fichar
দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

বুধবার রাত। সকাল সকাল শুয়ে পড়েছি। রাত পেরোলেই আরেকটি স্বাধীনতা দিবস। মনে  করছি ছোট বেলায় যখন বুড়ু, আকাল, সুখেন, পিন্টু, সন্দীপ, রাজীব, উৎপল, খোকন, পথু কাক ভোরে উঠে প্রশানদার সাথে গোটা গ্রাম পরিক্রমা করতাম। গলা মেলাতাম প্রসানদার সাথে-- নেতাজি তোমাই ভুলছি না ভুলব না। রক্তে লেখা দুটি নাম মাতঙ্গীনি, ক্ষুদিরাম। গ্রামের দত্তদের বরিষ্ঠ মহিলা যিনি আর বেঁচে নেই, তার কাছে  শুনেছিলাম , ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাষ্ট কিভাবে গোটা গ্রাম ফেস্টুন আর পতাকায় সেজে ছিল। এই সব ভাবনা নিয়ে প্রাক স্বাধীনতার দিন টান টান উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে ছিলাম। আবৃত্তির সুরে শুয়ে শুয়ে আওড়াচ্ছিলাম--- গোটা বিশ্ব যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তখন মধ‍্য রাত্রের ঘন্টায় ভারত বর্ষ জেগে উঠবে  প্রানে ও মুক্তির আস্বাদে অর্থাৎ স্বাধীনতায়। স্বাধীনতা! স্বাধীনতা নিয়ে লেখাটা তোমার চোখেও পড়েছে? বলে ভাত খাওয়ার পর এক টাকার আজোয়ান প‍্যাকেটের দুই তৃতীয়াংশ মুখে পুরে কাছে এসে বসল গিন্নি। ফ্ল‍্যাগ মিটিংয়ের আশংকা জাগলো মনে। কাগজে পড়েছি আন্তর্জাতিক বর্ডারে এ রকম হয়ে থাকে। আমি বললুম, চোখে পড়বে মানে? এত মুখস্থ। মধ‍্য রাত্রে পার্লামেন্টে... সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। নেহেরুজী আবেগ মথিত গলায় বলছেন।  ভাবলে এখন ও গায়ে কাঁটা দেয়।  কাঁটাটা দুহাত দিয়ে  সরিয়ে খবরের কাগজে লেখা কি একটা দেখিয়ে বলল, আরে না-- সে সব কিছু না। ও: বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।  কানে এলো, আমি বলছিলাম - স্বাধীনতা দেশবাসীর অলংকার! গিন্নির মুখে ঘটা করে দেশ প্রেম! ঠিক বিশ্বাস হল না। তাই জেগে আছি কিনা বুঝতে বিছানায় উঠে বসলাম। বললাম হঠাৎ কি হলো তোমার বলো তো? কাগজ টা হাতে ধরিয়ে একটা কলাম দেখাল-- লেখা আছে স্বাধীনতা দেশবাসীর অলংকার। আপনার জীবন শিল্প নৈপুণ্যে সাজিয়ে তুলতে আজই আসুন-- ৭৩ তম স্বাধীনতা উপলক্ষে আমাদের গহনার দোকান শ্রীনিকেতন রোডে--বিশেষ ছাড়!! ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। ঘড়িতে এখন কিছু বাজল না। যা বাজল আমার বুকে। বুকের মাঝে পেন্ডুলাম টা এদিক ওদিক করতে করতে কখন চোখ লেগে গেছিল জানি না।
দেখছি আমার মাতামহ ঈশ্বর অভয়া পদ ভট্টাচার্যের সাথে আমি মহাজাতি সদনের সামনে। প্রস্তর ফলকে সাল দেখলাম ১৯৩৯ সালের ১৯ অগাষ্ট। অনেককেই চিনি না। একজন বলছেন: বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক। বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক। ভারতের মুক্তি সাধনায় বাঙালি স্বৈর বুদ্ধিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন কারণেই নিজেকে অকৃতকার্য না করে। দাদুকে জিগ্যেস করলাম উনি কে? দাদু কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে একে একে রবীন্দ্র নাথ, সুভাষ বসু সকলকে দূর থেকে চিনিয়ে দিলেন। পথে যেতে যেতে দাদুকে বললাম, আজ বাঙালির এত অপমান কেন? কোথাও জায়গা নেই কেন? যে সময়ে আমি নেই, সেই সময়ের কথা আমি বলতে পারি না। ওটা তোমাদের সময় বিচারের ভার তোমাদের।-- আজীবন কংগ্রেসের সৈনিক দাদু হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। মহাত্মা গান্ধী রোডে একা ঘুরছি তো ঘুরছি।
যাহোক দাদুই আবার হাত ধরে টেনে নিয়ে বললেন, জানিস, সুভাষ বোস আর কংগ্রেসের সভাপতি নেই। বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ। ভালো লোক। কিন্তু দক্ষিণ লবির জন্য মাত্র ৪জন বামপন্থী নেতাকে জায়গা দেওয়া হলো না। তুই কিছুক্ষণ আগে বলছিলিস না। বাঙালির কথা? আমার মাঝে মধ্যে একজন লোকের উপর খুব রাগ হয়। কে দাদু? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। উনি কংগ্রেস সভাপতির পদত্যাগ না করলে   পরিস্থিতি আলাদা হত। হয়ত মুসলিম লীগের অস্তিত্ব থাকত না। ১৯৩৭ সালের প্রথম নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ ও বোম্বাই ছাড়া সর্বত্র  মুসলিম লীগ পর্যদুস্ত হয়। ওদের ইউ পি নেতা চৌধুরী খালিকজ্জামান ও নবাব ইসমাইল খান কংগ্রেসকে আবেদন করে ক‍্যাবিনেট মিশন প্লানে সহযোগিতা করতে ও অংশগ্রহণের আবেদন জানান। কিন্তু মিনিস্ট্রি তে ওই দুজনের মধ্যে একজনকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলে জওহর লাল নেহেরু তাঁদের চিঠি লিখে জানান। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে জিন্না ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্ব খাড়া করে। আজাদ সভাপতি থাকলে এটা হত না। আরেকজন নেতাজি। ভারত বর্ষ  অসাম্প্রদায়িক । নেতাজির গুরু যিনি স্বরাজ‍্য দলের প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন দাশ তিনি কোলকাতা কর্পোরেশনের এক আলোচনায় পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য তখন অধিক মাত্রায় সংরক্ষণের দাবি জানান। ওরা থাকলে লজিস্টিক‍্যালি হিন্দু মুসলিম বলে কিছু থাকত না। যেমন গুরু তেমন শিষ‍্য। ১৫ অগাষ্ট হওয়ায় আজ দেরী করে উঠেছি। গিন্নির স্থিতপ্রজ্ঞ  অবস্থা। হাসি মুখে চিনি ছাড়া র চা দিয়ে জিগ্যেস করলেন ঠিক আছে তো? এর কি কোন উত্তর হয়? বললাম টেস্টি টেস্টি। তারপর গিন্নির ব‍্যবহারে বুঝলাম -- স্বাধীনতা কতটা দেশবাসীর অলংকার বুঝতে বৃহস্পতিবারের বিকেলে শ্রীনিকেতনের গহনার দোকানে আমাকে যেতেই হবে!!!
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours