জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

আত্মজীবনী লিখেছেন 'ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত' শিরোনামে। তাঁকে নিয়ে ব্রাত্য বসু রচিত ও নির্দেশিত নাটক ব্রাত্যজনের 'রুদ্ধসঙ্গীত'।

রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এর একটি ভাড়া বাড়ির একতলার অগোছালো ঘরে থাকতেন এই অকৃতদার মানুষটি। হারমোনিয়াম ও গুটিকতক বই ছাড়া ঘরে আর প্রায় কিছুই ছিল না।

ঋষিতুল্য জীবনচর্যা...হাপানির কষ্টে ইজিচেয়ারে বসেই কেটে যেত বিনিদ্র রাত...

রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্ম ব্রাহ্ম সমাজে। দেবব্রতরও তাই। সেই কারণে বিশ্বাস করতেন - রবীন্দ্র সঙ্গীত তাঁর বড়ভাই, যার সঙ্গে পরিচয় শৈশবে...মায়ের কোলে বসে।

তাঁর গান নিয়ে বলা হয়েছিল - excessive music accompaniment hampers the sentiment of the song. বৃদ্ধ বয়সে এসে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় অনেক পেছনে থাকা কারো কাছ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের sentiment শিখতে রাজি হন নি।রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন...এক বিন্দুও আপোষ করেন নি...আত্মমর্যাদায় আটকেছে।

IPTA র দিনগুলি ছিল বাংলা সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ... দেবব্রত-হেমন্ত-সুচিত্রা-সলিল-হেমাঙ্গ-বিনয়-শম্ভু -তৃপ্তি-বিজন-জ্যোতিরিন্দ্র-উৎপল-শোভা-খালেদ-ঋত্বিক-মৃণাল... কে ছিলেন না সেখানে। সেখানেই সলিল চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ঠতা। বহু গণসংগীত,  এমন কি অবাক পৃথিবীর মত গান মাঠে ময়দানে গেয়ে তিনিই জনপ্রিয় করে তোলেন। কিন্তু তিনি HMV র শিল্পী না হওয়ায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সলিল গানগুলি দেবব্রতকে দিয়ে রেকর্ড করাতে পারেন নি, হেমন্তকে দিয়ে করিতেছিলেন।
মাঝে মাঝেই সন্ধ্যাবেলায় দরজায় এসে দাঁড়াতেন ঋত্বিক ঘটক। নাছোড়বান্দা আবদার,
- জর্জদা দশটা টাকা দাও, মদ খাবো।

এই মানুষটির জেদের কাছে হার মানতে হতো তার জর্জদাকে। প্রিয়জনদের কাছে দুঃখ করতেন এমন একটি অসাধারণ প্রতিভা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে।

ঋত্বিকের প্রয়াণের পরে তার স্মরণসভার আমন্ত্রণ নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন দেবব্রতর কাছে। দেবব্রত যাননি। প্রবল অভিমানে বলেছিলেন, 'আমারে না বইলা কইয়া চইলা গ্যালো। অর স্মরণসভায় আমি যামু না'।

শেষের দিকে দেবব্রত একবার বম্বেতে সলিলের বাড়িতে গিয়ে মাসখানেক ছিলেন। সলিলের পিয়ানোটি দেবব্রতর খুব প্রিয় ছিল। দেবব্রত দোতলায় বসে উদাত্ত কন্ঠে গাইতেন আর সলিল পিয়ানোয় সঙ্গত করতেন। সেই অপূর্ব দৃশ্য অনুভব করার জন্য রাস্তায় ভিড় জমে যেত। 

আমি ছাত্র বয়সে একবার সলিল চৌধুরীর  interview নেবার চেষ্টা করেছিলাম...ওনার 'আকাশদীপ'  ফ্লাটে গিয়েছিলাম ...উনি ছিলেন না...পরে ফোনে কথা হয়েছিল...উনি রাজী হয়েছিলেন ...কিন্তু তখনই ওনার চোখে একটি অপারেশন হয়... আমার দুর্ভাগ্য  কিছুদিন পরই উনি প্রয়াত হন।

IPTA এর হয়ে গণচেতনা উদ্বুদ্ধ করার জন্য দীর্ঘ দিন গ্রাম বাংলার মাঠে ময়দানে অনুষ্ঠান করার পর দেবব্রত বুঝতে পারেন যে এভাবে পরিযায়ী হয়ে গণচেতনা উদ্বুদ্ধ করা যায় না। এটি করতে গেলে তাদের মধ্যেই সারাবছর থেকে কাজ করতে হয়, এক দু'দিন অনুষ্ঠানে কিছু হয় না। কলকাতায় চাকরি করার জন্য সেটি সম্ভব হয় নি। তাই সে পথ ছেড়ে দেন।

যৌবনকালে বিশ্বাসে বামপন্থী ছিলেন। আত্মবয়ানে কোথাও নেই তবে অনেকেই মনে করেন যে পরিণত বয়সে কোথাও কোনও না কোনও ঈশ্বরের প্রতি গভীর আত্মসংযোগ না রচিত হলে ওনার পক্ষে ঐ ভাবে গান গাওয়া সম্ভব হতো না। 'প্রভু আমার প্রিয় আমার ' এর মত গানের expression ও modulation এ ধীরে ধীরে যে পরিবর্তন এসেছে তা এই ভাবনার উজ্জ্বল সাক্ষ্য।

বাঙালীরা সাধারণভাবে 'ঢ়' এর উচ্চারণ করতে পারেন না। চেষ্টা করলেও সেটি কার্যত 'ড়' ই হয়ে যায়। দেবব্রত একজন বিরল ব্যক্তি যিনি স্পষ্টভাবে 'ঢ়' এর উচ্চারণ করতে পারতেন ।

সবসময়ই প্রেক্ষাগৃহের আলো জ্বেলে দিয়ে গান করতেন যাতে শ্রোতাদের সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ যোগাযোগ তৈরি করা যায়। আগে থেকে গান তৈরি করে আনতেন না। একবার দুটি ছেলেমেয়ে একসাথে বসে গান শুনছিল। কিছু মনোমালিন্য হওয়াতে তারা দু'জন দু'দিকে গিয়ে বসল। দেবব্রত তাই দেখে গান ধরলেন 'কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এসো কাছে'। লজ্জা পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটি আবার পাশাপাশি এসে বসল।

আরও একবার তার গানের কঠোর সমালোচক আনন্দবাজারের বার্তাসম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষ এসেছেন গান শুনতে। দেবব্রত গান ধরলেন ' কেন তোমারা আমায় ডাকো'। গানটির সঞ্চারী অংশে গিয়ে সন্তোষ কুমারের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বারবার গাইতে লাগলেন - 'দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি নিইনে কানে ; মন ভেসে যায় গানে গানে'।

বিডন স্ট্রিটে অনুষ্ঠান। শুরুর আগেই প্রবল ঝড় বৃষ্টি। রাস্তায় জল দাড়িয়ে গেছে, স্টেজ ভেঙে পড়ার জোগাড়, স্টেজের ওপরেও প্রবল বৃষ্টির ছাট। উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠান বাতিলের ঘোষণা করলেন। কিন্তু দেবব্রত বললেন, তিনি ভিজেই গাইবেন। ভিজতে ভিজতেই ধরলেন বরষার গান - 'কোথা যে উধাও হলো'। পলকের মধ্যে রাস্তা জ্যাম হয়ে গেল। বাস চলাচল বন্ধ। হাজার হাজার লোক বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মন্ত্রমুগ্দ্ধের মত সেই গান শুনতে লাগলেন। প্রত্যক্ষদর্শী এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজার গৌতমবাবুর মুখে যখন সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের বর্ণনা শুনছিলাম, তখন ঘটনার চল্লিশ বছর পরেও তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল।             
এই ছিলেন ভারতের পল রোবসন দেবব্রত বিশ্বাস। তাকে নিয়ে অজস্র কাহিনীর কয়েকটি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলাম।

এই শিল্পীর নামে কলকাতায় একটি রাস্তা হয়েছে। আশা করি তার গানের সংরক্ষণ, বাসগৃহে একটি লেখ্যাগার তৈরি ও নামাঙ্কিত একটি অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহের নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হবেন। (শেষ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours