কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

'গুরু গুরু ঘন মেঘ বরষে!'
বর্ষায় ভিজছে ইস্পাত কংক্রিটের তিলোত্তমা। 

'আসি আসি' করে, এবার বেশ খানিকটা দেরিতেই এলো বর্ষারানি। তা আসুক। বয়স হয়েছে তো। আর এতো ঘড়ি ধরে চলার আছেটাই বা কী! হোক না একটু ছন্দপতন। খামখেয়ালিপনা। সময়ে না এসে, আসুক না একটু অসময়েই। পথ চেয়ে থাকার পর যে আসে, তার কদরই আলাদা। 
চলুক আরও একটু প্রতীক্ষা। সময়ের ঘড়ি না ধরে, আসুক অসময়ের ঘড়ি ধরেই। এলোও তাই। বন্ধু তো সেই, যাকে অসময়ে পাওয়া যায়। শক্তি চাটুজ্যে থাকলে হয়তো এখনই বলে বসতেন, 'কেউ কথা রাখেনি'। 

তবে আমি বলি কী, বেটার লেট দ্যান নেভার। 

এই বাদল সোহাগটুকুর জন্যই যেন অপেক্ষা করেছিলো তিলোত্তমা। সারাটা বছর তো হাই ভোল্টেজ তাপেই জ্বলছে শহরটা। গাড়ি বাড়ি, আর আশপাশে কিছু অবশিষ্ট কল- কারখানা। উৎপাদনের আগুনে সমৃদ্ধির খির খাওয়ার ব্যবস্থা। উন্নয়ন। তা চলছে, চলুক। 

এমনিতে বেশ ছবির মতো মহানগর। কিন্তু তার তপ্ত বুকে জল ঢালবে কে? সময় মতো ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছয় না। রাস্তায় জ্যাম। আর জল জমলে তো কথাই নেই! পাগলা ঘন্টি আরও পাগল হয়। ঢং ঢং ঢং অনবরত বেজে চলে। কেমন পাগল পাগল লাগে। মনে হয় আওয়াজটা যেন সোজা আত্মায় ঘা মারছে।
আগুন তখন উল্লাসে। বীরবিক্রমে উদ্বাহু নৃত্য। আবার দমকল এলো তো জল পেলো না। সামনের জলাশয় জলহীন। জল কোথায় গেল পাতালে না আকাশে, তা কেউ জানে না। বর্ষারানির অপেক্ষা করতে করতে, বুক শুকিয়ে কাঠ নয়নজুলির।

নারী আর জলাশয়ের তফাত এখানেই। যৌবনবতীর বুক শুকোলেই সে ফেলনা। কেউ পোছে না। আর জলাশয়ের জল শুকালেই শিকারীর হামলে পড়া।
প্রমাদ গোনে জলাশয়। তার বুক শুকিয়ে গেলেই অন্য খেলা। মাটি ভরাট। দেখতে না দেখতেই বহুতল।
"আল্লা মেঘ দে পানি দে!"

মেট্রো স্টেশনে ব্যাক কাউন্টিং শুরু। বাহাত্তর একাত্তর সত্তর। ট্রেন আসছে। কী জানি কোথায় কোন স্টেশনে কে দাঁড়িয়ে? ট্রেন এলেই লাইনে ঝাঁপ দেবে।
ওপরে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। কেউ হয়ত এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই এসেছে মরণের ডাকে। সব খেলা আপাতত শেষ। জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ কোনও পুরুষ। কিংবা কোনও নারী। তার ওপরটা ভেজা জবজবে। ভেতরটা কঠিন। আটত্রিশ সায়ত্রিশ ছত্রিশ। ট্রেন আসার ব্যাক কাউন্টিং। ব্যাক কাউন্টিং কারুর জীবনেরও।

নেই নেই করেও শহরটাতে অনেককিছুই আছে। আজও। তবে এই বয়সেই কেমন যেন প্রাণহীন জোব চার্ণকের কলকাতা।
সবে তো তিনশো তেত্রিশ বছর বয়স। শহরের বয়স হিসেবে, এটা এমন কিছুই নয়। কিন্তু এরমধ্যেই শহরটা কেমন যেন নুইয়ে পড়েছে। মানুষ গাড়িঘোড়ার ভিড়ে মেরুদন্ডটাই গেছে তুবড়ে।
জীবনের সঙ্গে নিত্যদিনের সমঝোতা। মানুষগুলোও গেছে বদলে। সব একেকটা রামগরুড়ের ছানা। ইট পাথর ইস্পাতের সঙ্গে সহবাস। সবই কেমন যেন যান্ত্রিক। শহরটাও বেড়ে উঠেছে বেয়াড়া ভাবে। যোগ্য অভিভাবক না থাকলে যা হয় আর কী! 
শহরটায় কয়েকটা চওড়া চওড়া, কালো কালো রাস্তা আছে। গাড়ির ভিড় আছে। সবুজ তেমন নেই। বড্ড অভাব গাছগাছালির। কুকুর আছে বেড়াল আছে। রেপিস্ট আছে। রাজনীতি করার লোক আছে। পাখী নেই। পার্ক আছে। শরীরের চটকাচটকি আছে। খোলাছাতার আড়ালে জমজমাট রোমান্স নেই। তাহলে কাদের ডাকে বর্ষা আসে?

বর্ষা আসে তার পুরনো অভ্যাসেই। সে আসবেই। একটু আগে অথবা একটু পরে। এই যা। এখনও সে ভালবাসে নিত্য ধর্ষিতা ধরনী, তিলোত্তমাকে। ভালবাসে তাই আসে। কখনও টাপুর টুপুর, আবার কখনও ঝেঁপে আসে। মনের শরীরের সব ক্লেদ, জমে থাকা মান অভিমান, ধুইয়ে দিয়ে যায় প্রেমিকের। শহুরেরা অতিষ্ঠ। জলভেঙে ঘরে ফেরা।

শহরটায় নীল আকাশের বড় অভাব। গাড়ির ধোঁয়ার আঁচলে ঢাকা আকাশ বড় ম্লান। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের হতাশা, স্বপ্নভঙ্গের ধূসর আকাশ। মনখারাপের মেঘ ভারী হয়। সেই মেঘের বৃষ্টি নামে শহরে, অবশেষে।  মিলন দুই প্রেমীর। বর্ষারানি তিলোত্তমার। থই থই নাচ, আজ উত্তরে তো কাল দক্ষিণে। বর্ষাযাপন। ভিজে জবজবে শহর। ময়দানে, ভিক্টোরিয়ায় গাছের তলায় ঠিক কজন প্রেমিক ভিজলো কে জানে। 

বর্ষায় ভিজেছিল বটে রাজেশ খান্না। সঙ্গে শর্মিলা। সেই সত্তর দশকের ভেজাস্মৃতি।
অঝোর বর্ষণ। সেবৃষ্টি তো আসলে জলবৃষ্টি না, বৃষ্টি রোমান্সের। আগুনের ফুলকি। "বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা!" জ্বালা ধরায় শরীরময়। বাষ্প মন। ভেজায় যৌনতায়। বেপরোয়া প্রেমিকের শরীরে শরীর একাকার।
'ভুল কঁহি হমসে না হো জায়ে!'

সত্তর দশকের যৌবন অতো হিসেবি হতো না। যৌনতার ধারাপাতে ভেসে যেত লায়লা মজনুরা। কংক্রিটের শহরটাও নড়েচড়ে বসতো বৃষ্টিভেজা রাতে। ধুয়েমুছে সাফ তার ইস্পাত কঠিনতা। বৃষ্টির আহ্লাদে তখন সে গদগদ বৃন্দাবন। নলবন তখন কুঞ্জবন। ভরাহুগলি বাদলাদিনের যমুনা। সর্বনাশের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ খেলে যায় হুগলি নদীর বুকে।
"আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়!"

প্রেমের জোয়ার ডেকেছে হুগলি নদীর জলে। ডক থেকে পাড়ি জমানোর সময় হলো। নোঙড় ওঠানোর আগে জাহাজের মস্ত এক ভোঁ। প্রেমাতুরের কানে বাজে শ্যামের বাঁশি হয়ে। বান ডেকেছে যমুনায়। চারদিকে চাপ চাপ কালো অন্ধকার।

প্রতীক্ষা শ্রীরাধের। কখন আসে কানু।
"হ্যালো, রাস্তায় ফেঁসে গেছি। আসছি।" 
শহর তখন জল থইথই। শহুরেরা জেনে গেছে কানুর আগমন বার্তা। তাই কানু দর্শনে অধীর অপেক্ষা কৌতুহলী শহরের। গতি স্তব্ধ। থমকে ঘড়ির কাঁটাও। প্রতীক্ষার প্রহর যেন কাটে না। এমন সময় শহরের জলভেজা রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটে যায় বাইক। শ্যাম-রাই চলে যমুনা দর্শনে। আবার কুঞ্জবনেও হতে পারে। রাতকোটালের নজর এড়িয়ে যুগলের অভিসার।

কানুরা তো ভাগ্যবান। না জানি শহরময় ছড়িয়ে রয়েছে কতশত যক্ষ। ঘুম উবে গেছে তাদের চোখ থেকে। বর্ষামুখর রাতে তারা সবাই রাত জাগছে। নিশাচর। 
দীর্ঘদিন প্রিয়া অদর্শনে আকূল যক্ষ।
কলকাতা শহরে পাহাড় নেই। টিলাও নেই। দশতলার ফ্ল্যাটের ছাদে দাঁড়িয়ে বিরহী যক্ষের কাতর ডাক। গভীর রাত। হাওড়া ব্রিজের মাথায় নেমে আসে মেঘরাজি। তাদেরই শরণাপন্ন হলেন যক্ষ।

সেক্টর ফাইভে ছুটি নেই। মন আনচান প্রিয়ার জন্য। বললেন, "যাও মেঘ অলকাপুরীতে। প্রিয়ারে গিয়ে বলো মোর মনের কথা।"
এক ছোট্ট জনপদ অলকাপুরী। উত্তরাখন্ডের চামোরি জেলায়। সেখানে ইন্টারনেট আছে। তবে ইন্টারনেটের গতি নেই। মেসেজ পৌঁছয় ওপরতলার মর্জিতে। অগত্যা!

"আমি মেঘের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা!" 

সেই ঠিকানায় ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে থাকে নিয়তি। ভালবাসার আড়ালে বিরহ। বর্ষা তখন নির্মম, নিষ্ঠুর। সে এক অন্য রূপ। চেনা দায় তাকে।
সেদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েছিলো ছোট্ট অপু-দুর্গা। ব্যাস আর যায় কোথায়! তেড়ে জ্বর এলো দুর্গার। বাবা হরিহর শহর থেকে গাঁয়ে ফিরলেন ছেলেমেয়ে, বউয়ের জন্য পুজোবাজার সেরে। কান্নায় ভেঙে পড়লেন সর্বজায়া। আবাহনের আগেই বিসর্জন হয়ে গেছে ছোট্ট দুর্গার। অঝোর বর্ষণেই ভেসে গেছিল হরিহর সর্বজায়ার সংসার। বর্ষার সেই ছবি দেখিয়েছিলেন সত্যজিত রায়।
আবার হাত ধরে মুক্তির পথেও ভাসিয়ে নিয়ে বর্ষা। 'সব্যসাচী'র কথা ভোলেননি নিশ্চয়? মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে ফের পথে নামলেন ডাক্তাররূপী উত্তমকুমার। বাইরে তখন অঝোর ধারা। বৃষ্টির তোড়েই ডাক্তার মিলিয়ে গেলেন 'মহামানবের সাগরতীরে'।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours