স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

ভিক্টোরিয়ার সামনে  গত কয়েকদিন আগে জন্মদিনকে স্মরণীয় করতে চেয়েছিলেন পাল দম্পতি। প্রকৃতি কেড়ে নিল সেই আনন্দ। ইন্দ্রের অস্ত্র লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল।এরকম ভাবে প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ২৭০০জনকে কেড়ে নয় প্রকৃতি।

মনে আছে সেই ছোটবেলায় পড়া বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের ঘুড়ি দিয়ে বিদ্যুৎ ধরে বিদ্যুৎ আবিস্কারের কথা। সেই সময়েই মানুষ জেনে গিয়েছিলেন , ওই আকাশ থেকে মাটিতে যে আলোকের ঝলকানি মেঘ থেকে নেমে আসে, যাকে আমরা বাজ বা বজ্রপাত নামে জানি সেটা আর কিছুই নয় , সেটি উচ্চ ক্ষমতা বা শক্তির বিদ্যুৎ তরঙ্গ।

হিন্দু শাস্ত্র মতে ইন্দ্রের হাতের অস্ত্র এই বজ্র , গ্রীক দেবতা জিউসও নাকি বজ্রের দেবতা, আবার পেরুতেও আছেন বজ্রের দেবতা। মেঘের আড়াল থেকে তিনি এর প্রয়োগ করেন। 

সারা বিশ্ব জুড়ে এই বজ্রপাতের কারণ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। কেন এই ভারত ও বাংলাদেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে, আর সেই কারণে প্রাণহানিও বাড়ছে ? কেনই বা শহরের বুকে এত বাজের গর্জন আর নেমে আসা ? এসব নিয়েই এখন গবেষণা চলছে জরুরী ভিত্তিতে। 

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন , সারা বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যে হারে বেড়ে চলেছে , সেটাই এর একমাত্র কারণ, দ্বিমত রয়েছে এই মতবাদেও, অন্য দলের মতে , পরিবেশ দূষণ, ও সবুজ ধ্বংস সঙ্গে নগরায়নের ক্রমবর্ধমান পরিস্তিতিই এর জন্য দায়ী।তবে জলবায়ুর পরিবর্তন ও অঞ্চলভেদে এর প্রভাবের কারণেই তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে আমাদের পরিবেশে । সেটাই নিয়ে আসছে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়।বিজ্ঞানীদের মতে যখন আমাদের পরিবেশে তাপমাত্রা প্রচন্ড্রকম বেড়ে যায়, আর এই কারণে প্রচুর জলীয় বাস্প তৈরি হয়, এই জলীয় বাস্পই ঝড় ও বজ্রপাতের প্রধান কারণ।বাতাসে জলীয় বাস্প বেড়ে যাওয়া মানেই এই দুই প্রাকৃতিক কারণের বেড়ে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা আরো বলেছেন, ১ ডিগ্রী তাপমাত্রা যদি বছরে বাড়ে তাহলে তাহলে গড়ে ঝড় ও বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়বে ১২ শতাংশ।

আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের গোড়া পর্যন্ত বিহারের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তখন বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প ভরা বায়ু প্রবাহ এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এই ছুটে আসা আর্দ্র বায়ু প্রবাহ এই দুইয়ের সংঘাতে একটি-দুটি করে বজ্র মেঘের সৃষ্ট হয়।আর সেগুলো তীব্র গতিতে মাথা তুলতে থাকে। এই মেঘগুলো থেকে নিঃসৃত শীতল ঝড়ের জাপটা সামনের দিকে আঘাত করে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ুস্তর ওই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে ওপরে উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গায় নতুন করে বজ্র-মেঘ সৃষ্টি হয়।আর বজ্র আঘাত হানে যে অঞ্চলে এই বজ্র মেঘটি অবস্থান করছে সেই জায়গায়। 

বেশ কয়েক বছর ধরেই এন সি আর বি‘র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর তালিকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যে মৃত্যুর কারণগুলি দেখা যাচ্ছে , যেমন বন্যা, দাবদাহ, ভুমিকম্প , এগুলির থেকেও ছাড়িয়ে গেছে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর ঘটনা।এন সি আর বি আরো জানিয়েছে যে আমাদের দেশে প্রতি বছর ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান , এই একটি কারণেই।

আসা আমাদের শহরের কথায়। শহর গত এক বছরে এত বজ্রপাত আর প্রাণহানির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি কেউ । কি এমন ঘটল যে এমনভাবে বজ্র নেমে আসছে আমাদের শহরের বুকে ?

এর কারণ হিসাবে পরিবেশবিদরা দায়ী করছেন শহরের পরিবেশকে। শহরের তাপমাত্রা গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে সবুজ ধ্বংসের কারণে, জলাশয় ভরাটের কারণে । আর সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই আমাদের এই শহরের উপর চলে আসছে বজ্রগর্ভ মেঘ, আর ভূপৃষ্ঠের অপরের যে স্তর সেটিও নানা কারণে এতটাই দুষিত হয়ে উঠেছে , যে বজ্রপাতের বা ওই বিষয়টাকে আকর্ষণ করার নানা উপাদান নিয়ে একটা উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে, ফলে বাজ নেমে আসছে আমাদের শহরে।

আর্কিটেক্ট শমিত বিশ্বাস অবশ্য বেড়ে ওঠা নগরের বহুতল  ও সেই বাড়িগুলিতে ব্জ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা না থাকার কারণকে যুক্ত করেছেন এর সঙ্গে। এক সময়ে প্রতিটি বহুতলে একটি বিশেষ উপায়ে বজ্রপাত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হত। এই পদ্ধতিতে ওই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক  শক্তিকে একেবারে তার গন্তব্যস্থল মাটির ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এখন কেউ ই আর বিশেষভাবে এদিকে নজর দেয় না। তার একটাই কারণ সেটা মনে হয়, সেটা হল খরচা বেড়ে যাবে বলে। 

বাজ সব সময়েই চায় একটি পরিবাহি ক্ষেত্র , যাকে সে অবলম্বন করে একেবারে মাটির ভিতরে চলে যাবে। কেননা ভু পৃষ্ঠই তাকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।বাজ যখন বায়ু মন্ডলের মধ্যে দিয়ে যায় , তখন প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন করে। আর এই কারণে বায়ূর অপসারণ ঘটে খুব তাড়াতাড়ি। এই তাপমাত্রা আশ পাশের সমস্ত বায়ু মণ্ডলকেও উৎতপ্ত করে তোলে। কয়েকদিন আগে এক প্রতিশ্রুতিবান ক্রিকেটার দেবব্রত পাল এই কারণেই পুড়ে গিয়েছিলেন বাজ পড়ার ঠিক পর মুহূর্তে , আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল। আর গত এক মাসে আমাদের রাজ্যেই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। ইতিমধ্যেই তা ৩৩ ছুঁয়েছে। 

 আবহাওয়াবিদরা জানান, বজ্র সরাসরি মাটিতে পড়ে না। বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর পরিবহন পদ্ধতির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটিতে চলে গিয়ে নিউট্রাল হয়ে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে বজ্র পতিত হয়। একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন ,মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্র পড়ে। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্র পড়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি তাহলে বজ্র মানুষের ওপর পড়বে।একারণেই হয়ত শহরে বেশি করে বজ্র মানুষকে আঘাত করছে। 

আমাদের শহর কলকাতায় ক্রমেই নেমে আসছে এক ভয়ংকর সময়। যেখানে বাংলাদেশের মত একটি বজ্রপাতের ক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে। নয়ত বা আমাদের পার্শ্ববর্তি রাজ্য বিহারের মত একটি বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিলের সঙ্গী হয়ে উঠবে। এখন থেকে যদি না আমরা সারা শহর জুড়ে বজ্রপাত প্রতিরোধ মূলক ক্ষেত্র তৈরি না করি।   

শহরের বিশিষ্ট আর্কিটেক্ট শমিত বিশ্বাস কিছু টিপস দিয়েছেন সেগুলি দেখে নেওয়া যাক - 

১) ঝড় বৃষ্টির সময়ে বজ্রবিদ্যুতের সম্ভাবনা থাকলে জলের সংস্পর্শের যেকোনো কাজ, যেমন, বাসন ধোওয়া, পুকুরে, পুলে বা শাওয়ারে স্নান করা ইত্যাদি পরিহার করুন। ২) প্লাম্বিং এর কাজ বন্ধ রাখবেন কারণ ধাতব জলের পাইপ অনেক সময় তড়িৎবাহী। পাইপগুলি পি ভি সি’র হলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। ৩) ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, যথা কম্পিউটার, মোডেম, বার্নার, স্টোভ, এ.সি মেশিন ইত্যাদির প্লাগ খুলে দেবেন।৪) আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল্ যুক্ত ল্যান্ডলাইন ফোন  ব্যবহার করবেন না। কর্ডলেস ফোন নিরাপদ।। ৫) ভেজা , স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় যেমন, বেসমেন্টে,ছাদে, বাগানে বেশিক্ষন দাঁড়াবেন না। ৬) দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকবেন না। ল্যাম্পপোষ্টে হাত  বা হেলান দেবেন না।আর সবথেকে প্রয়োজনীয় কথা , পরিবেশ দূষণ রোধ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বহুতলকে বজ্রপাত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করুক প্রশাসন।     

সব শেষে বলি, পরিবেশকে বাঁচালেই রক্ষা পাব আমরা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours