প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
স্রোত কমে গেলে যন্ত্রণার ঘাঁটিতে আবছা শুকনো পাতা এসে জড়ো হয় ;
নদীর বুকে বালি বিছিয়ে রাখে তরঙ্গ..
খেয়ালের তাড়নায় সন্ন্যাসী আশ্রম,
ফসল জুড়ে আছে আলেয়া মিথ,
কাঙালেরা জানে মনের মন্বন্তর..
মরচে কাঁদে, কাপড় ফালিফালি,
আমি তখন ভালোবাসার ভিখারি।।
হ্যাঁ, এমন করেই আঁকড়ে আছে শিলাবতী নদী তীরবর্তী প্রস্তর। পুরুলিয়া যার উৎস, বাঁকুড়ার ইন্দাপুর থানায় ৫৬ কিমি গতিপথেই তো কথা বলে নয়নাভিরাম স্রোতধারা । যার এমন প্রকাশ, তার বিস্তৃতি বলবো না এমন কি হয়!! তালডাংরা আর শিমলাপুর ব্লকের সীমানা পেরিয়েই তার মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ আর, দ্বারকেশ্বরের সাথে মিলন না বললে যে, প্রজন্মের ফাটল ধরা পড়ে। পুরুষদৃষ্টির বুকে নারী নির্মাণ ভেবেই গড়বেতা পেরিয়ে ঘাটালের কিছু পূর্বে বন্দর নামক স্থান। স্বভাবসিদ্ধ প্রেমের মতো লাজুক, ভদ্র জয়পণ্ডা যে, তার উপনদী৷ কিন্তু, এতো বাস্তব সীমারেখার কানাকানি কথক, কারণ প্রমাণ্য দলিলের সাথে সাক্ষাৎকার নেই এই নদীর ইতিহাসে৷
আজ আমাদের তাই ভরসা করতে হয় পুরাতত্ত্বের উপর আর প্রত্নতত্ত্বের উপর। মেঘ পিওনের বুকে আঁচড় দিয়ে কেটে ফেলেছি বিশ্বাস। টিপ তুলে মৌতাত সর্বগ্রাসী ছিটে ফোঁটা চোখের আর্তি। এই নদীর বুকচিরেই তো পড়ে আছে গ্রানাইট ও কোয়ার্টাজ। এই প্রস্তর খন্ডেই নিশ্চুপ রহস্যের করিডোর। অনাবৃত অবস্থায় শুয়ে আছে শিলার স্তর৷ পাথরের ফাটলে মাকড়া পাথরের আড়াল আবার ধারালো রেখায় সীমারেখা টেনে গেছে আদিম প্রস্তর আয়ূধ। ইতিহাস তবে কি এখানেই থেমে থাকবে? কাল তো এতো সহজে ডুব দেওয়া সীমারেখার রূপকের মোহক ইঙ্গিত দেয় না। এখানেই নাকি অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনজাতি সভ্যতা গড়ে ওঠে। এখানে প্রামাণ্য দলিল প্রত্নতত্ত্ব- এর সাথে নৃতত্ত্ব বলে অতিকায় মানুষের কঙ্কাল প্রমাণ করে সভ্যতার কথা। কৃষি, ধাতব পাথর, বিবিধ অস্ত্রের নির্মাণের পারদর্শিতা চোখে পড়ে৷
নদীর তীর জুড়ে আছে ভেলাইডিহার নিকট সিঙ্গারপোল, ভাদুলডোবার জঙ্গল, হাড়মাসড়ার কাছাকাছি খাঁদাসিনির জঙ্গল, অক্লান্ত জীবনের প্রত্নতত্ত্ব। ডুগরে কাঁদা বারোমাস্যা খুঁজে ফিরে প্রমাণ। এইভাবেই উঠে আসে প্রাচীন অস্ত্র ও তৈজসপত্রের অংশ৷ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বলে যে, তীরবর্তী জুড়ে আছে প্রস্তর নির্মিত হাত কুঠার, নবাশ্মর ও ক্ষুদ্রাশ্বর আয়ুধ, গৃহস্থলির পাত্র , প্রাচীন মুদ্রা৷ এই নিদর্শন ইঙ্গিত করে সভ্যতাটি প্লিস্টোনের যুগের শেষ পর্যায়।
ইতিহাস বলে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা যোগাযোগের একান্ত মাধ্যম। নাব্যতা হলো সভ্যতার গভীরে উপকথার খিদে, যা তীক্ষ্মাগ্ন শরের মতো করে, সাজিয়ে দেয় সময়ের সন্ধিক্ষণ। কিছুদিন আগেই প্রত্যাখ্যান ছেড়েই উঠে এসেছে সভ্যতার আরো এক খণ্ডাংশ৷ অতি সরু পোড়ানো ইঁটের গাঁথুনি ছুঁয়ে আছে বর্তমানে সিমলাপাল থানার জড়িষ্যা গ্রাম। পিচ রাস্তায় আছে উত্তরে ৪০০ ফুট আর দক্ষিণ দিকে ৮০০ ফুট দীর্ঘ এলাকায় গাঁথুনি৷ নবীনতায় ছুঁয়ে আছে ইঁট, কাঠ, জ্বালানি। এখানে অনায়াসে বলা যায়, পৃথিবীর সব প্রতারণা যেন বদলে ছিল আলাপের প্রাথমিকে। তৎকালীনে কাঁচা ইঁট, পোড়া চুন ছিল সহলভ্য। উল্লেখ্য যে এই সময়ে পতিঙ্গাগড়া নামে রাজবংশের চিহ্ন বহন করে চলেছে জনশ্রুতিপূর্ণ সভ্যতা। গৃহে গৃহে স্তূপ নির্মাণ এক উন্নত নাগরিক চেতনার প্রকাশ। এমনকি তথ্য বলে নদীতীরে কেশাতোড়া মৌজায় এক উন্নত শহর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।এই তথ্যের ভিত্তিতে অবস্থিত নদীঘাটটির নাম শহরঘাটা। পূর্বে তমলুকের সাথে জলযোগের সখ্যতা প্রকাশ করে যে বিদেশে রপ্তানি প্রচুর হতো। এখানে বলা হয় যে, খিদেই হয়ে যায় অক্লান্ত ঈশ্বর। এখানে কেশাতড়া গ্রামের 'মিশ্রগেড়্যা' নামক পুকুরে বেশ কিছু প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। "দূর্গাবাঁধ " থেকে পাওয়া যায় ছিদ্রবিহীন শাঁখ৷ হাড়মাসড়া, কেশাতড়া, ভীমাড়া, খিঁচকা, কদমা, শিলাবতী নদী তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধাতুমল মিশ্রিত প্রস্তরখন্ড আবিষ্কার হয়। খনন অবশ্য লোহা গলাবার চুল্লি আবিষ্কারের কথা বলে৷
এই সভ্যতার মূল জীবিকা ছিল কৃষি ও পশুপালন। খাঁদাসিনির জঙ্গলে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে এলাকায় কৃষিকাজের সময় আজও লাঙলের ফলায় উঠে আসে ভাঙা তৈজসপত্রের খণ্ডাংশ। শিলাবতী, দ্বারকেশ্বর ও দামোদরের মিলিত সংগমে রূপুনারায়ণের জন্ম হয়৷ প্রবাহ ছুঁয়ে তাই বলতে ইচ্ছা করে, "সাঁকো ভেঙে গেলেও জলের প্রবাহ / থামে না / নতুন পথের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ব্যবসার কথা বললে তাম্রব্যবসা লিপ্ত বলেই তাম্রলিপ্ত৷ সেই সময়ের দুই তাম্রখনি হলো তামাজুড়ি ও তামাখুন। জানা যায় এখানে, জৈনধর্মাবলম্বী ধাতব ব্যবসায়ীরা সড়কপথ ধরে তামা নিয়ে আসতো। ধাতুর টানই এই অঞ্চল আকর্ষণ। নিত্য জায়মান ধরেই উঠে আসা, এক আকস্মিক অবগাহন৷ তবু নদীপথ ধরেই পথ চলা।এ যেন মনে করিয়ে দিতে ভোলে না..
" অনুগত পরবাসে চোখের উত্তাপ মরে যায়,
তখন ভালোবাসি সুপর্ণ বৃক্ষের ছায়া... "
অনুভবে চরাচরে উন্মুক্ত খেলাঘর তরঙ্গ আবার। (ক্রমশ)
অনবদ্য রচনা শৈলী । এই ভাবেই লিখতে থাকো প্রতি মূহুর্ত। তোমার প্রতিটি লেখা আমাকে লেখার অনুপ্রেরণা দেয়
ReplyDelete। খুব খুশী হলাম সুধী।