মণিজিঞ্জির সান্যাল, লেখিকা, শিলিগুড়ি:
আজ আমার জ্ঞানদানন্দিনীর কথা খুব মনে পড়ছে। মাত্র সাত বছর বয়সে মহর্ষি পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন তিনি।দেবেন্দ্রনাথের মেজো ছেলে সত্যেন্দ্রনাথের জীবন সঙ্গিনী । প্রথম ভারতীয় আই সি এস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি তাঁর লজ্জাবতী বালিকাবধূটিকে সব বিষয়ে ভারতীয় নারীর আদর্শ করে তুলতে চেয়েছিলেন।
জ্ঞানদানন্দিনী পুতুল খেলার ঘর সাজাতে সাজাতে নিজেই এক দিন মোমের পুতুলটি সেজে ঢুকে পড়লেন রাজবাড়ির বিরাট বিশাল ঠাকুরবাড়িতে।মাথায় এক গলা ঘোমটা । সেই ঘোমটাখানি হয়তো সন্তর্পনে দু হাতে তুলে ধরে ভীতা - চকিতা হরিণীর দুটি কাজলটানা ব্যাকুল চোখে বারবার পথ খুঁজে ছিল পিছন ফিরে চাওয়ার, বলা বাহুল্য পায় নি। ঠাকুরবাড়ির কোনো বউ তার পূর্ব জীবনের সংস্কার মনে রাখতে পারেনি। কিন্তু এগিয়ে যাবার জন্যে নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। সে এক ইতিহাস...............
বিলেতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দেখলেন স্বাধীনচেতা বিদেশিনীদের। ঘরে, বাইরে তাদের সাবলীল সুন্দর জীবন। তিনি ভাবলেন কোথায় তাদের তো কোনো ছন্দ পতন ঘটছে না ? তাহলে যে মেয়েরা " জীবন - উদ্যানের পুষ্প " তাদের আলো- বাতাস থেকে বঞ্চিত করে ঘরের মধ্যে শুকিয়ে মারলে " কি মঙ্গলের সম্ভাবনা " ?
সতেন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন যে তাঁর স্ত্রী এসেছেন কালাপানি পাড়ি দিয়ে বিলেতে।তাঁর আদরের ' জ্ঞেনুমণি ' যাঁকে বরণ করে নিয়েছেন , স্বয়ংবরা হয়ে সকলের মধ্যে বেছে নিয়ে তাঁকেই আবার পরিয়ে দিচ্ছেন প্রেম- পারিজাতের বরণ মালা। শুরু হল স্ত্রীকে গড়ে তোলার সাধনা।লেখা চলল চিঠির পর চিঠি ।
" তোমার মনে কি লাগে না আমাদের স্ত্রীলোকেরা এত অল্প বয়সে বিবাহ করে যখন বিবাহ কি তাহারা জানে না। তোমার বিবাহ তো তোমার হয় নাই, তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা তোমাকে কেবল দান করিয়াছেন। " সাগর পার থেকে আসা চিঠি জ্ঞানদানন্দিনীকে শোনায় নতুন খবর, তাঁর বুক কাঁপে, কি বলতে চায় চিঠি, " তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক , শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে , সে পর্যন্ত আমরা স্বামী- স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না। "
এসব কথার অর্থ কী , পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় নিরালা ছাদে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ভাবতেন জ্ঞানদানন্দিনী। তখন তাঁর বয়স তেরো বছর।
জ্ঞানদানন্দিনীর সাধনার নেপথ্য ইতিহাসটি খুব পরিস্কার নয়।সবাই জানি , তিনি স্বামীর স্বপ্নকে সফল করেছিলেন।কিন্তু কি সেই স্বপ্ন ? মেয়েরা পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন শিক্ষায় যোগ্যতায় সমমর্যাদা নিয়ে , এই তো ? আজকের দিনে এর গুরুত্ব অনুভব করা শক্ত। জ্ঞানদানন্দিনী যা করেছেন তা হয়তো খুব কষ্টকর নয়, কিন্তু প্রথম কাজ হিসেবে অসম্ভব রকমের কঠিন । ঘরে বাইরে প্রচুর সমালোচনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে।
তিনিই প্রথম বাঙালিনী যিনি প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ,শুধু কি বাড়ির বাইরে ? তিনি একা দু তিনটে শিশু নিয়ে বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন । যেখানে একা যেতে ছেলেদেরও বুক কাঁপে। কালাপানি পার হয়ে বিলেত যাওয়া সেকি মুখের কথা ??????
তিনি শুধু মেয়েদের পথের কাঁটা ঘুচিয়েছিলেন তা নয় , পুরুষের মনের বাঁধা ও অনেকটা দূর করেছিলেন। বাকিটা ইতিহাস তা নিয়ে আর একদিন না হয় আলোচনা করবো....
Post A Comment:
0 comments so far,add yours