জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

  দেবব্রত বিশ্বাস ছয়টি ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন। একমাত্র তিনটি গান ছাড়া আর ইংরেজি ছাড়া কোনটিই স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয় নি। এর জন্য গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে বিভিন্ন ভাষা শিখতেন। শেষ বয়সে ভোর চারটের সময় উঠে একটি সাধারণ টেপ রেকর্ডারে প্রায় ঘন্টাখানেক গান রেকর্ড করে রাখতেন । তারপরেই রাসবিহারী এভিনিউতে ট্রাম চলা শুরু হয়ে যেত। তখন ঐ শব্দে আর রেকর্ড করা যেত না।  এখন তাঁর প্রয়াণের প্রায় চল্লিশ বছর পর অশক্ত শরীরে অসুস্থ কন্ঠে ঘরে বসে রেকর্ড করা গানগুলি প্রকাশিত হচ্ছে । সেইগুলিই এখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের বেস্ট সেলার।
রবীন্দ্রনাথ জানতেন, তাঁর লেখা ও সুর করা গান বাঙালিকে গাইতেই হবে। দেবব্রতও জানতেন, তাঁর গাওয়া গান বাঙালীকে শুনতেই হবে।
একবার একজন রাশিয়ান জানা ভদ্রমহিলা দেবব্রতকে বললেন, 'আপনি রবীন্দ্রসংগীতের এত সুন্দর রাশিয়ান অনুবাদ গাইলেন কিভাবে ? মনে হচ্ছে কোনও রুশ গাইছেন।' স্বভাবরসিক দেবব্রত শুদ্ধ দন্ত্য 'স' উচ্চারণ সহযোগে বললেন, 'আমাগো ময়মনসিংহের ভাষার লগে তো রাশিয়ান ভাষার খুব মিল... অগো মতো আমরাও তো কই  - কস্ কি, যাস্ কই, খাস্ কি...'
বিদেশে অনেক চার্চেই তাঁর গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতের ইংরাজী অনুবাদ বাজানো হয়।
ভারতীয় সংস্কৃতি দলের হয়ে চিন সফরে গিয়েছিলেন। পান খাওয়ার নেশা ছিল। একবারে ছয়টি পান মুখে দিতেন। শুনেছিলেন, চিনে পান পাওয়া যায় না। তাই এক মাসের ভ্রমণে  সঙ্গে করে দেড় হাজার পান নিয়ে গিয়েছিলেন ।  পরবর্তী কালে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে  'অন্তরঙ্গ চিন' শীর্ষক একটি বই লেখেন। বইটি তৎকালীন চিনের সমাজব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আবহের এক মূল্যবান  ও ঐতিহাসিক দলিল । সম্প্রতি সুগত বসু তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণামূলক পুস্তক রচনার ক্ষেত্রে ' অন্তরঙ্গ চিন ' গ্রন্থের ঋণ স্বীকার করেছেন ।
একটু খেয়ালি মনের মানুষ ছিলেন। গান ছাড়াও ভালোবাসতেন তাস খেলা, রান্না করা। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে উত্তর কলকাতার সহকর্মীরা তার বাড়িতে আসতেন তাস খেলতে। বাড়ি সর্বক্ষণ সকলের জন্যই অবারিত দ্বার হলেও ঐ দিন কাউকেই সময় দিতেন না। একবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গিয়ে পড়েছিলেন এমনই এক দিনে। অনেকক্ষণ দরজায় দাড়িয়ে থাকার পর দেবব্রত ওকে খেয়াল করলেন। বললেন,  'আরে নায়ক যে! কিন্তু আজ তো কথা হবে না'। সৌমিত্র ফিরে গেলেন। একবার শিল্পী সংসদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল ।বলেছিলেন, 'উত্তমকুমার কে এসে বলতে হবে'। উত্তমকুমার  এসেও ছিলেন ।
রান্না করতেন অসাধারণ। নানারকম রেসিপি নিয়ে experiment করতেন। কতজনকে যে রান্না করে খাইয়েছেন। গৌরী ঘোষের কাছে শুনেছি, একবার রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান। পার্থ ও গৌরী ওনাকে আনতে গিয়ে দেখেন, উনি সবে চিকেন চাপিয়েছেন। তারপর সেই রান্না হল, সবাই খেলেন, তারপর গাড়িতে রবীন্দ্র সদন। সমস্ত রাস্তা শুধু রেসিপির গল্প করতে করতেই গেলেন। গানের কথাই উঠল না। এমন কি মঞ্চে ওঠার আগেও গৌরীকে রান্নার ব্যাপারে নানা পরামর্শ দিতে লাগলেন ।
মঞ্চে বসেই কিন্তু অন্য মানুষ। তখন তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের অবিসংবাদিত সম্রাট...
শেষ বয়সে হঠাৎই দাড়ি রাখা শুরু করেন। কাটবেন না - নাছোড়বান্দা। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, 'মরার পর পুড়াইতে সুবিধা হইবো।'  শেষপর্যন্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কণক বিশ্বাসের অনুরোধে দাড়ি কাটেন। 
শেষ দিকে... রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন ...রাস্তা পেরোতে হবে...অশক্ত অসুস্থ শরীর ...হঠাৎই সুচিত্রা মিত্রের হাত ধরে গেয়ে উঠলেন  - আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ চিনি না।
অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। চাকরি করতেন জীবনবীমায় - হিন্দুস্থান বিল্ডিংস-এ। সম্পর্কে  ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সত্যজিত রায়,রুমা গুহঠাকুরতা প্রমুখের আত্মীয়।
46এর দাঙ্গার সময় নববিবাহিত শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্রকে দেবব্রত অনেক দিন তার নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নিজে বাইরের ঘরে থাকতেন। একদিন কলিম শরাফিকেও ঐ ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তৃপ্তি মিত্র লিখেছেন যে ঐ সময় সমস্ত রকম পরিস্থিতির কথা ভেবে কিভাবে দায়িত্ববান দেবব্রত দীর্ঘদিনের চাল ডাল প্রভৃতি রসদ জোগাড় করে রাখতেন ।
ঐ সময়ই  শম্ভুর পিতৃবিয়োগ হয়। কয়েকদিনের ব্যবধানেই তৃপ্তির কোলে মাথা রেখে প্রয়াত হন দেবব্রতর গর্ভধারিণী ।  (ক্রমশ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours