শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:
ফালাকাটার গৌরী টকিজের 'কালকূট' এসেছে।স্কুল কেটে দলে দলে ছাত্রদের ভীড়। বন্ধু বিজু (ভাল নাম বিজয়, ডাকনামে কেউ ডাকতাম না, আড়ালে আবডালে সবাই বলতাম বেজি) তালপাতার সেপাই, ঢ্যাংঢেঙে লম্বা। টিকটিকির মতো টিকিট কাউন্টারের লোহার জালিতে লেপ্টে গিয়ে ওপর থেকেই লোহার কাউন্টারের জানলায় হাত ঢোকালো। লাইনের সবাই বাধা দেবে কি, সকলেই মহা চিন্তিত। বিজু না অন্যদের টপকে এসেছে, না সাইড দিয়ে হাত ঢুকিয়েছে। তাই এটা কি হবে ভাবতে ভাবতেই বিজুর টিকিট কাটা সারা। সেদিন সে সত্যিই বিজয়ী। আমাদের, তথাকথিত ভাল ছেলেদের, দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে টিকিট ধরিয়ে দিয়ে লাওয়ারিশ ফ্লিমের অমিতাভের মতো জামাটা বেঁধে সিনেমা হল ঢুকে প'রল, পেছন পেছন নববধূর মতো (টিকিট কাটতে না পারার গ্লানিতে) লজ্জায় আমরাও ঢুকলাম।
গৌরী টকিজ, আসলে ড্রামাটিক হল। সাবেক জলপাইগুড়ি (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলা) জেলার প্রথম মহকুমা ফালাকাটার নাটক, জলসা, সিনেমার কেন্দ্র ছিল সবেধন নীলমণি এই গৌরী টকিজ...আমাদের একসময়ের সব পেয়েছির আসর। ছোটবেলায় 'হীরে মানিক' (কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলাম দেখতে দেখতে!), 'বিদ্যাসাগর' ( বিদ্যাসাগরের ছবি আঁকা একটা খাতা দিত দেখতে গেলে) 'নানহে ফরিস্তে', 'রামায়ণ' ইত্যাদি ছবি ছাড়া কোনো অনুমতিই পাওয়া যেত না অন্য ছবি দেখবার! বয়ঃসন্ধিতে 'নদিয়া কে পার' দেখে প্রণব পড়লো নায়িকা সাধনা সিংহের প্রবল প্রেমে। আর 'দুটি পাতা'র মিতা দেবরায় আমার স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো। যাহ'ক হ্যাংওভার কাটতেই বেশ পাকা দর্শক হয়ে উঠেছিলাম আমরা। পুটনের একটু সমস্যা হ'ত। কেননা ওর বাবা ছিলেন ম্যানেজার। একটু আড়ালে আবডালে ওকে ম্যানেজ করতে হ'ত আর কি! তবে বিটকেল কিছু ব্যাপারও হ'ত। যেমন একবার ম্যাটিনি শোতে ছবি দেখতে ঢুকে অন্ধকারে সিট বুঝতে না পেরে বাপি, খুকু দিদিমণির কোলে ব'সে প'রেছিল। ভাগ্যিস দিদিমণি আমাদের চিনতে পেরেছিলেন, তা না হলে সেদিন আর দেখতে হ'ত না! একইরকম ভাবে বিভাস একদিন ওই ম্যাটিনি শোতে ঢুকে কিছু ঠাহর করতে না পেরে এক লোককে, 'দাদা কতক্ষণ শুরু হয়েছে?' এই প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছিল, 'কি রে? তুই স্কুল যাস নি? দাঁড়া আজ টের পাবি...।' লোকটা আর কেউ নন, বিভাসের ছোটমামা! আর সেদিন বিভাসের না হয়েছিল সিনেমা দেখা, না জুটেছিল খাওয়া। বনদপ্তরের পার্কটা তখন ছিল না। তাই সিনেমা হলের পিছনে ব'সে ডায়লগ শোনার জন্য বেশ ভীড় জমতো। বোধহয় সব শহরেই এটা কমবেশি ছিল। আবার ঐ ড্রামাটিক হলে নানা অনুষ্ঠানে আমরাই ব্যাজ-ট্যাজ লাগিয়ে দর্শকদের বসাতাম। মজা লাগত এটাই, যে সিটগুলোকে আমরা সিনেমা দেখার সময় পাত্তা দিতাম না, সেগুলিই নাটক বা অন্য অনুষ্ঠানে মহার্ঘ হয়ে উঠত। মনে পড়ছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হসপিটালের চিকিৎসক শ্রী রজত ঘোষের কথা। ছোটবেলায় ওঁরা চব্বিশ কিমি দূরের বীরপাড়া থেকে ফালাকাটায় গৌরী টকিজে ছবি দেখতে আসতেন। আসলে সেসময় ডুয়ার্সের বেশির ভাগ জনপদেই সিনেমা হল বস্তুটি ছিল না। সেদিক থেকে ফালাকাটার গৌরী টকিজ ছিল বিরাট ভরসা।
গৌরী টকিজ আজও আছে। কিন্তু এই প্রজন্মের সঙ্গে সিনেমা হলের সখ্যতা গড়ে ওঠে নি, উঠবেও না। আমাদের কাছে সিনেমা হল বড় হয়ে ওঠার চিহ্ন ছিল। জীবনের অনেকগুলি বছর নিষিদ্ধ ছিল ব'লেই হয়তো সিনেমা হল টানত বেশি। আজকাল সবাই ছোট থেকেই বড়...বাড়ির ছোট সদস্যেরও মতামত গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়। আমাদের অভিভাবকরা? কম বেশি সকলেই ছিলেন একনায়ক। কিন্তু এই একনায়কত্বের কারণ ছিল আমাদের চরিত্রকে মজবুত করা, আর সেই মজবুত করার জগতে সিনেমা হল ছিল ব্রাত্য।
কিন্তু আদৌ কি ব্রাত্য করতে পেরেছিলেন? না মনে হয়। তাই গৌরী টকিজ রমরম ক'রে চলত তার ভাঙাচোরা চেহারা নিয়ে। আমরা আমাদের সেই গৌরী টকিজকে ভীষণ ভালবাসতাম যে!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours