শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, কলকাতা:
লেখক এক মার ডালনে কা চিজ হ্যায়,কথাটি বলেছেন হিন্দি সাহিত্যিক লেখক, মাখন লাল চতুর্বেদী। তার 'কলা আউড় সাহিত্য ' নামের হিন্দী ভাষায় লিখিত বইয়ে। তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন; একজন জঙ্গি, একজন সন্ত্রাসী লুকিয়ে লুকিয়ে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এমন কি কোন জঙ্গি, সন্ত্রাসীর থাকে ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠোপোষকতা। পৃষ্ঠ পোষকতা পায় গুন্ডা পান্ডারাও। যা, একজন লেখক পায় না কখনো। লেখককে তার নিজেরই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যাবস্থা করতে হয়। এবং লিখেতে যেতে হয়,আর লিখতে গেলে পড়তে হয় প্রচুর। আর যদি প্রচলিত চিন্তা বাইরে বা স্রোতের বিপরীতে কেউ লিখতে চায় তবে তার আরো বেশি বিপদে পরার সম্ভবনা রয়েছে। এমনকি প্রথাবিরোধী লেখকদের খুন হওয়ার ঝুকিও রয়েছে। খু্ন হয়েছেও। এছাড়া থাকে, না খেয়ে মরারও সম্ভবনা। যেমন আমি কয়েকজনকে চিনি যারা, লেখালেখির জন্য আত্মগোপনে চলে গেছেন। চাকুরী ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এমন বেশ কিছু লোকদের আমি চিনি, যারা ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও লিখেন না। চাকরী হারানোর ভয়ে, সংসার ভাঙ্গার ভয়ে, হামলা- মামলার ভয়ে।
শাসকের বিরুদ্ধে লিখলে কেবল শাসক দলের লোকজন আপনাকে পেটাবে। আর শাসকই আপনাকে জেলে দেবে বাকিরা কিছু বলবে না। কিন্তু যখন আপনি প্রচলিত ধ্যান ধারনা, অপবিশ্বাস ও তথাকথিত প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলবেন বা লিখবেন তখন কেবলল শাসকই নয়, সমাজের সবচেয়ে নিরীহ লোকটাও আপনার মাথা কেটে নিতে আসবে। অথচ ঐ নিরীহ লোকটারও দাবি শাসক তাকে কথা বলতে দেয় না! কিন্তু তার মতের বিরুদ্ধে গেলে 'ঢাল তরোয়াল" বিহীন ঐ গো-বেচারা লোকটাও ভয়ংকর হয়ে উঠে।
তসলিমা নাসরীন বলেছিলেন, "নারীর কোন দেশ নেই "কারো কারো মতে মুক্তচিন্তকদের দেশ নেই। তবে যেহেতু আমি মার্কসবাদী তাই, আমি বলতে চাই; শ্রমজীবীদের কোন দেশ নেই। আরো স্পষ্টভাবে বললে, দরিদ্রদের দেশ নেই। দরিদ্রদের কোন ধর্মও থাকার কথা ছিলো না। কিন্তু তাদের সামনে তো বিকল্প কিছু নেই ধর্ম ছাড়া। নিজেকে আত্মপ্রবঞ্চনা দিতে ধর্ম একটি ভালো দাওয়াই।
ডক্টর আহামদ শরীফ বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক,লেখক। তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি ভণিতা না করে নিজেকে নাস্তিক বলেছেন। তিনি স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে সময় বলা কঠিন বিষয় ছিলো। অদ্ভুত বিষয় হলো, এখন নিজেকে নাস্তিক ঘোষনা করা আরো কঠিনতর হয়ে গেছে। অথচ কথা ছিলো উল্টোটি হওয়ার। এতই কঠিন, হয়ে গেছে যে, যারা বস্তুবাদী রাজনীতি ও দর্শন চর্চা করেন তারাও অনেক বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান!
সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ খুবই বিপদজনক। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদীরা গরুর মত কালার ব্লাইন্ড। আপনি গরুকে কখনোই রং চেনাতে পারবেন না এজন্য যে, গরু জন্মগত ভাবেই কালার ব্লাইন্ড।
আমি একবার বিদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে প্রথমেই বাদ পরি। কেন না, আমি নিজে কালার ব্লাইন্ড! আমি রং ঠাহর করতে পারি না। তাই আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া তথা গাড়ি চালানোর জন্য অনফিট। কেন না, আমি তো সিগনালই বুঝবো না, তো ট্রাফিক আইন মানবো কি ভাবে! আর ট্রাফিক আইন না মানলে দুর্ঘটন অনিবার্য। ঠিক তেমনি উগ্রসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদীরা অন্যের অধিকার, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা বুঝবে না। যারা, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদ ছড়ায় ; তারা প্রথমে মগজ থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বনাগরিকের ভাবনা মগজ থেকে ছেটে ফেলে। সে কারনে তাদের দ্বারা যে কোন স্থানে যে কোন বিপদজ্জনক কাজ করানো সম্ভব। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদীরা সমাজ, সভ্যতা, শিক্ষা, সাম্য বিরোধী মানসিকতা নিয়ে পথ চলে।
ভারত সরকার নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দিচ্ছে। আসলে কোন নির্যাতিতকে আশ্রয় দেয়া অন্যায় কিছু নয়৷ বরং মানবিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। যুগে যুগে নির্যাতিত বহিস্কৃত দের জায়গা দেয়া হয়েছে। হযরত মোহাম্মদ নিজেকে প্রোফেট ঘোষনা করার কারনে তার কওম তাকে বহিস্কার করে। তিনি মাতৃভূমি মক্কা থেকে ইয়াত্রিবে ( ইয়াত্রীবের নাম বদলে মদীনা রাখা হয়) আশ্রয় নেন। যুগে যুগে কালে কালে অনেক রাজনীতিক,কবি,দার্শনিক,লেখক, বিজ্ঞানী তথা জগৎবিখ্যাত ব্যাক্তিদেরকে মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কেউ ফিরতে পেরেছেন কেউ বা ফিরতে পারেননি। ভারত, বিখ্যাতদের নয়, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ পাকিস্তানের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দিচ্ছে। দেয়া উচিতও। এই সংখ্যালঘু কারা? সানতন (হিন্দু) খৃষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। কেন এ প্রশ্নটা তুলছি? বলার অপেক্ষা রাখে না সানাতন ও বৌদ্ধ দর্শন এ উপমহাদেশের মাটি, বাতাস জলের সাথে সাথে মিশে আছে। খৃষ্ট দর্শন যদিও মনে করা হয় ইউরোপের আদতে তা মধ্যপ্রাচ্যের তথা আরবীয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর উৎপত্তি আরবেই। আফগানিস্তান বাংলাদেশ পাকিস্তান সনাতন, খৃষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু এবং নির্যাতিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরো কিছু মানুষ নির্যাতিত নিপীড়ত। যদিও তারা কোন ধর্মের নয়, সম্প্রদায়ের নয়। সম্প্রদায় হিসেবে যদিও তারা স্বীকৃতি পায়নি, চায়নিও।। তবে তারা নির্যাতিত নিপিড়ীত। তারা হলো নাস্তিক। প্রকৃত পক্ষে আফগানিস্তান, পাকিস্তান,বাংলাদেশে নাস্তিকরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, নিপিড়ীত। এবং সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুকির মধ্যে বসবাস করে। যদিও জাতিসংঘ সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যাক্তির মত ও চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত।
অনেকে মনে করেন,নাস্তিক্যবাদ ইউরোপ থেকে আমদানী করা! যদিও সত্যটা তা নয়।
নাস্তিক্যবাদ ভারতীয় দর্শন। বৈদিক দর্শনের অন্তর্গত বললেও ভুল হবে না। তাই কেউ যদি নাস্তিক্যবাদ গ্রহন করে বা নাস্তিক্যবাদের জন্য নির্যাতিত হয়, তাদেরও ভারতের আশ্রয় দেয়া উচিত।
ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতি সভ্যতা শিক্ষাকে যদি ভারত রক্ষা না করে তবে কারা করবে? অবশ্য কাশ্মীরি সংস্কৃত ভাষার কবি বিলহানার বিষয়ে আমরা উল্টোটা দেখি। কবি বিলহানার কবিতা খোদ ভারতীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো না হলেও। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রায় ৮০ টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।
ভারতীয় সভ্যতায় প্রশ্ন করা অন্যায় নয়। বরং বৈদিক ধর্ম ও দর্শন প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে। এমন কি স্রষ্টা আছে কি নেই সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও অন্যায় নয় বৈদিক শাস্ত্রেও। আব্রাহামিক যত ধর্ম আছে, ইসলাম, খৃষ্টিয় ও ইহুদী ধর্মে স্রষ্টা ও ধর্ম বিষয়ে যাতে প্রশ্ন না করতে পারে তার জন্য "ব্লাসফেমী" আইন আছে। যা ভারতীয় ও বৈদিক শাস্ত্রে নেই। এমন কি "ব্লাসফেমী" শব্দটির কোন সংস্কৃত ভাষায় প্রতিশব্দও নেই।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী একমাত্র মুতাজিলা সম্প্রদায় ছিলো যুক্তিবাদী। বেশ কিছু দিন তারা যুক্তিবাদ ও দর্শন চর্চা করেছেন। এক সময় মুতাজিলাদের বহিস্কার করা হয়, জেলে ভরা হয়৷ অমুসলিম ঘোষনা করা হয়। মুতাজিলাদের সকল রচনা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কট্টর মুসলিম পন্ডিতদের মুতাজিলাদের সম্বন্ধে সমালোচনা করে লেখা পুস্তক থেকে মুতাজিলাদের সম্পর্কে জানা যায়।
মুতাজিলা তো দুরের কথা মিশরীয় শ্রেষ্ঠ পন্ডিত, সাহিত্যিক "আবু আলা আল মা আররীর" লেখাই গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। ৯০ দশকে তার লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপলেও এখন সে লেখা স্বপ্নেও কেউ ছাপার দুঃসাহস দেখাবে না।
একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্রে মুক্তচিন্তার চর্চা ও বিকাশ না ঘটলে তা পেছন দিকে চলতে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। আর মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার, প্রকাশ করতে নূন্যতম যে সমাজিক অবস্থান থাকা দারকার আজকের বাংলাদেশে তা নেই। কারা এর পরও মুক্তচিন্তা নিয়ে কথা,বলতে সামনে আসবে? কেন না 'লেখক ইক মার ডাল নে কা চিজ হ্যায়! ' তবুও কেউ না কেউ বলবে, লিখবে। যদিও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পৃথিবীর ভালো বা মন্দ কোন কাজই প্রচার প্রসার সম্ভব নয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours