স্বাতী রায় লেখিকা ও চিত্রগ্রাহক, কলকাতা:
যদি কোনো শীতের ভোরবেলা ময়দানে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো যায়, তবে কুয়াশার চাদর কাটিয়ে গোল থালার মত সূর্য ওঠা দেখতে পাওয়াটা নির্ঘুম রাত কাটানো বা প্রতিদিনের অফিসের পেষণ ভুলিয়ে দেবে এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। শুধু তাই কেন? গরমের দুপুরে ঘামতে ঘামতে আকাশে মেঘের আলপনা দেখতে গিয়ে কখনওই কি এক পলকের জন্য থমকে দাঁড়াননি? না দাঁড়ালে এবার দাঁড়ান। অনেক তো ছুটে বেড়ালেন। অফিস, বাজার, বসের চোখ রাঙানি, টার্গেট প্রেশার, নিজের প্রেশার, বাচ্চার স্কুল, বরের ধমক, ঘরের চমক ইত্যাদি নিয়ে মুখ তুলে নিজের শহরটাকেই ভালো করে দেখা হয়ে ওঠে না। কোনদিন এই সব নিত্যকার রুটিনের মধ্যেই টুপ করে ঝরে যাবো তা কে জানে? তাই হিল্লিদিল্লী সিঙ্গাপুর ব্যাঙ্ককের পাশাপাশি দু এক ঝলক আমাদের মায়াবী শহরটাকেও প্রাণভরে দেখি? নতুন করে দেখা যাক, আমাদের তিলোত্তমা কে, গন্ধে বর্ণে রূপে অতুলনীয়া আমাদের কলকাতা।
কলকাতা শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে আজ বলবো না, সবাই মোটামুটি জানেন। অনেকেই যেটা জানেননা বা খেয়াল করেননি তা হল গন্ধ। গন্ধ দিয়ে এই শহরটা চেনাযায়। এই যেমন ধরুন সাউদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে প্রথম পাঁচ নম্বর বাসে করে গেলে প্রথমেই নাকে আসবে নানান গাছের গন্ধ, জলের গন্ধের সাথে মিশে কৃষ্ণচূড়া -রাধাচূড়া -জারুল ফুলের গন্ধ। বছরের বিভিন্ন সময়ে গাছের গন্ধও পালটে পালটে যায়। এর পর লেকমার্কেটে ঢুকলে প্রথমেই পাবেন দক্ষিণে মশলাপাতি আর ফুলের গন্ধ - মূলতঃ রজনীগন্ধা। এটা সময় অনুযায়ী বদলায়, সকালে কফির গন্ধ পেলে বেলা বাড়ার সাথে ইডলি সম্বরের সাথে ফুলের গন্ধ। হাজরা মোড় কাছে আসতে কচুরি ভাজার গন্ধ, বিকেল অবধি। এগিয়ে চলুন জগুবাজার হয়ে এলগীন- সদনের দিকে। জগুবাজারে কাঠের খাট আর নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ। পার্কস্ট্রীট পেরিয়ে মেয়ো রোডের দিকে ঢুকলে আবার সেই গাছের গন্ধ তবে এখানে জলের গন্ধ মিশে থাকবে না সাউদার্ন অ্যাভিনিউয়ের মত। আর যদি এসপ্ল্যানেডের দিকে যান তাহলে পোড়া ডিজেলের সাথে দুধে ফোটানো চায়ের গন্ধ পাবেন। বিবিডি বাগে ভোর বেলা ম'ম করে সদ্য ছাপানো খবরের কাগজের গন্ধ, বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা বদলে হয়ে যায় নানান খাবারের গন্ধ। কলকাতার ওপেন বুফে কিনা। বড়বাজার আসতে সকালে তেল সাবানের গন্ধ, পথের পাশের নল দিয়ে বেরিয়ে আসা গঙ্গার জলে স্নানরত ফুটপাথ বাসীদের দান। হাওড়া ব্রীজে ওঠার মুখে ফুলপট্টি তখন গাঁদাফুল বেলপাতার গন্ধ নিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
কোনো এক মন উদাস করা দুপুরে আচমকাই যদি ময়দান পৌঁছে যান, লালে লাল ময়দান আপনাকে আসন পেতে দেবে শিমুল ফুলের, কোনো এক দেহাতি গায়ক তখন ঢোলক বাজিয়ে আপন মনে তান ধরেছে। সঙ্গী এক বৃদ্ধ চাওয়ালা আর আমার মতই কিছু ভবঘুরে। এই ময়দানে যদি শেষ ফেব্রুয়ারির সন্ধায় বসে থাকেন তাহলে রেডরোডের ক্যাকোফোনি কানে আর অসহ্য ঠেকবেনা দখিণা বাতাসের আলতো আদরে ভেসে আসা বাতাবীলেবু ফুলের গন্ধে।
উদাস মন নিয়েই হাঁটতে হাঁটতে যদি পৌঁছে যান যে কোনো একটা ঘাটে, ঝিমন্ত সারেং ভোঁ বাজিয়ে গুটিকয় লোক নিয়ে লঞ্চ ছেড়ে আপনাকে গঙ্গার ওপাড়ে যে কোনো একটা ঘাটে পৌঁছে।দেবে। মাঝ নদী থেকে দেখুন দুপাশে যেন দুবাহু বাড়িয়ে আগলে রেখেছে দুই সেতু। এক দিকে বিদ্যাসাগর, অন্যদিকে রবীন্দ্রসেতু।
বিরহী প্রেমিক, নতুন যুগল, ক্ষ্যাপা, গায়ক, বেলুন ওয়ালা, ফুচকাওয়ালা সবাই মিলে পড়তি বিকেলের প্রিন্সেপঘাটে আপনাকে একলা হতে দেবে না। আর যদি দোকা থাকেন, তাহলে তো স্কুপ আছেই, মনোমত আইসক্রিম খেয়ে সারা দিনের বেড়ানো উদযাপন করে তাঁর হাতটি ধরে গুটিগুটি বাড়ি ফিরে আসুন।
আর যদি আরোও ক্ষ্যাপামো করতে মন চায় তাহলে রাত বারোটার পর চলুন নিমতলা ঘাটে। মহাশ্মশান পেড়িয়ে আরএকটু গেলেই ভুতনাথের মন্দির, বিশাল বটগাছের তলায়। তার পাশের ঘাটে একদম শেষ সিঁড়িতে নেমে যান, দেখবেন সত্যিই এখানে অখণ্ড শান্তি। বয়ে চলা নদীর কুলুকুলু আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না তখন। ওপাড়ের কারখানার আলোগুলোও তখন আধোঘুমে টিমটিম করে প্রতিফলিত হচ্ছে বহতা গঙ্গার জলে। আচমকা হরিবোল বা রামনাম সত্য হ্যায় শুনলে চমকে যাবেন না। এ জগতে সবই মায়া, এই মুহূর্ত গুলোই কেবল সত্য - বেঁচে থাকার রসদ...
Post A Comment:
0 comments so far,add yours