শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:
১৯৮৮ সালে কলেজের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিল শুনতাম, "৭১ এর হাতিয়ার / গর্জে উঠুক আরেক বার।" "শেখ শেখ শেখ মুজিব /লও লও লও সালাম।" "জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু "। আবার ছাত্রদলের মিছিল থেকে আওয়াজ আসতো, "জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল/ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। " "স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া/ লও লও লও সালাম"।
ছাত্রলীগের "৭১ এর হাতিয়ার / গর্জে উঠুক আরেক বার" এই শ্লোগানের বিপরীতে ছাত্রদলের কোন শ্লোগান ছিলে না ২০০১ পর্যন্ত। অন্তত বৃহত্তর ময়মনসিংহে ছিলো না৷
২০০১ থেকে ছাত্রদলের মিছিল থেকে মাঝে মাঝে শোনা যায় " ৭৫ এর হাতিয়ার /গর্জে উঠুক আরেক বার (!?) ! ছাত্রদলের মিছিল থেকে ২০১৪/১৫ এমন শ্লোগানও শোনা গেছে। বিএনপিতে, জামায়াত ও শিবিরের প্রভাব যত বেশি হয়েছে। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে তত দুরত্ব ও সহিংসতা বেড়েছে। আমি নিজে একটি বিষয় জানি, ছাত্র শিবিরের মদতে, একবার ছাত্রদলের মিছিল থেকে "৭৫ এর হাতিয়ার / গর্জে উঠুক আরেক বার " এর মত অমানবিক শ্লোগান দিতে দেখেছি। এবং তাৎক্ষণিক আমি বিএনপি নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সে শ্লোগান বন্ধ করে দেয়া হয়। মিছিলটি উপরিউক্ত শ্লোগান নিয়ে আর এক দু মিনিট পথ অতিক্রম করলে ভয়াবহ সংঘর্ষ বেধে যেতে পারতো। কেন না, পাশেই ছিলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মিরা। আর তারা এমন শ্লোগান শুনলে কি ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য কলংঙ্কজনক অধ্যায়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের উপর আবার আক্রমণ হয় ২০০৪ এর ২১ আগষ্ট। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট এর নির্মম খুনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অনেকের সাজাও হয়েছে কেউ পলাতক রয়েছে বিদেশে। একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য ; একজন ছাত্রনেতা যিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বও দিয়ে ছিলেন। কানাডায় বঙ্গবন্ধুর এক খুনিকে পেয়ে মারধর করেন। এবং প্রায় এক বছর আদালতে বিষয়টি ঝুলে ছিলো। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচিৎ ছিলো তাকে পুরস্কৃত করা। কেন না তিনি, ব্যাক্তি ও দলীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে বঙ্গবন্ধুর খুনিকে আক্রমন করে ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বামপন্থী একজন ছাত্রনেতা। বয়সে তিনি আমার বেশ বড়, এখন কানাডা প্রবাসী। আমার কিশোর বয়সে আমি তার সংস্পর্শ পেয়ে ছিলাম।আমার স্পষ্ট মনে আছে তিনি শিবিরের সংস্পর্শে যেতে নিষেধ করতেন আমাকে। অবশ্য তিনি এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক।
আজকের তরুনরা কি ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে? আমরা কি তা ভেবে দেখেছি! শ্রাবন প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, মি রবীন আহসানের উদ্যোগে "বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমান বইমেলা" করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর উপর লেখা বই, বিক্রির সময় আমার বেশ কিছু তিক্তমিষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। সত্য বলতে কি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, যারা আওয়ামী লীগ নয় এমন লোকেরাই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু উপর লেখা বই বেশি কিনেছেন! আমরা কয়েকজন তার চাক্ষুস সাক্ষী। আজকের তরুণেরা যারা মুক্তিযুদ্ধ, স্বধীনতার স্বপক্ষের তারা কি ভাবে তা,আমরা অনুমান করতে পারি।যারা,স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তারা কি ভাবে তাও আমরা জানি। কিন্তু যারা স্বাধীনতা বিরোধী বা স্বাধীনতা বিরোধী নয় এমন অবস্থায় রয়েছে তারা কি ভাবেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ড নিয়ে? আমরা কি তার খোঁজ নিয়েছি? আওয়ামী লীগ বা বর্তমান সরকার কি সে খবর রাখেন? বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকার ভাবে কি না, তা আমি জানি না।
তবে ভাবা উচিত। কেন উচিত? সোজা উত্তর তারা মিসগাইডেড হয়েছে অনেকেই। কারা, কেন মিসগাইড করছে তরুন প্রজন্মকে তা বুঝতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একটি জাতির তরুন সমাজের বিরাট একটি অংশকে বাদ দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। সরকার পরিচালনা হয়তো সম্ভব এক টার্ম, দুই টার্ম, তিন টার্ম বা চার টার্ম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি তরুনরা ইতিহাস বিমুখ হয়ে যায়,প্রোপাগান্ডায় ডুবে থাকে৷ তবে এক সন্ময় জাতিও ডুবে যাবে।
অপ্রিয় হলেও সত্য এ দেশের তরুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রথমে নিন্দা না জানিয়ে খুজে হত্যার কারন! হত্যার কারন খোঁজা অন্যায় নয়। বরং ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড নিয়ে গবেষনা হওয়া উচিত। তাহলে জাতির সামনে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আসল চেহারা আরো বেশি উন্মুক্ত হবে। কিন্তু তরুনদের একটি অংশ ভিন্ন কারনে বঙ্গবন্ধু হত্যার কারন খুজে। যা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। তরুন প্রজন্মকে জানতে দিতে হবে, কোন আইন মুলে বাংলাদেশের জন্য কিউবা থেকে খাদ্য আনা যায়নি! কারা ৭৪ এ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলো,কেন করেছিলো।
তবে কিছু নির্বোধ সামরিক অফিসারের কারনে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে আমাদের ১৯৭১ স্বাধীনতা সংগ্রামও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারতো। যদি ভারত তখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের অজুহাতে ঢাকায় সৈন্য পাঠাতো। ভাগ্যিস সে দিন ভারত তার সেনাবাহিনী ঢাকায় পাঠায়নি। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরের দিন সৌদী আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ দেশের মুসলিমরা হজ্ব করতে পর্যন্ত যেতে পারতো না। তখন ভারতের বিশেষ পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের মুসলিমদের হজ্ব করতে যেতে হতো। ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকান্ডের সাথে কারা কারা জড়িত তা জানতে হলে যেতে হবে ইতিহাস ও রাজনীতির অনেক গভীরে। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের,গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ তথা সংবিধানের চারমূল নীতিকে উচ্ছেদ করার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। তরুন প্রজন্মকে তা জানতে দিতে হবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours