শুভদীপ গুপ্ত, লেখক, কলকাতা:
একটা অন্য রকম বিষয় নিয়ে আজ লিখবার কথা ভাবছিলাম। প্রথমে নিজের ছোটবেলার কথা দিয়ে শুরু করি। বাবা সময় সুযোগ পেলে দেশ বিদেশের বিভিন্ন গল্প শোনাতেন। বাবার থেকে গল্প শোনাটা ছোটবেলায় আমার খুব প্রিয় একটা বিনোদন ছিল। যার মধ্যে সবচেয়ে ভাল লাগতো ক্যাসাবিয়াঙ্কার গল্প। বারবার সেই গল্পটাই শোনানোর জন্য জ্বালিয়ে মারতাম বাবাকে। যদিও আমার ভীষণ প্রিয় ওই তেরো বছরের ছেলেটিকে বাবার একেবারেই পছন্দ ছিল না। মূর্খ, অপদার্থ, গাধা আরো বিভিন্ন বিশেষণে ভরিয়ে দিত, যতবার ওর গল্প বলতে বাধ্য করতাম। কিন্তু সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম হিরো ছিল সেই বালক। স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমি ক্যাসাবিয়াঙ্কা হতে চাইতাম। চোখের সামনে দেখতে পেতাম দাউদাউ করে জ্বলন্ত লেলিহান শিখার মাঝখানে জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো সেই কিশোরকে। যে প্রাণপণে ডেকে চলেছে নিজের বাবাকে অথচ পিতৃআজ্ঞা পালনে এক পাও নড়ছে না সেখান থেকে, নেমে পালানো তো দূরের কথা। কেন না বাবা তাকে বলে গেছে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে। তো তখন হঠকারী শব্দটা আমার জীবনে প্রবেশ না করলেও হঠকারিতার এই দুর্দান্ত ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করেছিল ভীষণভাবে।
আজকাল যদিও হঠকারী শব্দটা কথ্য ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে। হঠকারিতা, হঠকারী পদক্ষেপ,হঠকারী সিদ্ধান্ত এসব কথাগুলো আকছার শুনি আমরা, বলেও থাকি। আজ এই “হঠকারী” শব্দটা নিয়েই একটু আড্ডা হয়ে যাক।
আচ্ছা হঠকারিতা কি শুধু মানুষই করে? আর কোন প্রানী করে না? না মশায় একটু ভুল জানেন আপনি। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আরো বহু প্রানী আছে যাদের হঠকারিতা দেখলে বা শুনলে আমরা হতবাক হয়ে যাবো। যুগে যুগে মানুষ বহুবার চমকিত হয়েওছে সে সব দেখে। যদিও পরবর্তীকালে জীববিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, প্রমান করেন আপাত চোখে যেটা হঠকারি পদক্ষেপ মনে হচ্ছে সেটা সেই প্রাণী করছে হয় তার উত্তরপুরুষকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে অথবা তাকে বাধ্য করানো হচ্ছে অন্য কারুর স্বার্থে। তবে দুটো ক্ষেত্রেই এধরণের আচরণের পিছনে প্রকৃতি নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কাজ করে। একমাত্র ব্যতিক্রম হল মানুষ। তার হঠকারিতা প্রকৃতি নির্ধারিত নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে। তাই মানুষের হঠকারিতায় ক্ষতি হয়েছে,হয় সেই ব্যক্তি মানুষের, মানব প্রজাতির, সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের। যেটা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে কখনোই হয় না। নিচে প্রথমে বিভিন্ন প্রানীদের হঠকারিতার কিছু উদাহারন দিচ্ছি। তারপর দেবো তার ব্যাখ্যা। এরপর একদম শেষে গিয়ে আলোচনা করবো মানুষের হঠকারিতা নিয়ে।
লেমিং নামে প্রাণীটার কথা প্রথম শুনি প্রফেসার শঙ্কুর গল্পে। খুব অবাক হয়েছিলাম তাদের এমন অদ্ভুত মৃত্যুবরণের পদ্ধতি জেনে। যারা জানেন তো জানেনই, আর যারা জানেননা তাদের অল্প করে জানিয়ে দিই। লেমিং ইঁদুরের মতন দেখতে কিন্তু তার চেয়ে আকারে সামান্য বড় বাদামি রঙের এক ধরনের প্রানী। সাধারণত কানাডার কিছু অঞ্চল,আলাস্কা আর নরওয়েতে বেশি দেখা যায়। তো যেটা আশ্চর্যের মাঝেমাঝে এরা দল বেঁধে হাজার হাজার মাইল পাড়ি জমায় সমুদ্রের উদ্দেশ্যে। পথের সমস্ত রকম বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ওরা কেবল এগিয়েই চলে। তারপর সমুদ্রে পৌঁছে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি লেমিং কিন্তু সাঁতার জানে। তাই জলে ঝাঁপানোর সঙ্গে সঙ্গেই যে মারা যায় তাও নয়। না ডুবে যাওয়া অবধি ওরা সাঁতার কাটতেই থাকে।ঘাসফড়িং-এর মাঝেমধ্যেই জলে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতার খবর গ্রামদেশের অনেকেরই জানা আছে। এই হঠকারিতা যুগযুগ ধরে মানুষকে বিস্মিত করে রেখেছে।
পিঁপড়েকে অনেক সময় দেখা যায় ঘাস বা পাথরের গা বেয়ে ক্রমাগত একবার উঠছে একবার নামছে। কলুর বলদেও এমন বেফালতু খেটে মরেনা। এ এমন এক হঠকারিতা যা বিস্মিত করেছিল স্বয়ং ডারউইন সাহেবকেও।
পিঁপড়ে বেচারাও যে ওই বেফালতু খেটে মরে তার কারণও কিন্তু ল্যাংসেট ফ্লুক নামে আর এক ধরনের প্যারাসাইট। এদের প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান হল গরু বা ছাগলের পাকস্থলী। তাই এরা পিঁপড়ের মস্তিষ্ক দখল করে তাকে বাধ্য করে ঘাস বা পাথরের গা বেয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করতে। যাতে গরু বা ছাগলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তারপর গরু বা ছাগলের পেটে যাওয়াতো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
অর্থাৎ এর থেকে একটা ব্যাপার পরিস্কার বোঝা গেল যে প্রকৃতিতে জন্মানো অনেক প্রাণীর কাজকর্ম আমার আপনার চোখে অস্বাভাবিক বা হঠকারী লাগলেও আসলে তার সুনির্দিষ্ট যুক্তিনির্ভর দুটো কারণ রয়েছে। হয় সে সেটা করছে নিজের জন্য অথবা তার মস্তিষ্কের দখল নিয়ে অন্য কেউ তাকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করছে।
পিঁপড়েকে অনেক সময় দেখা যায় ঘাস বা পাথরের গা বেয়ে ক্রমাগত একবার উঠছে একবার নামছে। কলুর বলদেও এমন বেফালতু খেটে মরেনা। এ এমন এক হঠকারিতা যা বিস্মিত করেছিল স্বয়ং ডারউইন সাহেবকেও।
এবার আগের পর্বে উল্লেখ করা তিনটে প্রানীর পাগলামোর কারণগুলো একটু জেনে নেওয়া যাক। প্রথম আসি লেমিং এ। এরকম আজব প্রানী দুনিয়ায় বোধহয় খুব কমই আছে। জীব বিজ্ঞানীদের মতে যখন লেমিং সমাজে খাদ্যাভাব দেখা দেয় বা লেমিং সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় ঠিক তখনই এরা দল বেঁধে বেরিয়ে পরে আত্মহত্যা করতে। এই অবধি শুনেই অবাক হবেন না। আরো চমক আছে। ওই মৃত্যু মিছিলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সামিল হয় প্রথমে বৃদ্ধরা। তারপর আর একটু অল্প বয়েসিরা। আর একদম শেষে নারীরা। নারীদের লেমিং সমাজ ঠিক এতটাই কদর করে। পাশাপাশি এটাও দেখুন ওরা ঠিক সেই ভাবেই আত্মহত্যায় যায় ঠিক যতজন মারা গেলে পুরো সিস্টেমটা আবার একটা ব্যালেন্সে এসে যাবে। অর্থাৎ সাদা চোখে যেটা হঠকারিতা মনে হচ্ছিল আদপেই সেটা হঠকারিতা নয়। বরং নিজেদের সমাজের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার কি যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা !!
তবে ঘাসফড়িঙ বেচারা এত বুদ্ধিমান না। সে কিন্তু অন্যের জন্য বলি প্রদত্ত। সেই অন্য জন হল নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে একপ্রকার প্যারাসাইট। দেখতে ফিতাকৃমির মতন। তো এই প্যারাসাইটের প্রজননের জন্য জলের প্রয়োজন হয়। তাই সে ঘাসফড়িঙের মস্তিষ্ককে সংক্রামিত করে জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য করায়।
পিঁপড়ে বেচারাও যে ওই বেফালতু খেটে মরে তার কারণও কিন্তু ল্যাংসেট ফ্লুক নামে আর এক ধরনের প্যারাসাইট। এদের প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান হল গরু বা ছাগলের পাকস্থলী। তাই এরা পিঁপড়ের মস্তিষ্ক দখল করে তাকে বাধ্য করে ঘাস বা পাথরের গা বেয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করতে। যাতে গরু বা ছাগলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তারপর গরু বা ছাগলের পেটে যাওয়াতো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
অর্থাৎ এর থেকে একটা ব্যাপার পরিস্কার বোঝা গেল যে প্রকৃতিতে জন্মানো অনেক প্রাণীর কাজকর্ম আমার আপনার চোখে অস্বাভাবিক বা হঠকারী লাগলেও আসলে তার সুনির্দিষ্ট যুক্তিনির্ভর দুটো কারণ রয়েছে। হয় সে সেটা করছে নিজের জন্য অথবা তার মস্তিষ্কের দখল নিয়ে অন্য কেউ তাকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করছে।
আগের আড্ডাগুলোতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন প্রানীর হঠকারিতা। যদিও সেটা আসলে প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণেই ঘটছে সেটাও আমরা দেখেছি। তো এবার আসবো মানুষের হঠকারিতায়। এই লেখার প্রথম দিকেই যেটা বলেছিলাম মানুষের ক্ষেত্রে হঠকারিতা কিন্তু এত সরল পথে হাটেনি। অনেক ক্ষেত্রে বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই হঠকারিতা কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মকেও লঙ্ঘন করে গেছে বারংবার। সেই লঙ্ঘনের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। কখনো সেটা গুরুতরভাবে কখনো বা হালকা ভাবে। এই ধরুননা কেন এই লেখাটা পড়তে পড়তেই যখনই আপনি ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিতে শুরু করেছেন। আর ঠিক তখন থেকেই কিন্তু আপনি আপনার জন্য প্রকৃতির বরাদ্দ করা অক্সিজেনটুকুর বাইরে গিয়েও আরও খানিকটা অক্সিজেন পুড়িয়ে ফেলছেন স্রেফ পয়সার জোরে। অথচ দেখা যাবে আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, তথাকথিত আধুনিক মানুষ। আপনি সবই জানেন সবই বোঝেন অথচ ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে ফুঁকে চলেছেন, হ্যাঁ অনেক সময় পাবলিক প্লেসেও।
এই প্রসঙ্গে একটা দৃশ্য বলার লোভ সামলাতে পারছি না। কফি হাউসে গেলে দেখবেন আলাদা আলাদা টেবিলে গোল হয়ে বসে বিভিন্ন বয়েসি ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন গভীর আলোচনায় মত্ত, একদল হয়তো শ্রেনী সংগ্রাম তত্ত্ব, শ্রেনী বৈষম্য, বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা এসব নিয়ে খুব জরুরী মিটিং করছে। আবার তাদের পাশের টেবিলের ছেলেটাই আগামী মাসে কোন এক বহুজাতিক কম্পানিতে জয়েন করে পাকাপাকি ভাবে দেশ ছাড়বে। ডলারে সে যা কামাবে তাই দিয়ে লিমুজিন না রোলস রয়েস ঠিক কোনটা নামাবে এই নিয়েই ভীষণ চিন্তায় আছে। তো আপাত দৃষ্টিতে এই দুই টেবিলের অধিবাসীদের দুই মেরুর বাসিন্দা মনে হলেও এদেরকে প্রবল ভাবে সাম্যের বন্ধনে বেঁধেছে ওই একটিই বস্তু। তা হল ধোঁয়া। হ্যাঁ সামাজিক স্ট্যাটাস, রুচিবোধ, সাংস্কৃতিক চেতনায় ওই দুই টেবিলের যোজন যোজন ফারাক এবং তথাকথিত শ্রেনী শত্রুতা থাকলেও এ ব্যাপারে কিন্তু তারা দ্বিধাহীন ভাবে একসঙ্গে হাতেহাত মিলিয়েছে, ধোঁয়া ফুঁকে নিজের এবং পরিবেশের বারোটা বাজানোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাদের কাঁধে। এইরে মাথা গরম হয়ে গেল নাকি ? উদাহারনটা ভাল লাগলো না তাই তো ? ঠিক আছে তাহলে আলোচনাটা বরং পাল্টাই, চলুন পৃথিবীর ইতিহাসে নাম তুলে ফেলা এক ভয়ঙ্কর হঠকারি ঘটনার দিকে চোখ ফেরাই। একটা মামুলিতম কাজ কি ভাবে প্রকৃতিতে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্ম দিল আসুন দেখা যাক। (ক্রমশ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours