কী নাম দেব তার?
কলির কুরুবংশ।
তথাকথিত শিক্ষায় দীক্ষায়, আভিজাত্যে, সামাজিক অবস্থানে সব হাই প্রোফাইল মানুষজন। প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক ভারতের শাসকগোষ্ঠী। অথচ আতস কাচের তলায় এলেই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডোবা গোটা পরিবার। কলঙ্কের কালির গাঢ় ছোপ স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধু সবার গায়ে।
যখন এই খবরটা লিখছি, তখন হয়তো সিবিআই ভবনের লক আপে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন পালান্নিয়াম চিদাম্বরম। দেশের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী। চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠছে, পুরনো সেই দিনের কথা।
"দেখুন কেমন প্রশস্ত ঘরখানা!" নতুন লক আপ দেখিয়ে বলেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। দিনটা ছিলো, 2011 সালের 30 এপ্রিল। উপলক্ষ্য, দিল্লিতে সিবিআইয়ের নতুন ভবন উদ্বোধন। উদ্বোধন কর্তা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন চিদাম্বরম। লক আপের চেহারা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেছিলেন, "মানবাধিকার কর্মীরা আর বলতে পারবেন না, অভিযুক্তকে ছোট কুটুরিতে রাখা হয়েছে।"
ওই ঘটনার পর আট বছর চার মাস পেরোতে না পেরোতেই ওই লক আপে বন্দি হলেন খোদ চিদাম্বরম। বন্দিদশা থেকেই শাহজাহান তাকিয়ে থাকতেন তাঁর কীর্তি তাজমহলের দিকে। চিদাম্বরমও বন্দি হয়ে অসহায় অবস্থায় দেখলেন তাঁর সিবিআই ভবনকে। নিজের হাতেই ওই সিবিআই ভবন পরিকল্পনায় মঞ্জুরী দিয়েছিলেন তিনি। ঠিক যেন সম্রাট শাহজাহানের কংগ্রেস সংস্করণ।
বড় ঘরের ওপর সম্ভবত চিদাম্বরমের কোনও দুর্বলতা কাজ করে। বৃহস্পতিবার রাউজ অ্যাভিনিউয়ে সিবিআই বিশেষ আদালতে যখন তিনি হাজির হলেন, তখনও ঠোঁটের কোণে ঝুলছিলো তাঁর সেই চির পরিচিত এক টুকরো হাসি। প্রশ্ন তখন একটাই, বেল না জেল? হয়ত নিশ্চিত করেই বলা যায়, ওই হাসিটুকু দিয়েই মনের চাপ লুকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে ওই প্রবল চাপ নিয়ে আদালতে শুনানির ঘরে পা রেখেই তিনি বলেন, "ভেবেছিলাম আরও বড় ঘর হবে।"
পুত্রের উচ্চাশাপূরণের চেষ্টায় অন্ধ, কংগ্রেস জমানার ধৃতরাষ্ট্র চিদাম্বরম। মুখার্জি দম্পতিকে তিনি, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, অনুরোধ জানিয়েছিলেন পুত্র কার্তির ব্যবসায় সাহায্য করতে। সেই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে প্রায় চার কোটি টাকা পকেটে ঢোকে কার্তির। আইএনএক্স মেডিয়া মামলায় এমনটাই অভিযোগ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল সিবিআইয়ের। ইন্দ্রানী মুখার্জি সরকারি সাক্ষী হওয়ার পরেই চাপে পড়ে যান পি চিদাম্বরম। ইন্দ্রাণী তাঁর বয়ানে জানান, নর্থ ব্লকের অফিসে তাঁর স্বামী পিটার মুখার্জির সঙ্গে কথা হয়েছিল চিদাম্বরমের। তখনই অর্থমন্ত্রী পিটারকে বলেন, কার্তির ব্যবসায় মদত করতে। সমঝদার কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হোতা হ্যায়! এরপরেই চিদাম্বরমের সঙ্গে দরদাম করে, প্রায় চার কোটি টাকার বিনিময়ে মুখার্জি দম্পতির হাতে আসে বিদেশী লগ্নির ছাড়পত্র।
বুদ্ধিমান চিদাম্বরম পুত্র কার্তি । তিনি বলেছেন, "এ শুধু আমাদের ফাঁসানোর চক্রান্ত নয়। বিজেপি'র নিশানায় কংগ্রেস।" দুর্নীতির এই মামলায় তিনি সরাসরি জড়িয়ে ফেলেছেন কংগ্রেসকে। আসলে রাজনৈতিক রং দিয়ে তিনি চেয়েছিলেন, গোটা ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে। সেই সঙ্গে পাক্কা দাবাড়ুর চালে, কংগ্রেসকে তাঁদের ব্যক্তিগত লড়াইয়ে টেনে আনতে।
আইএনএক্স কান্ডতো মামুলি। মেরেকেটে তিনশো পাঁচ কোটি টাকার বিনিয়োগে, আইনকানুন শিকেয় তুলে, বিদেশী লগ্নির ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ। এয়ারসেল- ম্যাক্সিস মামলায় বিনিয়োগের অঙ্ক দশ গুনেরও বেশি। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ সেই একই। বিদেশী লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়ার অনিয়ম। ঘটনা 2006 সালের। এই দুই দুর্নীতির ঘটনাতেই, প্রশ্ন উঠেছে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের ভূমিকা নিয়ে। কারণ, ক্যাবিনেট কমিটি অফ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার হকদার। গত বছর এয়ারসেল- অ্যাক্সিস মামলায় উন্নিশে জুলাইয়ের সিবিআই চার্জশিটে পিতাপুত্র পি চিদাম্বরম, কার্তির নাম আছে।
এছাড়াও ওই মামলায়, পৃথক এক অর্থ পাচারের ঘটনায় ইডি'র জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয় চিদাম্বরমকে।
কীর্তির শেষ নেই মার্জিত চেহারার রাজনীতিবিদ পি চিদাম্বরমের। এয়ারসেল ইন্ডিয়ার তিরিশ হাজার কোটি টাকার বিমান কেনা নিয়েও সন্দেহের আঙুল উঠেছিল প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দিকে। ইডি'র তরফ থেকে চিদাম্বরমকে বলা হয়েছিল, অগাস্ট তেইশ তারিখে হাজির হতে। তার আগেই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে সিবিআইয়ের হেফাজতে। কলঙ্কের শেষ নেই। ইসরত জঁহা মামলায় দিল্লি পুলিসের অভিযোগ ছিলো, এফিডেভিটে কারসাজি করেছিলেন খোদ চিদাম্বরম।।
আইএনএক্স মেডিয়া কান্ডে কংগ্রেসের কপিল সিবাল, অভিষেক মনু সিংভির মতো ধুরন্ধর আইনজীবীরা বারেবারে প্রশ্ন তুলেছেন, দশ বছর পর হঠাত কেন আইএনএক্স মামলা নিয়ে নড়েচড়ে বসালো সিবিআই? কেনই বা এত বছরের পুরনো ঘা খুঁচিয়ে তোলা? উত্তরটা বুঝেও না বোঝার ভান করছে কংগ্রেস। আইএনএক্স, এয়ারসেল- ম্যাক্সের দুই ঘটনাই হয়েছিলো মনমোহন সিংয়ের 'ইউপিএ- এক' জমানায়। এরপর আসে 'ইউপিএ- দুই'। শেষ পর্যন্ত 2014 সালে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দ থেকে গুটিয়ে যায় কংগ্রেস। অভিষেক হয় মোদি জমানার। তারপরেই 2017 সালের পনেরো মে, আইএনএক্স মেডিয়া মামলায় এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। পরের বছরেই একই রাস্তায় হাঁটে ইডি। জমা পড়ে এফআইআর।
কংগ্রেস জমানায় পি চিদাম্বরমের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাবে সিবিআই? সম্ভবত, একটু বাড়াবাড়ি রকমের বোকা বোকা কথা বলে ফেলেছেন কপিল সিবাল, অভিষেক মনু সিংভি। মনমোহন জমানাতেই সিবিআইয়ের গায়ে সিলমোহর পড়েছিল 'খাঁচাবন্দি তোতার'। চাপে পড়লেই সবকিছু বড্ড তাড়াতাড়ি ভুলে মেরে দেয় কংগ্রেস। হয়তো এও এক ঐতিহ্য দেশের প্রাচীনতম দলের।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও অন্ধত্ব গ্রাস করতে পারেনি গান্ধারিকে। চিদাম্বরমের স্ত্রী নলিনী কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সহধর্মিণী। এক যাত্রায় পৃথক ফল, কেন হবে? তিনিও উৎকোচ কান্ডে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। সারদা কান্ডে সিবিআইয়ের চার্জশিটে নাম আছে তাঁরও। এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা নেওয়ার অভিযোগ। চলতি বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা হাইকোর্ট তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে, অন্তর্বর্তীকালীন নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। সারদা মামলায় আপাতত গ্রেপ্তারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন তিনি।
দুর্নীতির দায়ে জড়িয়ে আছে গোটা চিদাম্বরম পরিবার। বিদেশী অর্থ রোজগারের অঙ্কটা কী, ঠিক কতো টাকার সম্পদ ছড়িয়ে আছে দেশে বিদেশে, তা এখনও অজানা। তবে আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় ইডি, কার্তির চুয়ান্ন কোটি টাকার সম্পত্তির উল্লেখ করেছে।
সম্প্রতি কালো টাকা, বিদেশী আয় ও বিদেশে সম্পত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে, আয়কর বিভাগের সন্দেহের কোপে পড়ে ওই পরিবার। চিদাম্বরম, নলিনী, কার্তির সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর স্ত্রী শ্রীনিধির নামও। গত বছর নভেম্বর মাসে মাদ্রাজ হাইকোর্টের আদেশে সেই অভিযোগ থেকে রক্ষা পায় চিদাম্বরম পরিবার। ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের হয়। তবে যতদিন না শুনানি শুরু হয় ততদিনই স্বস্তি।
কম যান না চিদাম্বরমের আত্মীয় স্বজনরাও। তাঁদের নাম জড়িয়ে আছে তামিলনাড়ুর এক হোটেল কেলেঙ্কারিতে।
তবে সব ঘটনাই আপাতত বিচারাধীন। ভবিষ্যত বলবে, সত্যিই কি গোটাটাই রাজনীতির রংবাজি, নাকি দুর্নীতির এক ধারাবাহিক উপাখ্যান।
তবে অভিযোগের রকম- সকম, আর চিদাম্বরমের গা- ঢাকা দেওয়া দেখে মনে হয়, ঘটনার সারবত্তা আছে। গোটাটাই নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চক্রান্ত না। সেক্ষেত্রে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। চিদাম্বরম পরিবারের আভিজাত্য নিয়ে সবাই সচেতন। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার মধ্যে এঁরা নেই। যখনই কোনও কারবার করুন না কেন, তা কোটির অঙ্কেই গুনতে হয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours