শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:
আমি তখন পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডায় থাকি। সময়টা ২০১৪ সালের অক্টোবর মাস। পুজোর সময়।
তিনবন্ধু মিলে ঠিক করলাম সপরিবারে রাজস্থান বেড়াতে যাবো গাড়িতে করে। আমার ও আর একবন্ধুর গাড়ি ছিল, কাজেই তিনটে পরিবার আরামেই যেতে পারবে। কিন্তু যাওয়া হবে কোথায়? গন্তব্যটা আমিই ঠিক করলাম। আলোয়াড়।
কিন্তু হঠাৎ আলোয়াড় কেন? ওলখানে তো ইতিহাসখ্যাত কোনো কেল্লা নেই? বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তরে আমি শোনালাম আগের বছর মানে ২০১৩র পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় পড়া ভুতুড়ে ভানগড় দুর্গের কাহিনী। রাত্রে নাকি পরিত্যক্ত কেল্লা থেকে বিভৎস সব আওয়াজ আসে ! লোকজন থাকতে পারে না রাতে ! শুনে সকলেরই আগ্রহ বাড়লো জায়গাটা দেখবার জন্য।
বরং ভানগড়ের মিথের কাহিনীটাই আগে শোনানো যাক।
কাহিনী ১ : ভানগড়ের রাজা ছিলেন দুর্দান্ত মাধো সিং। তিনি যখন প্রথম ভানগড়ের কেল্লা তৈরি করাচ্ছিলেন তখন এই কেল্লা তৈরিতে বাধা দেন এক সাধু। তার নাম গুরু বালুনাথ। কেল্লার চত্বরের এককোণে বালুনাথের আশ্রম ছিল। মাধো সিংকে গুরু বালুনাথ আদেশ দিয়েছিলেন, তিনি কেল্লা বানাচ্ছেন তাতে তার আপত্তি নেই। তবে কেল্লার ছায়া যেন তার আশ্রমের উপর না পড়ে। ছায়া পড়লে তিনি মাধো সিংয়ের এই সাধের কেল্লা ধ্বংস করে দেবেন। এই হুমকি দিয়েই কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হননি। রাজবংশের সবাইকে নাশ করার কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু কেল্লা বানানোর পর দেখা গেল, দিনের একটা সময় কিছু সময়ের জন্য হলেও কেল্লার ছায়া বালুনাথের আশ্রমের উপর এসে পড়ে। ব্যস, এতেই প্রচণ্ড রেগে গেলেন বালুনাথ। ক্ষুব্ধ হয়ে বালুনাথ ভানগড়ের কেল্লার সঙ্গে গোটা ভানগড় রাজ্য ধ্বংস করে দিলেন।
পরিত্যক্ত ভানগড়ে গেলে দেখবেন, সেখানে বাড়ির অভাব নেই। অথচ কোনো বাড়ির ছাদ নেই। কিংবদন্তি অনুসারে, বালুনাথ চেয়েছিলেন এই এলাকায় অন্য কেউ এসে যাতে বসবাস করতে না পারে, সেই কারণেই তিনি বাড়ির ছাদ উড়িয়ে দিয়েছেন।
কাহিনী ২ : আর একটি কাহিনী রয়েছে এই কেল্লাটিকে কেন্দ্র করে। রানী রত্নাবতীর গল্পটা আবার অন্যরকম। রত্নাবতী ভানগড়ের রানী ছিলেন। অসামান্য সুন্দরী হওয়ায় দেশ-বিদেশ থেকে রাজারা আসতেন রত্নাবতীকে রানী করার প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু রূপের অহঙ্কার ছিল রত্নাবতীর। তাচ্ছিল্য করে তিনি সবাইকেই ফিরিয়ে দিতেন। রানীর এলাকায় বাস করত সিঙ্ঘিয়া নামের এক তান্ত্রিক। সে রানীর প্রেমে মাতোয়ারা ছিল। একদিন রানী দাসীদের নিয়ে সুগন্ধী কিনতে বের হয়েছেন। তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া সুযোগ বুঝে সুগন্ধীতে মন্ত্র পড়ে দেন। সিঙ্গিয়ার মতলব ছিল, রানী এই গন্ধ শুঁকলেই বশীভূত হয়ে পড়বেন ও সিঙ্ঘিয়ার পেছনে পেছনে চলে আসবেন। কিন্তু রূপের সঙ্গে রত্নাবতীর বুদ্ধিও ছিল বেশ! তিনি সিঙ্ঘিয়ার এই ছল বুঝতে পেরে সুগন্ধীর বোতল একটি পাথরে ছুঁড়ে মারেন। জাদুবলে ওই পাথরটি বশীভূত হয়ে সিঙ্ঘিয়ার পেছনে ছুটতে শুরু করে। ফলে ওই পাথরের তলায় চাপা পড়ে সিঙ্ঘিয়া মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে রানীকে অভিশাপ দিয়ে যায়, রাজপরিবারের কাউকে সে বাঁচতে দেবে না। আর রানীকে সে মরার পরেও ছাড়বে না। এর কিছুদিন পর পাশ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে ভানগড়ের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে রাজপরিবারসহ গোটা ভানগড় ধ্বংস হয়ে যায়। ওই কেল্লায় নাকি তান্ত্রিক ও রত্নাবতীর অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেরায়।
ইতিহাস : ভানগড়ে পৌঁছে একটু খোঁজখবর নিলাম। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেল ১৫৭৩ সালে ভারতের রাজস্থানে ভানগড় কেল্লা তৈরি করেছিলেন অম্বরের শাসক রাজা ভগবন্ত দাস। কিন্তু অর্ধশতকের মধ্যেই ঘনিয়ে আসে পতন। ১৬৩০ সালে ছত্র সিং-এর শাসন থেকেই শুরু হয় ক্ষয়। ১৭৮৩ সালের দুর্ভিক্ষে এই নগরী পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কেল্লাকে ঘিরে একের পর এক মিথ তৈরি হলেও, এলাকার কেউ কখনও ভূতের দেখা পাননি। তবে রাতে তারা কেল্লা থেকে নারীপুরুষের কান্নার আওয়াজ পান। কেসটা তাহলে কি?
বাস্তব : ভিতরে ঢুকে মোটামুটিভাবে বোঝা গেল ব্যাপারটা। এখানে সূর্যাস্তের পর আর সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ একদম নিষেধ।আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে এই কড়া নির্দেশ। এই কেল্লায় নেই ইলেক্ট্রিসিটি। ভিতরে ইতস্ততঃ পুরানো ধ্বংসাবশেষ, বিশাল বিশাল ঝুরিওলা বটগাছ ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল এমনিতে দিনের বেলাই অন্ধকার করে রেখেছে এরিয়াটা। সাথে আছে অজস্র পাখি আর প্রচুর বাঁদর।
হায়না আর শিয়ালও নিশ্চয়ই আছে। রাত্রে সকলে মিলে যখন কোরাস শুরু করে জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে তখন আরও জমাট বাঁধে ভূতুড়ে গল্প। সব মিলিয়ে যাকে বলে, জমে ক্ষীর ! দুর থেকে রাতের বেলা ভয়ার্ত মানুষ নারীপুরুষের কান্না শুনবে, এতে আর আশ্চর্যের কি?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours