জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

দেবব্রত বিশ্বাসই প্রথম তার অদৃশ্য অস্তিত্বে বলতে গেলে আমায় কান ধরে গান শুনতে শেখান । শত সংকটে রবীন্দ্রনাথের গান ধরে তিনিই আমায় উত্তরণের পথ দেখান। 
শুনেছিলাম আঞ্চলিক ভাষার গানে তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম শিল্পী। 
কবিতা সিংহ লিখেছেন, 'তার গান কন্ঠ ছিন্ন করতে উদ্যত কোন নারীর হাতও চেপে ধরতে পারে'। সন্তোষ সেনগুপ্ত ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার কন্ঠস্বরকে সমুদ্রশঙ্খের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার গানে মুগ্ধ হয়েছেন মাও সে তুং থেকে মুজিবর, রবিশংকর থেকে ভীষ্মদেব, সত্যজিত থেকে ঋত্বিক, হেমন্ত থেকে মান্না - সকলেই। 18 August তার প্রয়াণ দিবস ও 22 August তার জন্মদিবস ।
দেবব্রত বিশ্বাস ও শম্ভু মিত্রের জন্মদিন চার বছরের ব্যবধানে একই দিনে।

শম্ভু মিত্রের প্রয়াণ ছিল বড় নির্জন... একাকি হাটতে হাটতে চলে গেলেন ... দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার আগে কেউ  জানতেও পারল না।

ঐ সময় একদিন উৎপলেন্দু চৌধুরীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল  ... উনি বলছিলেন,  শম্ভু মিত্রের এইভাবে চলে যাওয়াটা যেন কোথাও আমাদের গালে চড় কষিয়ে গেল । বললেন,  দেবব্রত বিশ্বাস ওর বাবা নির্মলেন্দু চৌধুরীর বিশেষ বন্ধু ছিলেন ...মাঝে মাঝেই ওদের বাড়িতে আসতেন ...এলেই ছোট্ট উৎপলেন্দুকে চকলেট দিতেন ও মোটর বাইকে চড়াতেন।

দেবব্রত বিশ্বাস  ও শম্ভু মিত্র-  দু’জনেই IPTA  তে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছেন । রক্তকরবী ও ছেড়াতার নাটকে দেবব্রত অভিনয় করেছেন ... খালেদ চৌধুরী ওরই আবিষ্কার । 46এর দাঙ্গার সময় দেবব্রত বেশ কিছুদিন নব বিবাহিত শম্ভু ও তৃপ্তিকে ওরই ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন ।

প্রায় 25  বছর আগের কথা ... সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তখন মেকানিকাল ইন্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ... সাধ জাগল দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করার ...  এবং সেখানে বিশিষ্ট কয়েকজনের সাক্ষাৎকার ছাপা হবে ... অনেকের দ্বারস্থ হলাম... সুনীল, সৌমিত্র, সুমন, স্বপন... সুনীল, সৌমিত্র কবিতা দিলেন...  সাক্ষাৎকার দিলেন সুমিত্রা, ইন্দ্রাণী ও অমিতাভ চৌধুরী ...



অতঃপর সুচিত্রা মিত্র ...
বালিগঞ্জ শিক্ষসদনের পাশে ফ্লাটে চলে গেলাম ...
বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে বললেন কি চাই  ?
- আপনাকে।
- কেন?
-দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে আপনার একটি সাক্ষাৎকার চাই।
-একই বিষয়ের ওপর আর কতবার বলবো। কিছু বলার নেই ।
- কিন্তু একই রবীন্দ্রনাথের একই গান তো আপনি বারবার গান।
- দুটো এক হলো? 
-না। কিন্তু আপনার এতদিনের সহকর্মীর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে ভালোই লাগার কথা । তাই না।


শেষ পর্যন্ত অবশ্য উনি সাক্ষাৎকার দেন নি।
তখন আমাকে দেখলে মনে হতো 7/8 এ পড়ি...  অতটুক ছেলে ওনার সাথে তর্ক করছি দেখে বিস্মিত হলেন ... তবে হয়ত কিছুটা ভালোও লেগেছিল তাই ঘরে বসিয়ে মিষ্টি সহযোগে আপ্যায়ন করেন ... দীর্ঘসময় গল্পও করেন ...সে স্মৃতি ভোলার নয়...

এই স্মৃতিও ভোলার নয় যে মিত্র-গুহ-বিশ্বাসদের অঙ্গুলিহেলনে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড সহস্র সহস্র অনুরাগীর কাছে দেবব্রতকে ব্রাত্য করে রেখেছিল ...রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ রুদ্ধসঙ্গীত হয়ে পড়েছিল চিরকালের মতো...

দেবব্রত বিশ্বাসের প্রথম রেকর্ডিং নজরুল গীতি - মোর ভুলিবার সাধনায় ।নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে গিয়ে রেকর্ডিং করান। ঐ রেকর্ডটি অবশ্য প্রকাশিত হয় নি। অনেক পরে পরিণত বয়সে তিনি দুটি নজরুলগীতি রেকর্ড করেন।

একবার কোন একটি কাগজে বেরিয়েছিল যে দেবব্রত বিশ্বাস আর গান গাইবেন না। পরের দিনই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছুটে গিয়েছিলেন দেবব্রতর কাছে। গিয়ে বলেছিলেন, 'আপনি গাওয়া বন্ধ করে দিলে আমরা কার গান শুনবো ?'

দেবব্রতর প্রয়াণের কিছুদিন আগে হেমন্ত নিজ উদ্যোগেই রবীন্দ্র সদনে দেবব্রতকে সংবর্ধিত করেন ও নিজ কন্ঠে মানপত্র পাঠ করেন ।

শুনেছি,
কলামন্দিরে গান গাইতে উঠছেন দেবব্রত ...অসুস্থ ...মাইক্রোফোনের তারে হোঁচট খেলেন ... সামনের থেকে এক শ্রোতা বলে উঠলেন , " কি দাদা, আজ একটু বেশী টেনে ফেলেছেন নাকি ?"... জীবনে কখনও মদ্যপান না করা মানুষটি মৃদু হেসে বললেন, "একেবারে ঠিক ধরেছেন "...তারপর সামান্য কয়েকখানি গান গেয়ে জানিয়ে দিলেন-কলামন্দিরে আর কখনও গাইবেন না...

দেখেছি,
রবীন্দ্র সদনে পীযূষকান্তি গাইছেন...উদ্যোক্তাদের একজন প্রয়াত হওয়ায় শুরু করলেন - সমুখে শান্তি পারাবার,  দুঃখের তিমিরে যদি...পেছনের দিক থেকে কিছু শ্রোতা চিৎকার করে উঠল - 'এটা কি শ্রাদ্ধবাসর নাকি? '...বিরক্ত গায়ক বললেন, "তাহলে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাই হোক"... শুরু করলেন  - আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ...

রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতা মাত্রই যে সভ্য, শিক্ষিত ও রুচিশীল হবেন, এমনটি নয়।                   (চলবে)




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours