কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"মেরে সপনো কী রানি কব আয়েগি তু!"
স্বপ্নে দেখা রানির মুখটা, ঘুম ভাঙার পর মনে করতে পারেন তো?
অনেকেই কিন্তু পারেন না।

আবার সেদিন তো যেন খুশিতে ডগমগ হয়েছিলেন।
"এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আমি
মাটিতে যে আজ স্বর্গ এসেছে নামি!"
স্বপ্নসফরে সে রাতে নিশ্চয়ই ভূস্বর্গ কাশ্মীরে গেছিলেন। বিনি পয়সার ট্রিপ। স্বপ্নেই মোলাকাত হয়ে গেল স্বপ্নসুন্দরীর সঙ্গেও। স্বপ্ন মানেই রঙিন। কিন্তু এই রং কেমন হয় জানেন? সফট প্যাস্টেল রংয়ের মতো। আবার আমাদের মধ্যেই আছেন এমন কিছু অভাগা মানুষজন, যাঁদের স্বপ্ন বর্ণহীন। আবার ভ্যালেট সাহেব বলছেন, এঞ্জিনিয়ার প্রযুক্তিবিদদের মতো কাঠখোট্টা মানুষদের নাকি স্বপ্ন দেখা মানা। তাহলে ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার বাবুরা? শেয়ার বাজারের দালালরা? এঁরা সবাই স্বপ্নসুখ থেকে বঞ্চিত?

তবে সাধু সাবধান, স্বপ্নপুরীর অভিজ্ঞতা কিন্তু সবসময় একরকম হয় না। কখনও আনন্দে আত্মহারা, তো কখনও ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া।  মাঝপথেই ঘুম ছুটে যায় আতঙ্কে। ঘামে জবজবে গা। ভিজে বালিশ। ঢকঢক করে বোতল থেকে গলায় ঠান্ডা জল ঢালা। ফ্যানের স্পিডটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। তবু গা ছমছম যেতেই চায় না।

ভয় পাবেন না। স্বপ্নের সাধ্য নেই আপনাকে বিপদে ফেলার। বিপদের পূর্বাভাস? তাও অসম্ভব। তবে ভাবার চেষ্টা করুন ভয়ের স্বপ্ন কেন দেখছেন। শারীরিক কোনও অসুস্থতা, উদ্বেগ, এমনকি কোনও ওষুধ থেকেও এধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। আর কিছু বুঝে উঠতে না পারলে, চিকিৎসকের কাছে যান। সমস্যা দানা বেঁধেছে আপনার মগজে।

আবার উল্টোটাও হয়। ঘুম ভাঙলেও কাটতে চায় না মিষ্টি স্বপ্নের রেশ। মনে হয় বেশ তো চলছিল। ফের চেষ্টা করলে ঘুম এলেও আসতে পারে। তবে ওই স্বপ্নের দ্বিতীয় পর্ব নৈব নৈব চ। আবার অনেক সময় ঘুম ভাঙে মন খারাপ নিয়েই। প্রাক্তন বা প্রাক্তনী সামনে এসে দু হাত বাড়ায়। আর ঠিক তখনই ঘুম ভাঙে  কলিং বেলের আওয়াজে। ময়লা নিতে এসছে। ঘড়িতে ততক্ষণে সকাল সাতটা। অপার্থিব জগতের যাত্রাভঙ্গ। কিন্তু স্বপ্নরাতের সফরে গিয়ে দেখলেনটা কী, মনে আছে?
নেই। কারণ তর্ক, যুক্তি, বিশ্লেষণ ছাড়া আর কোন কিছুই আপনার মাথায় ঢোকে না। প্রযুক্তি, এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আপনার কারবার। তাই যদিও বা কখনও স্বপ্ন দেখেই ফেলেন, তা মগজে জায়গা পায় না।

তবে স্বপ্নের কথা যদি মনে নাও রাখতে পারেন, ঘাবড়াবেন না। ওটাও মগজের স্বাভাবিক কাজকর্মের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু যখন স্বপ্ন দেখার মাঝেই দুম করে ঘুম চটে যায়? সেই স্বপ্ন ভালো হোক কী মন্দ, তার রেশ যেন ঘুমভাঙার পরেও একদম টাটকা। শরীর মন জুড়ে ভর করে থাকে সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন। ব্যাপারটার ভারী সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার স্নায়ুবিজ্ঞানী রাফায়েল ভ্যালেট।
"যেন জলের তলা থেকে আচমকাই, আকাশের তলায় চলে এলেন। আর স্বপ্নের স্মৃতি যেন হাতের মুঠোয় ধরা ঝুরঝুরে বালি। সমানে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছে। হাতের মুঠোয় সেই বালি নিয়েই, ফের জলে ডুব মারার চেষ্টা করে চলেছেন আপনি। কিন্তু কিছুতেই পারছেন না।"

"স্বপন যদি মধুর এমন
হোক সে মিছে কল্পনা
জাগিয়ো না, আমায় জাগিয়ো না!"

তবু কিছু মানুষ স্বপ্নের কথা মনে রাখতে পারেন। অনেকেই  পারেন না। গোটা ব্যাপারটাই একেকজনের বেলায় একেকরকম। কারণ প্রত্যেকের মগজ আলাদা। তার কাজকর্মও আলাদা।

কিন্তু কয়েক হাজার বছর আগে সত্যিই এরকম এক সম্প্রদায় ছিল, যারা জানতোই না স্বপ্ন গায়ে মাখে নাকি মাথায়। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস লিখছেন, উত্তর আফ্রিকার অ্যাটলাস পর্বতের এলাকায় বাস বলে, ওই সম্প্রদায়ের নাম ছিল অ্যাটলান্টিস। নিরামিষাশী, স্বপ্নহীন ওই মানুষরা কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আধ্যাত্মিক, শিল্পকলা সবদিক দিয়েই আকাশছোঁয়া উন্নতি করেছিল। গবেষকদের কাছে আজও এই ঘটনা এক বিস্ময়ের বিস্ময়।

এর ঠিক উল্টো গল্প একজন শিল্পী, সৃষ্টিশীল মানুষের বেলায়। তাঁদের জীবন মোটেই ছকে বাঁধা নয়। নিত্যনতুন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতেই তাঁরা ভালবাসেন। ভালবাসেন স্বপ্ন দেখতে। আবার ঘুম ভাঙার পরেও স্বপ্নের কথা মনে রাখতে পারেন। দাবি রাফায়েলের।
স্বপ্ন দেখার সবচেয়ে ভালো সময় মানুষ যখন গভীর ঘুমে প্রায় অচৈতন্য। সেসময় বিশ্রাম নেয় মগজের সামনের দিকের ফ্রন্টাল লোবস। এই অংশের দায়িত্ব স্মৃতি সংরক্ষণ করা। তবে সেটা তখনই হয়, যতক্ষণ মগজের মেডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কোরটেক্সে, পর্যাপ্ত মাত্রায় হোয়াইট ম্যাটার থাকে। ঘুম ভাঙার ঠিক আগের মুহূর্তে ফ্রন্টাল লোবসও যেন জেগে ওঠে। তাই ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখলে, তা মনে থেকে যেতেও পারে। তবে মগজ অতিমাত্রায় সজাগ থাকলে, অনেক সময় মজার ঘটনাও হয়। তখন মনে হয় যেন জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছেন। আধো ঘুম আধো জাগরণ। গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন, লুসিড ড্রিম।

সপ্তাহে ঠিক ক'রাত স্বপ্ন দেখেন? গড়পরতার হিসেবে, দু- তিন রাত। এই স্বপ্ন দেখেন হোয়াইট ম্যাটারের কলকাঠি নাড়াতেই। মগজকে কম্পিউটার বলে ধরে নেওয়া হলে, এই হোয়াইট ম্যাটারের ভূমিকা কেবলের। যা বিভিন্ন অংশের সমন্বয় করে, মগজে জরুরি তথ্য জোগান দেয়। আর যাবতীয় তথ্যকে প্রসেসিং করে গ্রে ম্যাটার। মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণের রাস্তায় এগোলেই সমাধান করে ফেলা যায় মগজরহস্য। চেনা যেতে পারে মুখোশের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা মানুষটাকেও, মত রাফায়েল ভ্যালেটের।

একটা মজার খেলা খেলতেই পারেন। সকালে উঠেই স্বপ্নের কথা লিখে রাখুন। যতটা মনে থাকে ততটাই। পরপর কয়েকদিন এরকম করলেই দেখবেন, দ্বিতীয় রাতের স্বপ্নের সঙ্গে অষ্টম, অথবা চতুর্থর সঙ্গে দ্বাদশ রাতের স্বপ্নের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। আবার তার সাদৃশ্য থাকতে পারে কোনও বাস্তব ঘটনার সঙ্গেও। অনেক সময় সেই ঘটনা লজ্জাজনক হলেও হতে পারে। তবে তা দিয়ে ভুল করেও, নিজেকে বিচার করতে যাবেন না।

নানা স্বপ্নের নানা ব্যাখ্যাও আমরা দিয়ে থাকি। এটা শুভ, ওটা অশুভ। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো গল্পটা হলো গোপাল ভাঁড়ের। রাজা স্বপ্ন দেখলেন, তিনি ফোকলা হয়ে গেছেন। অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র একটা দাঁত। পন্ডিত মশাই স্বপ্নবিচার করে জানালেন, মহারাজের বংশে বাতি দেওয়ারও কেউ থাকবে না। তবে ওই একটি দাঁত থাকা মানে, মহারাজ বেঁচে থাকবেন। পন্ডিতের কথা শেষ হতে না হতেই খেপে লাল মহারাজ। তলব করা হলো গোপালকে। তিনি গম্ভীর মুখে সব শুনেটুনে বললেন, "জয় মহারাজের জয়। রাজবংশের মধ্যে আপনিই দীর্ঘজীবী রাজন।" নিজের দীর্ঘায়ু হওয়ার কথা শুনে রাজার রাগ গলে জল।

তবে দু এক ক্ষেত্রে স্বপ্ন যেন সত্যিই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। গবেষকদের মত, নেহাতই সংযোগ। ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি! ভুলভাল কিছু স্মৃতি, কিছু বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিলেমিশে এক বিভ্রান্তি। গোটা ঘটনার নেপথ্যে থাকে অবচেতন মনের সূক্ষ্ম কারসাজি।
অধিকাংশ গবেষক এ ব্যাপারে এখনও একমত। স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের বাস্তব চিন্তা ভাবনা, এমনকি আবেগেরও সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। "স্বপ্ন আসলে অবচেতন মনের জানলা।" বলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। "সমাজের নীতি পুলিশের খবরদারিতে আমরা বেশকিছু কামনা,  বাসনা চেপেচুপে রাখতে বাধ্য হই। সেগুলো সুপ্ত হয়ে ঘর করে মনের কোটরেই। স্বপ্নে আমরা সেই অতৃপ্ত কামনা, বাসনা মেটানোর চেষ্টা করি।"
ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়ালো? দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।

স্বপ্ন মনে রাখার ব্যাপারে কিন্তু মেয়েরাই এগিয়ে। শুরুর দিকে কমবয়সী ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনও তফাত থাকে না। তবে কিশোর অবস্থা পেরোলেই, পার্থক্য চোখে পড়ে। ফারাক থাকে টিনএজ ছেলে, মেয়ের স্বপ্নতেও। মেয়েরা বকবক করে বেশি। তাদের স্বপ্নেও তাই আড্ডা বসে যায়। অনেক চরিত্রের সমাগম। স্বাভাবিক ভাবে স্বপ্ন টানেও বেশি সময়। অনেকগুলো মেয়ে থাকবে আর সাজগোজের কথা থাকবে না, তাও কী হয়! স্বপ্নেও কাপড়- চোপড়ার গপ্পো। বেশি আবেগের কথা বলে। 
ছেলেদের দুনিয়া আলাদা। স্বপ্নও আলাদা। গায়ের জোর খাটানো, মারামারি, এমনকি অস্ত্রের ঝনঝনানিও শোনা যায়। সব বেপরোয়া ব্যাপার- স্যাপার। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বপ্ন মনে রাখার শক্তিও কমে আসে পুরুষ নারীর। বদলে যায় ঘুমের চরিত্রও।

কিন্তু মানুষ স্বপ্ন দেখে কেন? গবেষকদের মত, সব ঘুমন্ত  মগজের ফালতু কারবার। নেই কাজ তো খই ভাজ! তবে অনেকেই বলেন, শরীর মন চাঙা রাখতে স্বপ্ন জরুরি। শরীর যখন ক্লান্ত, ঢলে পড়ে নিদ্রাদেবীর কোলে। তখনই আড়মোড়া ভাঙে মন। শুরু হয় তার কল্পলোকের সফর। এমনকি যে মানুষটা চোখে কোন দিন আলো দেখতেই পেলো না, জন্মান্ধ, সেও স্বপ্নের দুনিয়া সাজায়। গবেষকদের ধারনা, শুধু দোপেয়েরাই না, স্বপ্ন দেখে চারপেয়েরাও। ঘুমের মধ্যে কুকুরের লেজ নাড়ানো তো সাধারণ ব্যাপার। এমনকি অনেক সময় চাপাস্বরে 'ঘেউ ঘেউ'ও করে।

সমীক্ষা বলছে, কিছু স্বপ্নের বিশ্বায়ন হয়েছে সেই কোন কালেই। কেউ তেড়ে আসছে, হামলা করছে। ওপর থেকে নীচে 'ধপাস'। পাখনা মেলে আকাশে ওড়া। আবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া। নড়াচড়ার শক্তি হারানো। এই স্বপ্নগুলি সবই নির্ভেজাল সেকুলার আর আন্তর্জাতিক খ্যাত।

তবে স্বপ্ন কিন্তু গবেষকদের কাছে আজও রহস্যময়। সমীক্ষা চলছে সেই সঙ্গে আরও গাঢ় হচ্ছে, তাঁদের কপালের ভাঁজ। ওদিকে গবেষকদের এই হাল দেখে মুচকি হাসছেন হলিউডের জগদ্বিখ্যাত স্বপ্নসওদাগর। "আমি রাতে স্বপ্ন দেখি না," বলছেন 'জুরাসিক পার্ক'- এর পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ। "স্বপ্ন দেখি দিনের আলোয়। সারাদিন স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি বেঁচে থাকার জন্য।"
"ঘুমিয়ে যা দেখ, তা স্বপ্ন না।" বেশ জোরের সঙ্গে একথা বলেছিলেন ভারতের 'মিসাইল ম্যান', প্রাক্তন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম। "স্বপ্ন হচ্ছে সেই জিনিস যা তোমার ঘুম কেড়ে নেয়।"

এবার আপনি ঠিক করুন, রাতের ঘন অন্ধকারে স্বপ্ন দেখবেন, নাকি দিনের ফটফটে আলোয়। আপনার সেই স্বপ্ন শেয়ারের অপেক্ষা করবে গোটা বিশ্ব। তবে দেখবেন, গোটা ব্যাপারটাই যেন শেষ পর্যন্ত 'দিবাস্বপ্ন' হয়ে না দাঁড়ায়।

(তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন ডাক্তার সোহিনী মুখার্জি চক্রবর্তী)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours