Fiture
শুভদীপ গুপ্ত, লেখক, কলকাতা:

এই প্রবন্ধের আজকের লেখা লিখতে গিয়ে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা বলবো।  ঘটনাটা আমার মনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল। পড়বার পরে বেশ শঙ্কিত হয়েছিলাম।  আমিও নিজের অজান্তে এমন কিছু করে ফেলছি নাতো বা করে ফেলবো নাতো যা প্রকৃতিতে নতুন কোন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। আজও সেই শঙ্কা আমি অন্তরে লালন করি এবং আমি মনেও করি এই শঙ্কা থাকার প্রয়োজন আছে। আমি চাইবো নীচের ঘটনাটা জানবার পর আপনারাও আমার মতন শঙ্কিত হবেন এবং নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে এই ধরনের হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকার চেষ্টা করবেন।

ভদ্রলোকের নাম থমাস অস্টিন। একজন ইংরেজ ঔপনিবেশিক। সামান্য আমোদের জন্য নেওয়া তাঁর মামুলী একটা পদক্ষেপই তাঁকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ করে দিয়েছে ভয়ঙ্কর হঠকারী এক সমস্যার জন্মদাতা হিসেবে। গল্পের মতন শোনালেও আদ্যান্ত সত্য ঘটনাটা একটু বিস্তারিত ভাবেই বলি। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য থমাস সাহেব সপরিবারে ১৮৩৭ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেন। তো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটার জনসংখ্যা বরবরই যে একটু কম এ আমরা সবাই জানি, তখনতো আরো কম ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই থমাস বেশ বোর হচ্ছিলেন সেদেশে গিয়ে। তাই তিনি ইংল্যান্ডে বসবাসকারী এক বন্ধুকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন জাহাজে করে কিছু খরগোশ পাঠানোর জন্য। উদ্দেশ্য আর কিছু না, সেই খরগোশগুলোকে বাড়ির আশেপাশে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর অবসর মত নিজে বা বাড়িতে আসা অতিথিরা মাঝেমধ্যে শিকার করবার শখ মেটাবেন ওইগুলোকে শিকার করে। তো সেই পরিকল্পনা মত ১৮৫৯ সাল নাগাদ জাহাজে করে বারো বারো চব্বিশ জোড়া ভিন্ন প্রজাতির খরগোশ থমাসকে পাঠানো হল। ঘটনাক্রমে অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া খরগোশদের বংশবৃদ্ধির জন্য বরাবরই বেশ অনুকূল। তাই উপযুক্ত পরিবেশ এবং ভিন্ন প্রজাতি, এই দুইএর কারণে তারা এক শক্ত সমর্থ নতুন প্রজাতির খরগোশের জন্ম দিল। ব্যাস তার পাশাপাশি জন্ম হল এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের। কেন? সেটাই বলছি।

উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে সেই বারো জোড়া খরগোশ থেকে জন্ম নিল লাখো লাখো খরগোশ। আর সেই লাখো খরগোশ ক্রমশ ছড়িয়ে পরতে লাগলো দিগ্বিদিকে। তছনছ করতে লাগলো গাছপালা, প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্য। নির্বিচারে ধ্বংস হতে লাগলো বন বাদার। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য প্রাণীদের অবস্থা টাইট হয়ে পড়লো। ইকো সিস্টেম প্রায় ভেঙ্গে পরবার জোগাড়। তখন তৎকালীন সরকার মাঠে নামলো। শুরু হল খরগোশ মারা। এমনকি বছরে প্রায় দু লাখের উপর খরগোশ নিয়মিত মারা হতে লাগল। কিন্তু এর পরেও তাদের বংশ বৃদ্ধিতে বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হল না। তারপর ১৮৮৭ সালে সরকার থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হল খরগোশ মারার কোন অভিনব পন্থা কেউ আবিষ্কার করে দিতে পারলে তাকে ২৫ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে। নাঃ তাতেও অশ্বডিম্ব ছাড়া কিছুই এল না। এরপর প্রস্তাব নেওয়া হল খরগোশদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেড়া দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী ১৯০১ সাল থেকে এক দীর্ঘ বেড়া দেওয়া শুরু হয়। ওদিকে কিন্তু খরগোশের দলও পাল্লা দিয়ে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। বেশি না ১৯৫০ সাল নাগাদ সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬০ কোটিতে। এই বিশাল সংখ্যার খরগোশ সে দেশের প্রায় তিন চতুর্থাংশে তাদের আধিপত্য কায়েম করলো। এদের উপদ্রবে গাছপালা এমন হারে ধ্বংস হতে শুরু করে যে শুরু হয়ে গেল ভয়ঙ্কর মাটি ক্ষয়। তার জেরে অনেক নদীর গতিপথ পর্যন্ত পালটে যায়, যার প্রভাব পরতে শুরু করে এমনকি আবহাওয়াতেও। তারপরই তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান সরকার ভয়ানক শঙ্কিত হয়ে পরেন, এবং দায়িত্ব তুলে দেন বৈজ্ঞানিকদের হাতে। এরপর দীর্ঘ গবেষণায় বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করলেন এক অন্যরকম ভাইরাস। যা জমিতে ছড়িয়ে দিলে খরগোশের বৃদ্ধি নিয়ত্রণে আনা সম্ভব। আর সেই প্রথম মানুষ আর খরগোসের লড়াইতে মানুষের জয়লাভ হল। অর্থাৎ খরগোশের বংশবৃদ্ধি অনেকটাই নিয়ত্রণে আনা গেল। ষাট কোটি থেকে ক্রমশ সংখ্যাটা কমে দাঁড়ালো প্রায় দশ কোটিতে। এবং সেই দশ কোটি সংখ্যাটাও অনেকটাই বৈজ্ঞানিকদের ইচ্ছানুসারে নিয়ত্রণ করা সম্ভব হল তখন থেকে। তো এই অবধি পড়ার পর যারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তাদের বলি দাঁড়ান মশায়,একটু দাঁড়িয়ে যান। যুদ্ধ কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। কারণ খরগোসরাও অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র ছিল না।

তাই প্রায় চল্লিশ বছর টানা মানুষের ইচ্ছাধীন থাকার পর ১৯৯১ সাল থেকে তাদের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তাও নেহাত কমসম নয়, প্রায় তিরিশ কোটিতে পৌছে গেছে তখন তারা। কি ব্যাপার? না কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরলো, যে ভাইরাস জমিতে ছড়ানো হোত এত বছর, জিনগত ভাবে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা খরগোশরা এখন তৈরী করে ফেলেছে!!! বুঝে দেখুন কান্ড। আবার ডাক পড়ল বিশেষজ্ঞদের। তারা জানালেন যে অন্যান্য সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি যে বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনা উনিশস্য সালের প্রথম দিকে নেওয়া হয়েছিল সেটাও আবার চালু করতে হবে। সেই মতো আবার বেড়া দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়। এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ অবধি পরিধিতে বাড়তে বাড়তে ২০০৭ সাল নাগাদ সেই বেড়া পৃথিবীর দীর্ঘতম বেড়ায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন ভাইরাস আবিষ্কার করে এবং তা ব্যবহার করেও খরগোশের জন্মবৃদ্ধি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে আপাতত। প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ করা হয় শুধুমাত্র এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চালু রাখার জন্য।

তাহলে এবার ভেবে দেখুন দেড়শো বছর আগে কোন এক মানুষের সামান্য বিনোদনের উদ্দেশ্যে নেওয়া এক সামান্য পদক্ষেপ কি ভয়ঙ্কর হঠকারী কান্ডে পরিণত হয়ে মানব সভ্যতাকেই কত্ত ভয়ানক এক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে !! যার জের টেনে চলেছে একটা মহাদেশ, এখনো।

হঠকারিতার আর এক ভয়াবহ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এই প্রতিবেদন শেষ করবো। কদিন আগে একটা ছবি উঠে এসেছিল খবরের কাগজের পাতায়, ফেসবুকের দেয়ালে, অনেকেই দেখেছেন। মহাসমুদ্রে ভাসমান জমাট পদার্থের এক সুবিশাল খন্ড। যা কিনা আয়তনে ফ্রান্সের গোটা ভূখণ্ডের দ্বিগুণ। তা আর কিছু নয় বর্জ্য প্লাস্টিকের জমাট তাল। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল সাগরে ফেলা হয়, যা জলজ প্রাণীর জন্য এক ভয়ঙ্কর হুমকি। সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক প্রতিবছর সাগরে পতিত হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। শুধু সমুদ্র কেন স্থলভূমিতেও প্লাস্টিকের লাগামছাড়া ব্যবহার পয়োনিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বন্যার কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে বারংবার। সাম্প্রতিক অতীতে যার বহু উদাহারণ আমরা দেখেছি দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন শহরে। কয়েকমাস আগে এই গ্রহের সবচেয়ে উঁচু জায়গা এভারেস্টের উপর থেকেও নেপালের এক অভিযাত্রী দল পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে দু টন মানববর্জ্য নামিয়ে এনেছেন যার বেশিরভাগটাই প্লাস্টিক। 
উপরের উদাহারনগুলোই দেখিয়ে দেয় এই পৃথিবী নামে গ্রহটায় বসবাসকারী লক্ষ কোটি প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষই নিজেদের লোভ এবং হঠকারিতার জন্য কি ভয়ঙ্কর ভাবে নিজের এবং অন্যান্য সমস্ত প্রানীদের বিপদ ডেকে আনছে। এর আগেও বলেছি  হঠকারী আচরণ অন্যান্য আরো বিভিন্ন প্রাণীরাও করলেও তার পেছনে এক সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা সেই প্রাণীর আচরনের জন্য পরিবেশে কোন কুপ্রভাব পরে না কখনোই। কিন্তু এই মানুষ নামে প্রানীটি তার হঠকারিতায় ধ্বংস করছে নিজের প্রজাতিকে সেই সঙ্গে এই গ্রহটাকেই।  (সমাপ্ত)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours