শামা আরজু, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:
কেউ থার্টি ফার্স্ট নাইট কেউবা নববর্ষ নিয়ে ব্যস্ত।আমি হন্যে হয়ে টিউশনি খুঁজি।তোর ভাইয়ের রেজিস্ট্রেশন এর টাকার জন্য এখানে ওখানে ফোনে মানুষ হাতড়াই। এরই মাঝে তোর কাজ করতে গিয়ে হাত পুড়ে ফেলা।ভিডিও কল দিয়ে তোর ক্লান্ত শুকনো মুখ আর পোড়া হাত দেখি।
তোর জীবনের ঘটনা উত্তম পুরুষে আমি লিখেছিলাম।অদ্বিতী আপুই শুধু বুঝেছেন ওটা আমার জীবন কাহিনী নয় আর জানিস তুই।পত্রিকার লেখা পড়ে তুই খুব কেঁদেছিলি।তোর কথায় বুঝতে পারলাম আবারও, আমি অন্যের যন্ত্রণা ধারণ করতে পারি খুব ভালো করেই।
হ্যাঁ তোর হাতপোড়া আমার বুকে লেগেছে।
গত দু'তিন দিন ধরে কিছু স্মৃতি খুব তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।পালানোর পথ নাই।মরে যেতে ইচ্ছে করলেও পারছিনা। বাবুর পড়া তো শেষ করতেই হবে।
শপিং করা আমার জন্য আসেনি।ঘরে চাল না কিনলেও ওষুধপাতি কিনতেই হয়।ওষুধের দোকানে গেলেই পাশের দোকানের একটা বদমাশকে আমার দেখতেই হয়।পাশের দোকান তোরই একজন শিক্ষকের দোকান।আমি তখন পঁচিশ ছাব্বিশ,তুই ছয় কি সাত।সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে তোকে ডাক্তার দেখিয়ে ঘরে ঢুকলাম।তোর জনক ঘরে। পায়ের ওপর পা তুলে পত্রিকা পড়ছিলো।পত্রিকায় দেশের রাজনৈতিক খবরে তার বেজায় আগ্রহ।
ডাক্তার তখন ঝুলন দাশ শর্মাই তোকে দ্যাখেন।২ টা করে প্রেডনিসোলন তিন বেলা,সঙ্গে আরও ছিলো।ঘরে খাবার পানি নেই।অন্ধকার হলে আমিই গিয়ে পানি আনতাম।কিন্তু তোর শ্বাসকষ্ট খুব বেশি।জানি তাকে বললেও সে আনবে না।তবু ভাবলাম,বলেই দেখি।
মেয়েকে প্রেডনিসোলন খাওয়াবো,একটু পানি এনে দেন।
পারবো না।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।প্রেডনিসোলন শুনেও যে এমন করতে পারে তার শরীরে দয়া কস্মিনকালেও হবেনা।
ঘরের ড্রেস আপেই বের হই তোকে নিযে।নলকূপটা দোকানপাটের কাছি।আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে তোকে সামান্য পানি আনতে বলি।তুই প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে কল চেপে পানি আনলি।তাতেই তোর ওষুধ গেলা।তোর সেই কলচাপার কষ্টের ভার আমার আজো বুক থেকে নামেনি।
রাত সাড়ে ন"টা।শীতের রাত।তাই শহর খুব নিরিবিলি। বিকোটাইড ইনহেলার ও লাগবে।টাকা ছিলোনা তাই শুরুতেই আনিনি।কিন্তু তোর শ্বাসকষ্ট কমছে না তো।বের হই।বদমাশ দোকানদার তখন আমাকে পটানোর সুযোগ খোঁজে কেবল।
ভাবী,ওষুধ না নিলেও আপনি সকালে যাবার সময় আমার দোকানে একটু পায়ের ধুলা দিয়ে যাবেন।আর...।
যাই তার দোকানেই।
ভাই,আমি কালই দিয়ে দিবো টাকা,একটা ইনহেলার দ্যান।
নাই।
শোকেসে রাখা বোবা ওষুধ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি দেখলাম। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।অপমানে আমি পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। তড়িঘড়ি করে একটা রিকশায় উঠে পড়ি।পায়ে হাঁটার সামান্য দূরত্ব অহেতুকই পার হই রিকশায়। তোর শ্বাসকষ্ট কমাতে না পারার সেই ব্যর্থতা নিয়েই আমি রাত কাটাই।
তোর,তোর ভাইয়ের কতোটা মনে আছে জানতে চাইনি।দিন কয়েক আগে নাজমা আপার সাথে কথায় কথায় অনেক কথা হয় এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলি।
আপা,আপনার মনে আছে কিনা সে যে বেতনের তারিখে টাউনহলের মোড়ে এসে টাকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো?
হ্যাঁ মনে আছে।
সে অফিস থেকে এসে টাউনহলের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো আমার বেতনের টাকার জন্য।আমি নাজমা আপাসহ রিকশায়।রিকশা থামিয়ে সে আবার অফিসে যেতো।
গল্প নয় সত্যি এটাই যে,অফিস ছুটির পর বাসায় এলেও তো সে টাকাটা নিতে পারতো।তবু কেন তার এই আচরণ কখনও জানতে চাইনি।কারন স্বামী তো প্রভু।আল্লাহর মতো।যাকে প্রশ্ন করতে নেই।আল্লাহ প্রশ্ন করতে বারণ করেছেন আর স্বামী প্রশ্ন করলেই গায়ে হাত তোলে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours