কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
কিছুতেই কাউকে মনে ধরে না। তা ধরবে কী করে? আপনি তো স্যাপিওসেক্সুয়াল।
ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন নাতো কী বললাম।
কিন্তু সেই আপনি হঠাত একদিন দুম করে প্রেমে পড়ে গেলেন। কিভাবে? না, মোটেই মদনদেবের চক্রান্ত না। চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়ার গল্পটা মনে আছে তো? মণিপুরী রাজকন্যা। পুত্রসম যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ করে, মহারাজা গড়ে তুলেছিলেন আদরের কন্যাকে। তাই রাজকুমারীর মদ্দা মদ্দা হাবভাব। মনেও শরীরেও। বনের মধ্যে সাক্ষাত ব্রাহ্মণ বেশধারী অর্জুনের সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তবে দর্শন প্রথম হলেও, প্রেমসঞ্চার হয়েছিলো ধনুর্ধর অর্জুনের বীরত্ব কাহিনী শোনার পরেই।
সোজা কথায়, ফিল্ড তৈরি ছিল অনেক আগেই। বাকী ছিলো শুধু ওই ছক্কা মারাটাই।
ঠিক একই রকমের আরেকটা ঘটনা শোনাই। মণিপুর না, খাস কলকাতার এক কলেজের ঘটনা। এই কাহিনীতে বীরত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। এখানে জ্ঞানের পরিধি আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলো প্রেমকে। বছর দশেক আগের কথা।
মানুষটা দেখতেও সুবিধার না। কেমন মোটা বেঢপ। কালো। তবে কালো ফ্রেমের মোটা লেন্সের চশমার আড়ালে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। কলেজে তাঁর জুলজির ক্লাস করতে গিয়েই প্রেমে হাবুডুবু খেলো এক ছাত্রী। বাপের বয়সী অধ্যাপকের সঙ্গে কন্যাসম ছাত্রীর মানসপ্রেম। একতরফা। অধ্যাপক ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না, ছাত্রীর সেই 'না বলা বাণী'। ছাত্রীরও মুরোদ ছিলো না অধ্যাপককে সরাসরি প্রেম নিবেদনের।
"কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়!"
তিন বছর পর বিদায় কলেজ। বিদায় অধ্যাপক। মন না মানলেও বাঁধন ছিন্ন করা ছাড়া গতি ছিলো না। মনের প্রেম থাকলো মনেই। বেশ কয়েক বছর পরের কথা। ছাত্রী নিজেও তখন ডাক্তারি পাস করেছে। একদিন আচমকাই গিয়ে দাঁড়ালো অধ্যাপকের মুখোমুখী। বুক ঢিপঢিপ। পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম। সেই প্রথম স্বপ্নের মানুষকে ছোঁয়া। কাঁটা দিলো গায়ে। 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' মোটেই না। এ এক গভীর অনুভূতি। স্যার পুরনো ছাত্রীকে প্রথমটায় না চিনতে পারলেও, পরে চিনতে পারলেন।
"আপনাকে কিন্তু স্যার আসতেই হবে।" বিয়ের কার্ড এগিয়ে দিলো ছাত্রী। মন পড়ে রইলো স্যারের কাছে। ছাত্রী ঘর করতে চললো মা- বাবার পছন্দের পুরুষের। কী ভাবছেন, একটা ঠিকঠাক প্রেমও করতে পারলো না ছাত্রী? দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই। তন্বী। চটকও ছিলো চেহারায়। তার ওপর মেধাবীও। একেবারে সোনায় সোহাগা। তবু সেই মেয়েটার কপালে একজন প্রেমিক জুটলো না?
"আসলে স্যারকে ভালবেসে আর কাউকে ভালবাসা হয়ে ওঠেনি," নিজের মুখেই স্বীকার করেছিলো সেই মেয়ে। সেদিনের সেই ছাত্রীর কাছে স্যারের চেহারা ছিল গৌণ, মূল সুরটা বাঁধা ছিলো স্যারের মেধায়।
এমনই বিচিত্র ধারার প্রেম স্যাপিয়োসেক্সুয়ালের।
"নীরবে থাকিস সখী
ও তুই নীরবে থাকিস!"
অধ্যাপকের পরেই লাইব্রেরিয়ান, তারপর কবি, শিল্পী, দার্শনিকের মতো একটু 'বেহিসেবী হাওয়ার' বিপরীত লিঙ্গের মানুষরাই স্যাপিয়োসেক্সুয়ালদের সফট টার্গেট। জানাচ্ছেন 'দ্য সেক্সি লাইব্রেরিয়ান অ্যান্ড বিগ বুক অফ এরোটিকা'-এর লেখক বিক্স ওয়ার্ডেন। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখছেন, এই স্যাপিয়োসেক্সুয়ালদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যৌনাঙ্গ হলো মনের মানুষের মগজখান। আর সেই মানুষের মেধাতেই উৎকৃষ্ট যৌনতার স্বাদ।
কেন? কারণ এই ধরনের মানুষরা বহু বিষয়ে কথা বলে জমিয়ে দিতে পারেন। এঁদের জ্ঞানের ব্যাপক পরিধি স্যাপিয়োসেক্সুয়ালদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে কাছে টেনে আনে। চেহারা, প্রতিপত্তি এঁদের কাছে শেষ কথা কখনোই নয়। শেষ কথা মানুষটির মেধা।
তাহলে কি মণিপুর রাজকন্যাও স্যাপিয়োসেক্সুয়াল ছিলেন? অর্জুনের নিপুণ লক্ষ্যভেদের মেধাই গেঁথে ফেলেছিল পৌরুষে ভরপুর চিত্রাঙ্গদাকে। নইলে বনের মধ্যে সাধারণ ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনকে দেখেই, তিনি কেন প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে গেলেন? ঠিক তা নয়। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী চিত্রাঙ্গদা আগেই নিপুণ ধনুর্ধর অর্জুনের নাম শুনেছিলেন। জানতেন তাঁর বীরগাথাও। তাই ব্রাহ্মণবেশী নিজের পরিচয় দিতেই, রোমাঞ্চিত হলেন চিত্রাঙ্গদা। স্থান, কাল সব ভুলে তিনি মন দিয়ে বসলেন অর্জুনকে। তাহলে মণিপুর রাজকন্যাও কি স্যাপিয়োসেক্সুয়াল ছিলেন?
"ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি!"
হতেই পারে। কারণ গত আড়াই হাজার বছর আগেও স্যাপিয়োসেক্সুয়াল থাকার নিদর্শন দিয়েছেন ওয়াশিংটনের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্ববিদ মার্ক বেশ্চিক। এ ব্যাপারে তাঁর সহায় প্লেটোর লেখা 'দ্য সিম্পোসিয়াম'। যেখানে প্লেটো শারীরিক আকর্ষণ ছাপিয়ে, আত্মার আকর্ষণের তত্ত্ব শুনিয়েছিলেন। সত্য, জ্ঞানের পথ বেয়ে ঘনিষ্ঠতার উত্তরণ। বেশ্চিক বলছেন, গত আড়াই হাজার বছরেও সম্পর্কের কেমিস্ট্রি বদলায়নি।
তবে স্যাপিয়োসেক্সুয়াল শব্দটা এখনও ঝকঝকে তকতকে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলছে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্যাপিয়োসেক্সুয়াল শব্দটা চালু হয়। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার মতে, হোমো স্যাপিয়েন্স শব্দের মানে, জ্ঞানী মানুষ। স্যাপিয়েন্স মানে জ্ঞানী, আর হোমো মানে মানুষ। কোনও লিঙ্গ বৈষম্যের প্রশ্ন নেই।
তবে ইন্টারনেট পরিষেবার দৌলতেই কিন্তু স্যাপিয়োসেক্সুয়াল শব্দটা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে, মত গবেষকদের। কারণ ইন্টারনেটের তরঙ্গে সওয়ার হয়েই ছড়িয়ে পড়ে যৌনতার নানা অদ্ভুত, নিত্যনতুন কনসেপশন। মত আর মেধার ফুলকি ছড়ায় গ্লোবাল ভিলেজে।
'উল্ফিবয়' সাঙ্কেতিক নামধারী এক তরুণ। সেই প্রথম নিজেকে স্যাপিয়োসেক্সুয়াল বলে দাবি করে বসেন 2002 সালে। তবে তিনি ব্যাপারটা 1998 সালেই বুঝতে পেরেছিলেন বলে তাঁর দাবি। তখনই তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছিলেন স্যাপিয়োসেক্সুয়াল হিসেবে। তিনি বলেন, "এরপরেই আমার এই বিশেষ গোত্রের যৌনতার অনুভূতির কথা জানিয়ে, একটা পোস্ট করি রাশিয়ার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সার্ভিস 'লাইভ জার্নাল'-এ। ব্যাস, অমনি হইচই বেঁধে গেলো। একজন, দুজন করে অনেকেই ঢুকে পড়তে লাগল আমার দলে।"
কলকাতার কলেজের সেই মেয়েটিও কিন্তু সেদিন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, আচমকাই কেন সে অধ্যাপকের প্রেমে পড়ে গেছিল। বরং সে খানিকটা চাপেই পড়ে গেছিলো নিজের কাছে। কিছুটা অপরাধবোধও কাজ করতো। কিন্তু এতদিনে সেও বুঝতে পেরেছে, তাঁর সেদিনের প্রেম ছিলো নিষ্পাপ। আর ছাত্রীটি ছিলো ওই স্যাপিয়োসেক্সুয়ালদেরই একজন।
"তারে সে আঁধারে চিনিতে যে পারিনি
আমি পারিনি ফিরায়ে তারে আনতে!"
তবে স্যাপিয়োসেক্সুয়ালরা সংখ্যায় বরাবরই বিরল প্রজাতির। একশোজনের মধ্যে মেরেকেটে বড়োজোর আটজন। এই তথ্য দুনিয়ার সেরা দর্শনবিদ্যা বিষয়ক পত্রিকা 'জার্নাল ইন্টিলিজেন্স'- এর গতবছরের সমীক্ষার। বেশিরভাগ স্যাপিয়োসেক্সুয়ালরাই স্বীকার করেছেন, অন্যের বুদ্ধিমত্তা, মেধাই তাঁদের মন, শরীরে উত্তেজনা জোগায়। ওই মেধাবী মানুষজনের কাছাকাছি এলেই তাঁরা যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন। এঁদের পূর্বরাগ বলতে দর্শন, রাজনীতি বা ইতিহাস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা। জেগে ওঠে শরীর। তবে স্যাপিয়োসেক্সুয়ালের এই ঘনিষ্ঠতা যে সবসময় যৌনতায় গিয়েই শেষ হয়, এমনটা নয়। সম্ভবত তার জন্যই এঁদের মধ্যে এক 'প্লেটোনিক সম্পর্ক' তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ষোল আনা। যেমনটা হয়েছিলো সে যুগেও। রাধাকৃষ্ণের প্রেম। খালি হাতেই ফিরতে হবে জেনেও, কৃষ্ণকে সর্বস্ব দিয়ে বসেছিলেন শ্রীরাধে।
"কানু হেন প্রেম নিকষিত হেম
কামগন্ধ নাহি তায়!"
ঠিক কোন ধরনের মানসিকতা কাজ করে এঁদের মধ্যে? ধরুন এক কিশোরী। হাতে মোবাইল পেলেই হলো। ভিডিও গেমে মত্ত। মা তাকে দেখলেই বকা লাগায়, তোর দ্বারা পড়াশোনা হবে না। মায়ের গঞ্জনায় কিশোরী দুচোখের কোল বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। সাধ্যমতো চেষ্টা করে ভালো রেজাল্টের। ক্লাসে অবাক দুচোখে তাকিয়ে ভাবে, কতোই না জানেন স্যার! দুচোখ ভরে দেখে ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে। সে প্রাণমনে চাইতে থাকে, পড়াশোনায় সেরা ছেলেটাই হোক তার বয়ফ্রেন্ড। সে নিজে ভালো, তার মনের মানুষটাও ভালো। এটাই দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মাকে। তবে যদি মায়ের বকবকানি থামে! কিশোর বয়সের ওই প্রবণতা থেকেই হয়ত জন্ম নেয় স্যাপিয়োসেক্সুয়ালিটি।
ইন্টারনেটের দুনিয়া স্বাগত জানিয়েছে এই বিশেষ প্রজাতির প্রেমকে। 2016 সাল থেকেই চলে এসেছে স্যাপিয়োসেক্সুয়ালদের জন্য এক বিশেষ অ্যাপ 'স্যাপিও'। ওদিকে এখন 'ওকে কিউপিড' অ্যাকাউন্টে সাইন আপ করলেই স্ট্রেইট, গে, লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়ালের পাশাপাশি অপশন মিলবে স্যাপিয়োসেক্সুয়ালেরও। তবে মজা হয়েছে, এই প্রজাতির বাইরে থাকা মানুষজনদের নিয়ে। তাঁরা ঘোর সন্দেহের চোখে তাকান এই 'মেধাপ্রেমী' যৌনতার দিকে। ধুত্তোরি, যত সব বুজরুকি! এমনটাও বলে বসেন। তবে তাঁরা যে মারাত্মক ভুলটা করে বসেন তা হলো, মেধাবী আর চালাকদের গুলিয়ে ফেলা। তাই তাঁরা রেগেমেগে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, আমরা কি তাহলে শুধু হাবাগোবাদের সঙ্গেই প্রেম করি?
এবার একবার ভেবে দেখুন, আপনি ঠিক কোন দলে পড়েন? চালাক নাকি হাবাগোবা।
দরকার পড়লে আরও একবার ভেবে নিশ্চিন্ত হোন, আপনিও স্যাপিয়োসেক্সুয়াল নাতো!
(নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন সোহিনি মুখার্জি চক্রবর্তী)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours