মুজতবা আল মামুন,  সাংবাদিক, কলকাতা: 

'নেহরু' এবং 'গান্ধী'  ট্যাগ কি কংগ্রেসের ভবিতব্য ? পরিস্থিতি সে কথাই বলছে। অনেক আলোচনা হল। ম্যারাথন বৈঠক হল। তারপরও জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব  কোনও স্থায়ী  সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না । পারলো না গান্ধী পরিবারের বাইরে নতুন কাউকে কাণ্ডারি হিসেবে খুঁজে নিতে।  তাই সভাপতি পদে ‘আপাতত’ ফিরতে হল সোনিয়া গান্ধীকেই। আর সভানেত্রী হয়েই সোনিয়া নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে মাঠে নেমে পড়লেন। জওয়ানে মুড়ে ফেলা কাশ্মীর উপত্যকার খবর সেভাবে দেশের অন্যান্য অংশে পৌঁছচ্ছে না। তিনি দাবি জানালেন, কেমন আছেন  সেখানকার মানুষ, তা দেখতে বিরোধীদের কাশ্মীরে যেতে দিতে হবে। সরকারের কথায় তাঁরা আস্থা রাখতে পারছেন না।  শুরুতেই চাপের রাজনীতিতে ফিরে  বুঝিয়ে দিলেন,  দিশা হারনো দলকে দ্রুত ছন্দে ফেরাতে বদ্ধপরিকর তিনি। 
শনিবার নয়া দিল্লিতে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির দীর্ঘ বৈঠক শেষে ‘অন্তর্বতীকালীন’ সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধীর নাম ঘোষণা করা হল। কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, নতুন একজন স্থায়ী  সভাপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সোনিয়া গান্ধীই ভারতের শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের সভাপতির কাজ চালিয়ে যাবেন। দলে তারুণ্যের জোয়ার আনতে, প্রায় দুই দশক ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়ার পর,   ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ছেলে রাহুল গান্ধীর কাঁধে দলের নেতৃত্ব ছেড়ে,  সভাপতির পদ ছেড়েছিলেন গান্ধী পরিবারের পুত্রবধূ সোনিয়া। রাহুলকে বাছতে তিনি কোনও চাপ সৃষ্টি করেন নি। দলই বেছে নিয়েছিল। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির দায় কাঁধে নিয়ে, রাহুল গান্ধী সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। তাই  দেড় বছরের মাথায় আবার হাল ধরতে হচ্ছে সোনিয়াকে। 
এবারের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ৫২টি আসনে জয় পায় কংগ্রেস। অন্যদিকে ৩০৩ আসনের জয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে  ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি। শুধু কংগ্রেস নয়,  এই নির্বাচনে বিরোধীরা কার্যত পর্যদুস্ত হয়েছে। যদিও ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, পেশিশক্তি  ও কাঞ্চনমূল্যে নির্বাচন করেছে শাসকদল। বিরোধীদের তাই মত। এ ছাড়া  বিরোধীদের বাড়তি অভিযোগ রয়েছে ই ভি এম মেশিন কারচুপির। কংগ্রেস যেহেতু সর্বভারতীয় এবং শতাব্দীপ্রাচীন দল,  আভ্যন্তরীণ বহুমাত্রিক  দ্বন্দ্ব আছে। তাতে দলের ভিতর থেকেও রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিমানে রাহুল নিজেকে সরিয়ে নেন।মাকেও সরে আসতে বলেন। কেননা দলের একাংশের অন্যতম অভিযোগ ছিল, যদিও এটা কংগ্রেসবিরোধীদের তৈরি করা অস্ত্র,  যে, কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদ  কেন শুধু নেহরু ও গান্ধী পরিবারের আবর্তে ঘুরপাক খাবে ? দলে অনেক অভিজ্ঞ,  প্রবীণ,  সফল নেতা রয়েছেন। তাঁদের কেন সভাপতি করা হবে না ? রাহুল পদত্যাগ করে, সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। তিনি চান নি মাকেও পুণরায় ওই পদে বসান হোক। দল ওই দুই পরিবারের বাইরে কাউকে খুঁজুক। এটা দলের কাছে রাহুলের গোপন চ্যলেঞ্জ ছিল হয়তো। 
রাহুলের পদত্যাগের পর আড়াই মাস ধরে দলের ছোট-বড় নেতারা তার মত বদলের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। রাহুলের বোন প্রিয়াঙ্কাও ‘না’ বলে দেন। মা সোনিয়া গান্ধীও সে সময় নেতৃত্বে ফিরতে রাজি ছিলেন না। এই অবস্থায় তৃতীয়বারের মত নেহেরু-গান্ধী পরিবারের বাইরের কারও হাতে দলের ব্যাটন যাওয়ার সুযোগ  তৈরি হয়েছিল। সুশীল কুমার সিন্ধে, মুকুল ওয়াসনিক আর মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম বেশ জোরের সঙ্গেই শোনা যাচ্ছিল। জানা যায়,  মুকুল ওয়াসনিককে সভাপতি করার বিষয়টি মোটামুটি ঠিকই করে ফেলেছিলেন নেতৃত্বের একাংশ। আবার দলের বড় একটা অংশ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাহুলকে সভাপতি পদে ফিরতে অনুরোধ করেন। কিন্তু রাহুল সিদ্ধান্তে অটল থাকলে আলোচনার জন্য অঞ্চলভিত্তিক নেতাদের নিয়ে পাঁচটি কমিটি করা হয়। সেই আলোচনার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান সোনিয়া ও রাহুল। অঞ্চলভিত্তিক পাঁচ কমিটির মতামত নিয়ে রাতে আবার ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসলে দেখা যায়, অধিকাংশ নেতা রাহুলকেই সভাপতি পদে চান। মজার ব্যাপার হল, ম্যারাথন বৈঠকে সভাপতি হিসেবে কারও নাম চূড়ান্ত করতে না পারায়,  বেশির ভাগই সোনিয়া গান্ধীকেই চেয়ে বসেন। বৃহত্তর অেশের বক্তব্য, এই ক্রান্তিকালে  গান্ধী পরিবারের বাইরে কেউ সভাপতি হলে, দল ভেঙে যাবে। ফলে সোনিয়া ছাড়া গতি নেই। নরম হতে বাধ্য হন সনিয়া। যদিও জানিয়ে দেন, এই ব্যবস্থা কিন্তু অস্থায়ী। দলকে দ্রুত নতুন সেনাপতি খুঁজে নিতে হবে। 

কখনও সরকারের কোনো পদ না নিলেও, ৭২ বছর বয়সী সোনিয়াকে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর নেতৃত্বেই কংগ্রেস ২০০৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যায়। দল ক্ষমতায় এলেও,  নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে, মনমোহন সিং-কে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেন । বিজেপির চাল  ছিল, সোনিয়াকে বিদেশী বানিয়ে,  প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকানো। মনমোহন সিং-কে এগিয়ে দিয়ে সোনিয়া মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন। ছন্নছাড়া দলকে গোছাতে এখন তাঁকে কখনও নরম, কখনও গরম নীতি নিতে হবে। গান্ধীবিরোধী লবি এই মুহূর্তে শক্তিহীন। ফলে সোনিয়াকে এগোতে বেশি বেগ পেতে হবে না। তার চেয়েও বড় বিষয়, আবার প্রমাণ হল,  কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারেরই রয়েছে একটা বিশেষ জায়গা। ওই পরিবারের রয়েছে ঐতিহ্য। বলিদানও। সংকটে তাই ভরসা সেই গান্ধী পরিবারই,  সে যাঁরা যত অপপ্রচার করুন না কেন। সমালোচকরা জব্দ হওয়ায়, রাহুল কি গোপনে হাসছেন ? 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours