প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
"যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা"
' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর '
সোহাগের সঙ্গে রাগ মিশেই তো ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসার পরিধি যে বিস্তৃত। অলিন্দ থেকে নিলয় জুড়ে থাকে মালিকানাহীন প্রাণ। ভালোর আধারে নিজেকে মালায় গেঁথে তারার আলো। এখানে তো পাওয়ার কিছু থাকে না। সমর্পণে আমি সঁপেছি হৃদয়। চন্দন সুখ ভালোবাসায় ভালোবাসা তো পুজো। হৃদয়ের গভীরে সত্যের মালা গেঁথে, যদি পরিয়ে দি, তবে সে তো আরতি হয়।
আকাঙ্ক্ষার দ্যুতি টেনে জীবন ফুরিয়ে যায়, কি থাকে কামনার শরীরে। কতোটুকু ক্ষণ থাকে, শরীরের অঘ্রাণ!! শরীর তো নিমিত্তে কেবল ক্ষণের অনুরাগ৷ পূর্ণ জোছনার তেজ তো ১৫ দিনও স্থায়ী নয়, তাই তাকে শরীরী বিজ্ঞানের ক্লাইমেক্সে ফেলে কি বেঁধে ফেলা সম্ভব!! জীবন তো নদী, তরঙ্গ ছুঁয়েই প্রেম ভিজে যায়, তবু পথচলা৷।
কিন্তু, সমর্পণ কি? কাকে বলে এই ভালোবাসার পূজা!!
আমরা পরম্পরার স্রোতে নিঃসার খোলসে সমর্পণ করে বসি, আর নিরর্থক খোলসে শীল সদাচার কখনই সম্ভব নয়৷ তবে কি আমরা সত্যই সমর্পণ করতে পারি না? হ্যাঁ, খুব কম পারি। কারণ সমর্পণ চিত্তকে একাগ্র করে, একটা বিন্দুতে একনিষ্ঠ হতে সাহায্য করে৷ শুদ্ধ সারের আমি এক একক প্রতীকী দেখেছি। যদিও আজ তিনি পৃথিবীতে প্রকট ভাবে পঞ্চভূতে নেই, কিন্তু কায়া হীন ভাবেও আজও "সমর্পণের মূল্য " দিয়ে চলেছেন। আসলে সার্থক আসক্তিহীনতাই সমর্পণের ধর্ম৷ ঈশ্বরের বুকেও সেই সমর্পণ সম্ভব। ধর্ম মানে সর্বমঙ্গল সাধনা, আর সেখানে আলংকারিক উপাদান হিসাবে নামকরণ যেমন,বেশভূষা, অহংকার, দম্ভপূর্ণ নিরর্থক বাহ্যাচার নিঃসার।
আজ সমর্পণ বলছি বলে একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি। আমাদের বীরভূমের আশ্রমে আমি এক গরীব চাষীকে কাজ করতে দেখতাম। কিন্তু ভদ্রলোক সারাদিন যাই করুক সে কোনো কিছুতেই মনের শান্তি পেতেন না৷ গুরুদেব ওনাকে ভরিয়ে দিলেও, বিচারে তিনি তার তুল্যমূল্য ভেবে শান্তি তো দূরের কথা - সন্তুষ্ট হতে পারতেন না। মাঝে মাঝেই কলহ, মাঝে মাঝেই মুখের ভাষা খারাপ করে কথা বলতেন। একদিন দেখলাম চাষী যতো অশান্তি করুক না কেন, গুরুর ঘরে ঢুকবেন। আর সেটাও সাত মিনিটের মধ্যে সময় নিয়ে বেরিয়ে আসতেন। আমাদের অনেকের এমন সমস্যা হতো যে, এতো সব সময় অসন্তুষ্ট মানুষ, তাও রোজ নিয়ম করে উনি কেন যান। এই ভাবতে - ভাবতে আমরা একদিন চাষীর সাথে মায়ের ঘরে যাই। দেখি সে ওখানে বকবক করছে আর মায়ের সামনে দূর্বাঘাসের বাটিটা বসিয়ে দিলো। আর বলছে "দেখো মা! তোমায় আমি সমর্পণ করেছি; তোমাকে নিজের কথা, অসন্তুষ্টির কথা বলতে পারি, কিন্তু তোমার পথ্যি দিতে ভুলবো না "। আমাদের চোখ ভারী হয়ে আসে, এখানেই তো সমর্পণ। তার নিজের বিকার নিজের, অন্যদিকে সে সমর্পণ কে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
আবার সমর্পণ বুদ্ধের৷ বুদ্ধ হবার পূর্বে তার চন্দন প্রলেপে মন এক করে সমর্পণে আছে পথ। দেহ তো অনিত্য, আর অনিত্য বিষয়ে মনোনিবেশ কেন? তাই সত্য মার্গ দর্শনেই তাঁর সমর্পণ। যার কাছে পাবার কিছু নেই, শুধুই দেওয়ার৷ সমর্পণের তো আলাদা নাম থাকে না, কারণ যাতে সম্পৃক্ত হওয়া যায় - তাতে বাঁচা যায়। লক্ষ্য যখন স্থির তখন কায় - মনো - বাক্য জুড়ে তাঁর অবস্থান। সৎ পথেই তো শুদ্ধি, তাই উপলব্ধি সার্থক হোক উন্মূলন হোক বোধের - অসারতার বিনাশ হোক.. মঙ্গল আর কল্যাণার্থে আসুক সমর্পণ। ভালোবাসা শূণ্যতার চাঁদ নয়, আসুক পূজা.. আড়ম্বরহীন সমর্পণের নাম ভালোবাসা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours