প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের প্রলয়গভীর খাত তো এক এক তরঙ্গ। এমন করেই ভেসে আসে নিহিত পাতালছায়া পরিধি, আর তার হাত ধরে আছে ধাতুর টান। দীর্ঘদিন সভ্যতার সহাবস্থান বুঝিয়ে দেয়, পৃথিবী নিয়মের অধীন। কার্য কারণ নিয়েই তো পথ চলা। প্রয়োজন হলো পথ, সে ঝুঁকে যায় দূর হতে দূরে দুর্নিবার।  এমন করেই তো বলতে ইচ্ছা করে, "স্বপনসম মিলাবে যদি কেন গো দিলে চেতনা ", আর চেতন সুখ নিতেই গড়ে উঠল দেউল, চৈত, উপাসনাস্থল ; নির্মাণ হয়েছিল তীর্থঙ্কর মূর্তি ও তাদের শাসন যক্ষিণী। শব্দচারী উদ্যম তো পাড়া হয় না, কোনো মফসসল হয় না , হয় কেবল জীবনের তাগিদ। এমন করেই নদীর তীর জুড়ে গড়ে ওঠে বিবিধ তীর্থস্থানগুলি। মুদ্রার সাথে সাক্ষাত হয় কালের, কথক হয় পথ,  ইতিহাস। 

 সড়ক পথ বয়ে আছে বানিজ্যের সন্ধান৷ তাম্রলিপ্তের পথ যদি স্রোতের বুকে আস্ত তরঙ্গের বে আব্রু কথা বলে, তবে  অপ্রকট ভাবে বলবে - সড়ক, মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে উত্তরে রূপনারায়ণের  পশ্চিমতীর বরাবর ঘাটাল মহকুমার দাসপুর - পান্না- ঘাটাল হয়েই তো শিলাই অতিক্রম করে কখনো দক্ষিণ আবার কখনো বামে রেখে বাঁকুড়ার উপর দিয়ে রঘুনাথপুর ও তেলপুরের উপর দিয়ে দেহাতি মেয়ে হয়ে সীমারেখার কথা বলে৷ এখানে প্রামান্য দলিলে বলা হয়, 
" Roads would naturally lead up from Tamluk to Patna to Monigir and elesewhere. "...

জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্র বলে, " Mahavira used this route for his journey and this region was called  Ladha comprising vajiabhuni and Subbhabhumi."
 তথ্য বলে যে, মহাবীর রাঢ় দেশে দ্বাদশ বর্ষ যাপনেই ধর্মপ্রচার করেছিলেন। চলে গেছে কালের গভীরে অসংখ্য পদচিহ্ন। তবু কাল খুঁজে নিতে আজও ভোলে নি পৃথিবীর নিঃশ্বাস। খুশির পালক ছড়িয়ে তাই শিলাবতীর তীর কথা বলে ইতিহাসের কানে৷ সময়ের সন্ধিক্ষণ বলে, খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে সেই সময়ের অভ্যুদয় ঘটে। পাহাড়কেন্দ্রিক দল রাঢ়ের বুকে বহুল জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি ও দেউল প্রতিষ্ঠা করে। আর পরিভ্রমণকে সাঙ্গ করেই তৃতীয় শতকে জৈনধর্ম প্রচারিত হয়। 

পথের ধুলোয় পথ খুঁজে নিয়েছিল জৈনধর্ম, ১১৩৫ খ্রীস্টাব্দ। ঐ সময়ে জৈনধর্মাবলম্বী গঙ্গবংশীয় রাজা অনন্তবর্মন চোড়্গঙ্গ, বাঁকুড়ার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত সাম্রাজ্য  বিস্তার করে৷ জীবনের ঘুণ জমেই কি আদিমের স্বাদ এই ধর্মে, এমন মতবাদ বিরল নয়। কিন্তু আন্তরিক আহ্বানে গড়তে থাকে ধর্ম, নামান্তর অবহেলার ঘরে রোগ৷ 

আজ আর কৃতকর্মটুকু ছায়ার মতো  অবহেলিত নয়, তাই থানা ভিত্তিক হয়েই জৈন প্রত্নস্থলগুলি আলোচনা করলাম। 

জড়িষ্যা ঃ

সিমলাপাল থানার অন্তর্গত নিদর্শন এক ক্ষুদ্রাকৃত (১০")  জৈনমূর্তি, যা এক ব্যক্তির তুলসীতলায় স্থান পায় - সম্পূর্ণ নয় শেষকৃত্য। তবে অনুমান করা যায়  এর নির্মাণকাল দ্বাদশ - এয়োদশ শতাব্দী৷ পোড়ামাটির  কূপ সংস্কারের সময় কূপের ৭/৮ ফুট গভীরে এক জৈনমূর্তি উদ্ধার হয়। অপরদিকে মহাজনতড়ার কাছেই বেলেপাথরের জৈনমূর্তি পাওয়া যায়। উচ্চতা আনুমানিক প্রায় ১০" - মস্তক ও পদযুগবিহীন। বর্তমানে এটি বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরকীর্তি ভবনে সংরক্ষিত আছে। বর্তমান কিন্তু কোমাগ্রস্থ স্বপ্ন  নয়, শয়নযানের মতো ভাবনাগুলো শায়িত আছে যক্ষিণী ও বসুবলদের সুখে৷ এই অঞ্চলে আমলক পাওয়ার ফলেই বোঝা যায় যে, এখানে আমলক  মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। 

সিমলাপাল ঃ 

রাজবাড়ি ছুঁয়ে আছে, ১১ টি ভিন্ন প্রকৃতির প্রস্তরমূর্তি।  গঠনশৈলী বেয়ে ইতিহাস কথা বলে নিঃসংশয়ের জৈনমূর্তি৷ মন্দিরের ডান ও বামদিকে দুই দিগম্বর। প্রথম মূর্তির পরিমাপ ৩'৬" ×১'১" উভয় পাশ ঘিরে আবেষ্ঠনীর ১২ জন যক্ষ ও যক্ষী । মূর্তিটির লাঞ্ছনভাগে সিংহ থাকায় বোঝা যায়, এটি ২৪ তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের মূর্তি৷ অপর মূর্তিটির লাঞ্ছনভাগে হরিণ বিদ্যমান।এটি তীর্থঙ্করের শান্তিনাথ মূর্তি৷ মূর্তিটির আয়তন ৪'৫" × ১'৯"। অক্ষরের পাশে শুয়ে আছে প্রতীকী।  আর বিবিধ চিহ্ন অস্তিত্বের অনুভবী রূপক বিনুনি প্রকাশ করে৷ আম্রশাখা সহ আম্রফল, হাতে দুটি শিশু মণ্ডল, সিংহ - জৈন তীর্থঙ্কর নেমিনাথের শাসন যক্ষিণী অম্বিকা মূর্তি তুলে ধরে। । 

রামনগর ঃ

হাততালি ভুলে, হতচকিত "ওলাছুট " দৌড়ে পৌঁছে যেতে হয় কিরীটি সিংহবাবু উঠান বাড়ি৷ চার দেওয়ালের মন্দিরের পটভূমি ছুঁয়েই আছে  খোদিত আছে জৈন তীর্থঙ্করমূর্তির দুই প্রস্তর মন্দির বিদ্যমান।  একটি উচ্চতা ৩ ফুট, বেদীভূমি ৪'৫" এবং অন্যটির উচ্চতা ২'৬"। 

গোতড়াঃ

প্রাথমিকে বিদ্যলয়ের সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই নির্মিত হয়েছে অম্বিকামূর্তি। 

গাড়রাঃ

জৈনদের ১৬ তম তীর্থনাথের নাম শান্তিনাথ।সেই শান্তিনাথ পার্শ্ববর্তী পুকুর থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি কালীমূর্তি, একটি জৈন হরগৌরী মূর্তি ও একটি মণিভদ্র। 

অলকধারানা:

জুনবাঁকড়ার উল্টোদিকে খোলা আকাশের নীচে রয়েছে জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি। আয়তন - ১'১০" × ৯ "।

লক্ষ্মীসাগর ঃ

এই সাগরের দক্ষিণে রঙ্কিনীতড়াতে একটি পাথরের উপর ২৪ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত ছিল। এখানে রঙ্কিনী মূর্তির উচ্চতা প্রায় ২.৫ ফুট। কাছাকাছি গ্রামে আলোকিত হয়ে আছে দুই চিহ্ন যুক্ত বাহন - একটির নাম পার্শ্বলা, অন্যটি ভাঙাদেউলি। 

১০ ফুট ভূ অভ্যন্তরে জৈন চৌমুখা বাণেশ্বর শিব হিসাবে পূজিত হয়। অসুখের মতো ঝাপসা হয়ে আছে ভগ্নাবশেষে আরো দুই দিগম্বর মূর্তি। 

শিলাবতীর দক্ষিণতীর নকল চোখের মতো বিলুপ্ত  মস্তক বিহীন ও অক্ষত জৈনমূর্তি উদ্ধার করে, যার কোন হদিশ নেই। 

আছে মাদারিয়া, বাগাল, হরিহরপুর, আমাকান্দা, লায়েকপাড়া ও জামদা। ছায়াকে আপন করেই তো কর্মশালায় প্রাণবায়ু যাপন ।  

স্রোতস্বিনী সমর্পণ যেন চাঁদ ধুয়ে যায় পথের প্রবাহ ঘুম। মন্দ নয়, স্থির..  শুধু চলা - পাতা ছুঁয়ে শব্দ, শিলাই বিবৃতি।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. অসাধারণ তথ্য পাওয়া গেল তোমার কাছে।খুব সুন্দর লেখনী মুগ্ধ হলাম সুধী । এই ভাবেই সুন্দর লেখা উপহার চাই। ভালো থেকো সুখে থেকো। তোমার সমস্ত চাওয়া পাওয়া পূর্ণতা পায় এই আশীর্বাদ রইলো। আমার আয়ু তোমাকে দিলাম। আর আর আর এগিয়ে যাও তোমার আলোর পথে ।।

    ReplyDelete