড়ানোর চেনা স্বর। "এ এমন কোনও ঘটনাই না," বলছেন ব্রাজিলের খোদ রাষ্ট্রপতি জায়র বোলসোনারো। "গত পনেরো বছরের দাবানলের গড়পরতা হিসেবটা একবার দেখুন।"   


বিশ্বের ফুসফুস' আমাজনের এই বর্ষাবন। আমাজন রেনফরেস্ট। পৃথিবী নামের এই গ্রহটার শতকরা কুড়ি ভাগ অক্সিজেনের উৎস। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে রাখার ওস্তাদ কারিগর। ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের মতো চ্যানেলগুলির দৌলতে, আজ আমাজন এক অতি পরিচিত নাম বিশ্বের দরবারে। সেই রহস্যে ঘেরা বর্ষাবন সমানে জ্বলছে।
কালো ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ। ধোঁয়া দেশের সীমারেখা চেনে না। তা পৌঁছে গেছে প্রায় সতেরোশ মাইল দূরের সাও পাওলোতে। অসহায় মানুষ। এই ভয়াবহ আগুনের সামনে গোটা বিশ্ব দাঁড় করিয়েছে বোলসোনারোকে। অভিযোগ, পরিবেশবিদদের কোনও পরামর্শেই তিনি গুরুত্ব দেননি। নইলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। ব্রাজিলের রাস্তায় উপচে পড়ছে প্রতিবাদীদের মিছিল।

ওদিকে রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, আমাজনের অরণ্যপুত্ররা কোনও দিনই বোলসোনারোর সুনজরে ছিলেন না। অরণ্যের ওপর তাঁদের যে জন্মগত অধিকার, দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নিতে নারাজ। কৃষিজমি বাড়ানো, খনিজ সম্পদ তোলার সিদ্ধান্ত তারই অঙ্গ। এই মনোভাবের খেসারত দিতেই বর্ষাবন ক্রমেই গুটিয়ে আসছে। চলতি বছরের গোড়াতেই সতর্কবাণী শুনিয়েছিল পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা গ্রিনপিস। শাসকদলের এই মনোভাব যে কোনও সময় বিপর্যয় ডেকে আনবে।


আমাজনের ভয়ঙ্কর আগুনের আঁচ ছড়িয়েছে বিশ্বময়। ক্ষোভে জ্বলছে সবাই। বিদেশে ব্রাজিলের দূতাবাসের সামনে ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। জানাচ্ছে তাদের কড়া প্রতিবাদ। ওদিকে অনড় অবস্থান শাসকের। গত শুক্রবার টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়েছিলেন অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতি। তাঁর সাফাই, যত না আগুন, তারচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে গুজব। বিশ্বের সব দেশেই এমনটা হয়। ব্রাজিলের এই ঘটনা মোটেই বিরল না। পরিস্থিতির জন্য বোলসোনারো ভিলেন ঠাওড়েছেন দেশের রুক্ষ সূক্ষ আবহাওয়াকে। তিনি বলেন, "প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে গ্রীষ্মে তো এমন ঘটনা আকছার।"
রাষ্ট্রপতির কথায় ভরসা রাখতে পারছে না কেউ। তাঁকে চাপে ফেলতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক দেশ। ইতিমধ্যেই ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের কাছে দরবার করেছে ফিনল্যান্ড। বলা হয়েছে, ব্রাজিল থেকে বিফ আমদানি  বন্ধ করা হোক। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড। এই হুমকিকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি।

স্পষ্টভাষায় তিনি বলেছেন, "একজন সামরিক অফিসার হিসেবে শিখেছি আমাজনকে ভালবাসতে। তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমার।" বোলসোনারো যে গোটা ঘটনার ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস তা বোঝাতে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, শুধু বর্ষাবন না। ওই অঞ্চলে বাস দেশের কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষের।


আমাজনের বর্ষাবনের ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর আগুনের নজির নেই। এমনটাই দাবি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ সংস্থার। এক পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, ব্রাজিলে আগুন লাগার ঘটনা বেড়েছে পঁচাশি শতাংশ। ঘটনার সমর্থন মিলেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা'র বক্তব্যেও। 2010 সালের পর আগুনের এমন ভয়াবহতা দেখা যায়নি।

তবে এত ঘটনার পরেও সরকারের কোনও ভুল সিদ্ধান্ত বা গাফিলতির কথা মানতে নারাজ শাসকগোষ্ঠী। দেশের রাষ্ট্রপতি এখনও বলে চলেছেন, "এ সময় চাষীরা নতুন ফসল তৈরির আগে, প্রতি বছরই খেতে আগুন দেয়।" তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে তিনি জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় যাবতীয় পদক্ষেপ করছে সরকার।
গত শনিবারের সাংবাদিক সম্মেলনে, একই সুর শোনা যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফার্নান্ডো আজিভেডো ই সিলভা'র গলাতেও। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি বলেন, "প্রথম ধাপে 700 সেনা পাঠানো হচ্ছে আগুনের মোকাবিলা করতে।"


বিশ্ব পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা মাথায় রেখে, আমাজন রেনফরেস্টের এই অগ্নিকাণ্ড কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। জানিয়েছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্টোনিও গুটেরাস। "আমরা সব রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত," বলেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানান, বোলসোনারোর সঙ্গে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর কথা হয়েছে।
রাজনৈতিক স্তরের এই কথা চালাচালির পাশাপাশি, ক্রমেই জোর ধরছে সাধারণ মানুষের  ব্রাজিল সরকারবিরোধী প্রতিবাদ। বাড়ছে রাজনৈতিক চাপ। তাতে অবশ্য বর্ষাবন দহনের ব্যাপকতা বিন্দুমাত্র কমার কোনও লক্ষণ চোখে পড়েনি। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রাজিলের বন্য আদিবাসী সমাজ। বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় তিন মিলিয়ন গাছ, বন্যপ্রাণী। সবারই আশ্রয়স্থল এক ও অভিন্ন এই আমাজন বর্ষাবন। উন্নয়ন যজ্ঞে বর্ষাবন আহুতি হবে নাতো?



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours