দেখতে দেখতে দেশের ৭৩ তম স্বাধীনতা দিবসও পেরিয়ে গেল। যে যখন শাসক তখনই তাদের সেকি স্বর্গ নিনাদ দাবি, মেরা ভারত মহান। আর ভোটাররা বড্ড ভুল পথে চালিত হলেন বলে শাসক পরিবর্তিত বিরোধীদের মতৈক্য, ভারত এক ডুবন্ত টাইটানিক। এই সংলাপ দেশের চিরকালের এক রাজনৈতিক সোরাইসিস।
তবু বিশ্বের দরবারে আমার ভারত আজ ডিজিটাল ইন্ডিয়া। সামরিকে আমেরিকা রাশিয়া চীন সমীহ করতে বাধ্য হয়। অর্থনীতিতেও দেশীয় ওয়্যাল বুল যেন তেজী ঘোড়া। তবু বিশ্বাস করতে খারাপ লাগলেও এত কিছুর পরেও আমাদের দেশের কিছু স্বঘোষিত চুলবুল শাহেনশাহ নিজেদের আদিমতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে আজও অক্ষম রয়েই গেল। দেশ ঠিকই স্বাধীন। ভারত বাস্তবিকই স্বনির্ভর। কিন্তু এই চুলবুল হিরোরাই মানসিক দিক থেকে বর্বর ও দেশের কলঙ্ক। এরা নারীজাতির লজ্জা ও করুণার। এদের জন্যই আজও সমাজে কুণ্ঠিত ঋতুমতী মহিলা।
ভাবতেই পারেন ৭৩ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ঋতুমতী নারীর কুণ্ঠার কি আবার আত্মীয়তা? এসব কি বলে চলেছি আমি? আসলে প্রসঙ্গটা বছর দুই আগেকার। চলুন মুল দৃশ্যপটে আসাই যাক।
কোনও একটি তথাকথিত মিডিয়া হাউস। তখন আমি ইনপুট এডিটর হিসেবে সবে কাজে যোগ দিয়েছি। আমারই অধীনস্থ একটি মেয়ে আমার সামনের ডেস্কে বসে কপি এডিটিং করছিল। সঙ্গে নিউজ রিডারের কাজটা বেশ শিখে ফেলেছে। একেবারে নিজস্ব চেষ্টায়। বেশ ঝকঝকে চেহারাটা। খুবই মিশুকে। মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। কাজের ফাঁকে রাগাতাম ওকে। কিপটে বলে। এখন সে প্রতিষ্ঠিত এক নিউজ চ্যানেলের খুবই পরিচিত মুখ। নামি সংবাদ পাঠিকা।
মাত্র দু’দিন আগের কথা। সেদিন বিকেলে সে জানায় তার মা হাসপাতলে ভর্তি। মুখটা ছিল খুবই থমথমে। মাথা নিচু করে অনুরোধ করলো, ঘন্টাখানেক ছুটি দরকার। অসুস্থ মাকে ওষুধ কিনে দিতে হবে যে। তৎক্ষণাৎ আমি তাকে হেসে বলি, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মায়ের কাছে যা। আর কোনও দরকার হলে এই দাদাটাকে বলিস।
ঠিক দিন দুই পরে আবার মেয়েটি আমাকে ডেকে বললো, সুবীরদা, একটা পার্সোনাল কথা ছিল। তখন ঘরিতে বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই। সবে অফিসে ঢুকেছিলাম। সে কিন্তু আমার অনেক আগেই হাজির। তবু ওর মুখ দেখেই মন হলো বেশ চিন্তিত। এবং আরষ্ঠও। যেন আমারই জন্যই অপেক্ষা করছিল। কোনওরকমে। অফিসে কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ সহকর্মী ইতিমধ্যেই উপস্থিত। সবাইকে দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি বললাম, বল কি বলবি? মেয়েটি অবাক করে জানালো, কিছু কথা সে আমাকেই একমাত্র বলতে চায়। তারপর চুপিসারে বললো, দাদা এখানে নয়, অফিসের বাইরে লন’এ চলুন। গেলামও তাই। শুধুমাত্র দু’জনে।
হঠাৎই আমাকে বলল দাদা আপনাকে বাবার চোখে দেখি। সেই ভরসায় আমি বাধ্য হয়ে আপনার একটা হেল্প চাইছি। ওকে দেখেই বুঝলাম মেয়েটি বিপদগ্রস্থ। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না একটা চাপা আতঙ্কে। আমি নির্ভয় দিতেই সে চোখটা নামিয়ে জানালো, কিছুক্ষণ হল তার মাসিক শুরু হয়ে গেছে। তাই তার আবার ছুটি চাই। কিন্তু কাকে বলবে সে কথা? তেমন কেউ নেই যে যাকে ভরসা করে এটা বলা যাবে। আবার সবে দুই দিন আগে ছুটি নিয়েছিল। তাই ছুটি যে সে পাবে না তা নিশ্চিত। সঙ্গে সঙ্গে এও বললো, বেশি দেরি তার হলে পরণের পোষাকও নষ্ট হয়ে যাবে। সেটাও যে তার কাছে ভারি লজ্জার। আমি জানতে চাইলাম, অফিসে তো ফাস্টএড বক্স আছে। অফিস স্টকে স্যানিটারি প্যাড রাখা থাকে তো বল, আমি নিজে যোগার করে দিচ্ছি। খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করেই বললো, আপনি পাগল হয়েছেন দাদা। ওসবের মর্ম যদি অফিস বুঝতো তাহলে কি আপনাকে বলতাম? কেউ জানলে তো আমি ফিসফিসানির বিষয় হয়ে যাবো অফিসে। উলটে না পাবো ছুটি। ওর কথার সারমর্ম যে কতো কঠিন বাস্তব তা আমি তখনই অনুমান করেছিলাম। আমার পিছনের কাপড়টা খারাপ হয়ে যায়নি তো দাদা? একটু পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে এ’কথা বলতেই আমি বললাম না রে পাগলি তোর কুর্তিটা ঠিকই আছে। বরং ওড়নাটা আর একটু নামিয়ে রাখ আগাম সেফটি হিসেবে। ‘প্লিজ দাদা আমাকে বাঁচান। এবারের মতো আপনি ছুটি দিন। আমি জানি আমাকে কেউ ছুটি দেবে না।’ ওর এই করুণ আর্তিটা কানে যেতেই আমার প্রায় যুবতী মেয়ের কথা মনে পড়লো। পরম স্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমাকে তুই এতো ভরসা করিস? কাউকে কিছু বলতে হবে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি সুবীরদা ছুটি দিয়েছে। নিশ্চিন্তে বাড়ি যা এখুনি। যথারীতি চলেও গেল কিছুটা নিশ্চিন্তে।
এরপরই বাঁধলো গোল। আমি বলবো অসভ্যতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেমে নেয়ে হাজির সুদর্শণ এক সিনিয়র নিউজ রিডার। বরাবরি সে আমাকে সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। সে বলল দাদা তুমি নাকি ওকে ছুটি দিয়ে দিয়েছ। এখন নিউজ কে পড়বে তাহলে? আমি হেসে বললাম কেন তুই তো আছিস। কিছু মৃদু প্রতিবাদ করেই বললো, এই তো দুই দিন আগে ছুটি নিল। আবার আজকে আচমকা চলে গেল। এতে তো অফিসের সিস্টেম ভেঙ্গে পড়বে। আমি শুধুই তাকে জানালাম, ওর বড্ড বিপদ বলে ওকে ছেড়ে দিয়েছি। আর সহকর্মীর বিপদে তো সহকর্মীদের পাশে থাকতেই হয় তাই না? ওই সুদর্শণ নিউজ রিডার আমার মুখের উপর কিছু বললো না ঠিকই। কিন্তু সে যে আমার কথাটা মেনে নিতে পারেনি তা উপলব্ধি করেছিলাম হাবেভাবে। কারণ ক্ষাণিক পরেই মালিক কাম এডিটরের গম্ভীর তলব। আমাকে একাকী। তার চেম্বারে। যদিও এডিটর বিলক্ষণ জানে আমি ভীষণ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সাংবাদিক। চাকরির তোয়াক্কা আমি কোনওদিনই করিনি। কোনও মিডিয়াতেই। তবু এডিটর আমাকে সরাসরি বললো, তুমি ওকে বারবার ছেড়ে দিচ্ছ কেন? আমি তখনই জবাব দিলাম, এডিটোরিয়াল বিভাগটা আমার অধীনস্থ। আমার কাজ ওঠানোর কথা। কাজ উঠে তো যাচ্ছে। তাই এইটুকু আমার স্বাধীনতা আছেই, খুব জরুরী ভিত্তিক কাউকে ছুটি দেওয়ার। তাও ক্রমেই তর্কেই মাত্রা বাড়তেই লাগলো। তাই বাধ্য হয়েই সব বিষয়টা আমি এডিটরকে খুলে বললাম। ভাবলাম সুরাহা হবে মানবিক পর্যায়ে। কিন্তু কাকে বললাম ওই কথাটা? সে সরাসরি ওই মেয়েটির উদ্দেশ্যে ছুড়লো দু’চারটে কাঁচা কাঁচা অকথ্য নির্লজ্জ গালি। আর আমাকে বলল, ওইরকম সব মাগ…. দের কথায় ভরসা করতে হয়? দেখ গে যাও ফলস মেরে কার সঙ্গে এখন পার্কে জড়াজড়ি করে বসে রয়েছে। আরও বললো কুতসিৎ ভাবে, তুমি কি দেখেছো তার মাসিক হয়েছে কিনা? আর তোমাকেই বা সে বলতে গেল কেন? অফিসে অন্য মেয়েরাও তো ছিল। অফিস চালাতে গেলে একটা ডিসিপ্লিন মানতে হয়। যেটা কিন্তু সিনিয়র হলেও তোমারও মানা উচিত সুবীর। তখন মনে হচ্ছিল আমার উল্টোদিকে বসে আছে একটা অশিক্ষিত জানোয়ার যে কিনা কোনও শ্রদ্ধেও মহিলার গর্ভেই জন্ম নিয়েছে। হায় ইশ্বর। আমি এই কথা শুনে এডিটরের মুখের উপর রাগত ভাবেই জানালাম, এই নিয়ে যদি আর একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলো তো আমি এখুনি তোমার চাকরি ছেড়ে দিতে তৈরি। আমার এহেন একরোখা স্পষ্ট উত্তরে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তখনকার মতো। ক্ষানিকটা বাধ্য হয়েই।
ভাবতে পারেন ডিজিটাল যুগের মিডিয়া হাউসের এহেন হালহকিকৎ। কতই না অন্যের সমালোচনায় মুখর হয়ে প্রচারিত হয় নানান সংবাদ। কতই না নীতির কথা প্রচার হয় অহরহ। এই মিডিয়া হাউসের তরফে। অথচ এখানেরই এক নারীকর্মী আচমকা ঋতুময়ী প্রকৃতির নিয়মেই। আর তাকেই উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ দিচ্ছে তারই এডিটর। তার আদৌ মাসিক হয়েছে কি না তা সন্দেহ প্রকাশ করে জানতে চাইছে, আমি তার মাসিক অবস্থা দেখেছি কি?
এই পশুসুলভ আচরণ যাঁরা করেন ভাবি তাঁরা আদৌ কি মানুষ? আর কতদিন এভাবে রজঃশীলা মেয়েরা সামাজিক পর্যায়ে নানান হেনস্থার শিকার হবেন? ভাবতেও লজ্জা হয়। এহেন পুরুষ তান্ত্রিক অজ্ঞ অসভ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন সবাই। আমরাও হই। ঋতুপ্রক্রিয়া শরীরের একটা স্বাভাবিক অবস্থা। মেয়েদের ক্ষেত্রে। এই নিয়ে এত সমালোচনা, এত টিপ্পনী, এত গালিগালাজ, এত ছোট করা-আজও মেয়েদের সহ্য করতে হয় কেন সমাজে যত্রতত্র? তবু মন্দের ভাল, সম্প্রতি মুম্বাইয়ের দু’টি সংস্থা মহিলাকর্মীদের ঋতুকালীন সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে। এই দৃষ্টান্ত সারা দেশে চালু হোক বাধ্যতা মুলক ভাবে। সরকারও এই নজীর স্থাপন করুক। যেখানে মহিলা কর্মীরা রয়েছেন সেই কর্মস্থানে স্যানিটারি প্যাড স্টকে রাখারও ব্যবস্থা থাকুক আবশ্যিক পর্যায়ে। নয়তো সেদিনের মতো আমার ওই বোনের উদ্দেশ্যে কুকথার স্বেচ্ছাচারিতা সগর্বে চালিয়ে যাবেই দুই পা-ওয়ালা চুলবুল জন্তুর দল। ধিক ধিক......
চুলবুল পার্টিরা শরমহীন প্রশ্ন তুলতেই পারেন এর সঙ্গে স্বাধীনতার ৭৩ তম দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার কি সম্পর্ক? কি বলি বলুন তো? সোস্যাল মিডিয়ার পেজ খুললেই কতই না বিজ্ঞের সচেতনতার পোস্ট। হাজারে হাজারে। সঙ্গে কাতারে কাতারে লাইক ও কমেন্ট। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে আমরা কতই না আধুনিক মনস্ক। আমরা কতই না সমজদার। আর ব্যবহারিক জীবনে, অফিসে পাশে বসা ঋতুমতী সহকর্মী কখন যে মাগ... হয়ে যাবে তা ভাবলেই গা রিরি করে ওঠে। আজও কলকাতার বুকে মিনিবাসে মাসিকগ্রস্থ যুবতীকে টিপ্পনী শুনতে হয় প্রকাশ্যে। অথচ সোস্যাল মিডিয়ার কোনও অতি বিপ্লবী কিন্তু নীরব থেকে যান শান্ত বিনয়ীর লেবেলে। সব নিজের চোখে দেখেও। তখনই চুলবুল গাই বুক ঠুকে বলে, আরে দম হ্যায় তো আও না?
স্বাধীনতার ৭৩ তম দিবস রজনী অতিক্রান্ত। আর মাত্র দুই বছর অপেক্ষা। সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে ৭৫ তম দিবস থেকে শুরু হবে আরও এক নতুন ভারতের বিজয় উৎসব। কি যেন কথাটা? ৭৫ তম দিবসের নবতম ভারতের নতুন সূর্য আহ্বানের প্রস্তুতি? আচ্ছা এই শিক্ষিত বা অশিক্ষিত চুলবুল বাহুবলীরা সেদিনও কি ফিচেল হাসি হেসে বলতে পারবে, দম হ্যায় মেরা। আরও একটা প্রশ্ন, সেদিনও কি ঋতুমতী মেয়েরা রাস্তায় অফিসে নিজের ঘরে মাগ... বনে যাবেন না তো?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours