মুসবা তিন্নি, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ: 

২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারের  সামরিক বাহিনীর দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা নামক মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সে সময় তাদের নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে । তখন বিভিন্ন মানবিক দিক লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ সরকার তাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের প্রবেশাধিকার দেয় । তারই ধারাবাহিকতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে । সে সময় প্রায় ৬,৫৫,০০০ থেকে ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩,০০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া, ভারতের হায়দ্রাবাদের রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ফলে মিয়ানমারের মতো তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। তাদের আশ্রয় এবং মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করে মানবিক মহানুভবতার জন্য যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ‘চ্যনেল ফোর’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি দেন।

ইতিহাস : রোহিঙ্গা মায়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি, যাদেরকে অনেক মিয়ানমারি বৌদ্ধরা বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে হিসেবে গণ্য করে। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে এবং বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার জন্য বলছে। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং চরমপন্থী বৌদ্ধদের হাতে নির্যাতিত। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে বাস করতে শুরু করে, ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ৩,০০,০০০- ৫,০০,০০০-এর মতো শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। অধিকাংশ শরণার্থী টেকনাফ-কক্সবাজার হাইওয়ে বরাবর অবস্থিত নাফ নদীর সমান্তরালে বাস করে, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। বেশিরভাগ শরণার্থীরা কক্সবাজার বা এর কাছাকাছি অবস্থিত, পর্যটনশিল্পের উপর নির্ভরশীল একটি উপকূলবর্তী এলাকায় বাস করছে।
বাংলাদেশ মনে করে শরণার্থীদের দ্বারা এলাকাটির পর্যটন প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শরণার্থীদের অপরাধ এবং কক্সবাজারে ২০১২ রামু সহিংসতার জন্যও দোষারূপ করা হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের এদেশে অনাগমনমুখী নীতি তৈরির অনুসরণ করছে। অধিকাংশ শরণার্থী অনিবন্ধিত রয়ে গেছে, শুধুমাত্র ৩২ হাজার শরণার্থী নিজেদের ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে নিবন্ধন করেছে। আনুমানিক ২,০০,০০০-এর অধিক শরণার্থী অনিবন্ধিত অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাস করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট, ডিসেম্বর ২০১৬-এর একটি প্রতিবেদনে বলেছে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ধর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং রোহিঙ্গাদের বাসভবন দখলে তত্ত্বাবধান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থীরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সরিয়ে দিচ্ছে।[২০] এছাড়াও তাদের ইয়াবা আমদানি করার জন্য নিন্দা করা হচ্ছে।

প্রত্যাবাসন : ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক করা হয়েছিল। সে সময় রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় কাউকেই রাখাইনে পাঠানো যায়নি। মিয়ানমার সরকার  প্রত্যাবাসনের জন্য ১ হাজার ৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৫৪০ জনের নামের তালিকা পাঠায়।  প্রত্যাবাসনের চেস্টা চললেও রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তারা ৫ দফা দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করছে। দফাগুলো হচ্ছে:
রোহিঙ্গারা আরাকানের (রাখাইন) স্থায়ী বাসিন্দা। সে কারণে রোহিঙ্গাদের ‘স্থানীয়’ স্বীকৃতি দিয়ে সংসদে আইন পাস করতে হবে।
আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে। কেড়ে নেওয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে। 
২০১৯ এর ২২আগস্ট রোহিঙ্গা পুনরায় প্রত্যাবাসনের কথা থাকলেও কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে না চাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার তাদের জোর করে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের ক্ষতি : রোহিঙ্গাদের কারণে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে স্থানীয় হাজারও কৃষক তাদের জমির ধান থেকে কোনো ফসল পাননি। অনেকেই তাদের জমি হারিয়েছেন। উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগণের চেয়ে দ্বিগুণ রোহিঙ্গা আসায় জনসংখ্যা তাত্ত্বিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যেসব অবকাঠামো রয়েছে, যেমন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বাজার, হাসপাতাল ইত্যাদির সক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া স্কুল, উপজেলা কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা সংস্থা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটছে। স্বল্প আয়ের স্থানীয় মানুষ বিশেষ করে যারা দৈনিক হাজিরায় কাজ করেন তারা তাদের কাজ হারিয়েছেন। কারণ রোহিঙ্গাদের স্বল্প দামেই কাজে লাগানো যাচ্ছে। ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর সংরক্ষিত বন কাটা হয়েছে রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরিতে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জ্বালানির চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়ত বনের গাছ কাটা অব্যাহত রয়েছে। সাড়ে ৪ হাজার একর জায়গার মধ্যে ৩৫ হাজার পায়খানা এবং ৭ হাজার টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ফলে উখিয়ার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। এ কারণে পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ও করিডরে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এখানে নিয়োজিত রয়েছেন। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছেন। ফলে তাদের থেকে যে সেবা পাওয়ার কথা সেটি থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের জন্য মধ্য মেয়াদে ২ লাখ সেল্টার (ঘর) তৈরি করা প্রয়োজন। প্রতিটি ঘরের জন্য প্রয়োজন ৭৫০ মার্কিন ডলার। সাধারণ খাদ্য সরবরাহে প্রত্যেক জনের জন্য ১০ ডলার করে প্রয়োজন। প্রত্যেক রোহিঙ্গা রোগীর জন্য প্রতি বছর স্বাস্থ্যসেবায় ৭৫ ডলার প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষা, পুষ্টি এবং খাদ্যবহির্ভূত আইটেমের জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রোহিঙ্গাদের বাঁচাতেও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে।

নোট : ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নানা প্রকার ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। যেমন মাদক ব্যবসা,লুটপাট,হত্যা,ধর্ষণ সহ সকল প্রকার অপকর্মে নির্দ্ধিধায় রোহিঙ্গা নারী পুরুষ সমুলে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশের প্রভাবশালী দলের নেতাকে রোহিঙ্গা দ্বারা হত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশের স্থানীয় মানুষদের ঘর বাড়ি দখল করে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, এরা যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠছে, পরতর্তিতে এরা বাংলাদেশের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কক্সবাজার এলাকাকে নিজেদের আলাদা রাজ্য হিসেবে পেতে দাবি না করে বসে। এই মানবিকতা যেনো বাংলাদেশের জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায় ।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours