কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
শ্রীনগরই কেন, অনন্তনাগ কেন নয়? পহেলগাঁও, বারামুল্লাই বা কী দোষ করলো? স্বাধীনতা দিবসে জম্মু কাশ্মীরের আর সব জায়গার ছবি কোথায়?
এমন হাজারো প্রশ্নের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে দেশের  সংবাদমাধ্যমকে। মন মতো ছবি, খবর দেখতে বা শুনতে না পেলেই, গোঁসায় ফেটে চৌচির বিজেপি বিরোধী শিবির। কংগ্রেসের এক প্রবীণ দিগগজ নেতা দিগ্বিজয় সিং। কোনও রাখঢাক না করে তিনি তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, "সব ঝুটা হ্যায়। জম্মু কাশ্মীরের প্রকৃত খবর জানতে হলে বিদেশী সংবাদমাধ্যমই ভরসা। মোদি সরকার অশান্ত উপত্যকার বাস্তব ছবিটা চেপে দিচ্ছে।"


সীমান্তপারের পাকিস্তান তো যুদ্ধ করতে, এই নামে কী সেই নামে। হুমকির পর হুমকি। আর মোদি বিরোধী শিবির তো ধারা তিনশো সত্তর, পঁয়ত্রিশ এ, খারিজ করার পরেই অঘোষিত যুদ্ধে নেমে পড়েছে। বেবাক বাক্যবাণ। রণং দেহি! জম্মু কাশ্মীর প্রসঙ্গের বহু আগে থেকেই, সন্দেহজনক ভূমিকা নিয়েছে একাধিক দল। শশী থারুরের কথাই ধরুন। কংগ্রেসের এক প্রমুখ সাংসদ। গতবছর নির্বাচনী প্রচারে তিনি এক মারাত্মক কথা বলে বসলেন। "হিন্দু পাকিস্তান তৈরির লক্ষ্যে এগোচ্ছে বিজেপি"। সেই উক্তির খেসারতও দিতে চলেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তাঁকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দিয়েছেন কলকাতার এক মেট্রোপলিটন ম্যাজিসেট্রট।


পদ্ম শিবিরের গায়ে বর্ণহিন্দুর সিলমোহর দাগতে গিয়ে এ কী করছে কংগ্রেস? আস্তিনেরর তলা থেকে সাপ বেরিয়ে পড়ছে তো! সেই চির পরিচিত সাম্প্রদায়িক তাস। দেশভাগের রক্তাক্ত স্মৃতি উসকে দিতেই, ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দু মুসলিম আবেগ। ধারা তিনশো সত্তর, পঁয়ত্রিশ এ তুলে দেওয়ার পরেই দলের যে ভূমিকা দেখা গেল, তিন তালাক বিলের সময়েও হুবহু এক ভূমিকা দেখা গেছিলো কংগ্রেসের।


জাতপাতের তাস খেলার প্রতিযোগিতায় কেনই বা পিছিয়ে থাকবেন পি চিদাম্বরম? হাজার হলেও কংগ্রেসের মান্যগণ্য নেতাদের মধ্যে তিনিও প্রথম সারির অন্যতম। তিনি নির্বিকার চিত্তে জানিয়ে দিলেন, "জম্মু কাশ্মীর হিন্দু অধ্যুষিত হলে তিনশো সত্তর ধারা উঠত না। সেদিন যে কারণে দেশভাগ হয়েছিল, সেই অতীত ক্ষতই আরও একবার খুঁচিয়ে দিলেন তিনি।


কংগ্রেসের গলার আওয়াজ মিলে যাচ্ছে এআইএমআইএম- এর মতো দলের সঙ্গেও। তেলেঙ্গানার ওই দলের বিরুদ্ধে বারেবারে অভিযোগ উঠেছে কড়া কট্টরবাদী রাজনীতির। সেই দলেরই সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়েসি। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের নেতাদের মারমুখী মেজাজের তফাত করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে এতে চকমানোর মতো সত্যিই কিছু আছে কি? কারণ ওই দলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে নির্বাচনী আসরে নামতে দেখা গেছে কংগ্রেসকে।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের জোরালো অভিযোগ এনেছে বিজেপি।



কাশ্মীর নিয়ে যারা একতরফা গরমাগরম বুলি ঝেড়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির একজন কানহাইয়া কুমার। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির সিপিআই জঙ্গি ছাত্রনেতা। 'ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে ইনশাল্লাহ'- এর প্রবক্তা? ঘটনা মাত্র তিন বছর আগের। 2001সালে সংসদ ভবন হামলার মূল চক্রি আফজল গুরুর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় আদালত।


2016 সালে আদালত ওই আদেশ দেওয়ার পরেই তাণ্ডব জুড়ে দেয় কানহাইয়া। তিনি এতটাই খেপে উঠেছিলেন যে একেবারে ভারত ভাঙার ডাক দিয়ে বসেছিলেন। কানহাইয়ার ভারতের টুকরো হওয়ার কথা এবার একটু ঘুরিয়ে শোনালেন কংগ্রেসের মণিশঙ্কর আয়ার। বিজেপিকে সতর্ক করে তিনি বললেন, "ভারতের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে কাশ্মীর।"


আবার কাশ্মীরের হাল দেখে প্যালেস্টাইনের কথা মনে পড়ে গেল মণিশঙ্কর আয়ারের। ওদিকে শত চেষ্টাতেও পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে রণকৌশলে সফল হননি, ঠিক সেই চেষ্টাটির পক্ষেই মত জাহির করে বসলেন কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনি দাবি জানিয়ে রেখেছেন, কাশ্মীর সমস্যার গোটা ব্যাপারকে নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। সনিয়া গাঁধী রাহুল গাঁধী ভাবুন, বিজেপি বিরোধিতা করতে গিয়ে, দেশবিরোধিতা করে ফেলছে নাতো কংগ্রেস?


পাকিস্তানের গলাতেও কিন্তু একই সুর। কংগ্রেসের মতোই কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কিছুতেই হজম করতে পারছে না পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট, জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। নইলে এত গোঁসা কিসের? ভারত জম্মু কাশ্মীরে কী করছে তা সম্পূর্ণভাবেই দেশের আভ্যন্তরীণ ঘটনা। বাস্তবে পাক সরকারের ভয় অন্য জায়গায়। পনেরো অগাস্ট শ্রীনগরে আর দিল্লিতে একই পতাকা উড়তে দেখে এখন একটাই আশঙ্কা তাড়া করে বেরাচ্ছে। আগামীতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের আকাশেরও দখল নেবে নাতো ওই পতাকা? কারণ সংসদে সেরকম প্রতিশ্রুতিই দিয়ে রেখেছেন অমিত শাহ।
উপত্যকায় নির্বিঘ্নে ইদ উৎসব পালনের পর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনও হলো বিনা রক্তব্যয়ে। তবু ছিদ্র অন্বেষনে একটুও ঢিলেমি দিতে রাজি নয় কংগ্রেস। আর এ ব্যাপারে দলের সহায় বিদেশী সংবাদমাধ্যম। কংগ্রেসের আরেক প্রবীণ দিগ্গজ নেতা দিগ্বিজয় সিংয়ের কথাতেই তা স্পষ্ট। বিদেশী সংবাদমাধ্যমের ওপর কংগ্রেসের যখন এতটাই আনুগত্য, ঠিক তখনই বিদেশী সংবাদমাধ্যমের দিকে এক কড়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বলিউডের সিনেমা নির্মাতা শেখর কাপুর।
"আপনারা সবসময় ইন্ডিয়ান অকোপায়েড কাশ্মীর ' বলেন কেন? অগাস্ট এগারোর ওই টুইটে কটাক্ষ করে শেখর লেখেন, "আমার অবাক লাগে, আপনারা উত্তর আয়ারল্যান্ডকে 'ব্রিটিশ অকোপায়েড আয়ারল্যান্ড' বলতেই বা কেন অস্বীকার করেন?"



কংগ্রেসের জম্মু কাশ্মীরপ্রেম এতটাই বেপরোয়া যে শীর্ষ আদালতের আশ্বাসেও দলের টনক নড়ে না।
কার্ফিউ, একশো চল্লিশ ধারা জারির দু'সপ্তাহও পুরো হয়নি, অথচ গেল গেল রব তুলেছে কংগ্রেস। কিন্তু উপত্যকার পরিস্থিতি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে এতটুকু বিচ্যুতি হলে কী হতে পারে, তা দেখা গেছিল মাত্র তিন বছর আগেই। প্রাণ গেছিলো কমপক্ষে ছিয়ানব্বই কাশ্মীরবাসীর। লাগাতার একান্ন দিন কার্ফিউ দেখেছিল উপত্যকা। ঘটনা 2016 সালে জুলাই মাসের, জওয়ানের সঙ্গে সংঘর্ষে জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি মারা যাওয়ার পর।



শীর্ষ আদালতেরও মত, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সময় দিতে হবে সরকারকে। এসব যুক্তির মধ্যে যেতে নারাজ কংগ্রেস সমেত মোদি সরকার বিরোধী আরও কিছু শিবির। দেশের আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সামাল দিতে 1975 সালে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর একুশ মাসের 'জরুরি অবস্থা' ঘোষণার কথা সম্ভবত ভুলে গেছেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা গাঁধি। মিসা আইন প্রয়োগ করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল দেশের তাবড় বিরোধী নেতাদের। সংবাদমাধ্যমের সেন্সরশিপ। আসলে জেগে ঘুমাচ্ছে কংগ্রেস। তাকে জাগানো শিবেরও অসাধ্য।
বিরোধী শিবিরও জানে, ধারা তিনশো সত্তর ধারা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই কাশ্মীরের জঙ্গিরা রাতারাতি উপত্যকা থেকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাবে এমনটা অসম্ভব। সুযোগ পেলেই তারা কাশ্মীরকে অস্থির করে তোলার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করবে না। এই বাস্তব পরিস্থিতির কথা জেনেও বিরোধী শিবিরের দাবি উপত্যকা থেকে যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার। উদ্দেশ্য একটাই, উপত্যকাকে অস্থির করে তুলে পরিস্থিতির ফায়দা তোলা। মোদি সরকারকে অপদস্থ করার এই সুযোগ হারাতে চাইছে না তারা।



একদিকে পাকিস্তানের হুমকি, অন্যদিকে বিরোধী শিবিরের টিকা টিপ্পনী, মাত্রাছাড়া বিরোধ। শক্ত হাতে এই দুইয়ের মোকাবিলা করেই মোদি সরকার জম্মু কাশ্মীরবাসীকে উপহার দিলেন স্বাধীনতা দিবস। সেই সঙ্গে  এক মোক্ষম প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন কংগ্রেসকে।
লালকেল্লার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের কাছে জানতে চাইলেন, তিনশো সত্তর, পঁয়ত্রিশ এ ধারা যখন এতটাই অপরিহার্য, তখন ওই দুই ধারাকে স্থায়ী করলেন না কেন? আপনারাই তো এতদিন রাজপাট সামলেছেন। এরকম চোখা প্রশ্নের মুখে পড়ার ভয়েই সম্ভবত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে লালকেল্লায় হাজির হননি সনিয়া রাহুল প্রিয়াঙ্কা। তাই প্রশ্নের জবাবও নিজেই দিয়েছেন মোদি। তিনি বলেছেন, আসলে ওই দুই ধারা বহাল রাখা নিয়ে সন্দেহ ছিলো আপনাদের মনেও। কিন্তু তা সংশোধনের স্পর্ধা ছিলো না।
আগামী দিনে কংগ্রেস কি সেই স্পর্ধা দেখাবে, দলের ভ্রান্ত অবস্থান সংশোধনের?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours