সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, লেখক ও সাংবাদিক কলকাতা:
ভালো থাকার জন্য সবার আগে জানা দরকার মানুষ নিজে কি চায়। কেন চায়। সত্যিই কি সেটা চায় ।তার ভবিষ্যৎ কে সে কিভাবে দেখতে চায়।
মানুষের ভবিষ্যত নির্ভর করে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণায়।আমি কী, আমার কে কী, আমার জীবন কিসের জন্য, আমার জীবনের ভাবনা কী, আমার বিশ্বাসটা কেমন, কী বিশ্বাস করি না, কেন করি না, যেভাবে আমি বাঁচি, তার সঙ্গে আমার ভালো থাকায় আমার মূল্যবোধ কতটা কাজ করে, কেন আমি মূল্যবোধ নিয়ে ভি
চলতে বাধা পাই, আমি যখন আত্ম সমর্পণ করি তখন কেন করি? তার জন্য আমার পরিস্থিতি না আমার লক্ষ্য কোনটা বেশি কাজ করে আমার মনে , আমি নিজে কতটা আবেগপ্রবণ, আর কতটা বাস্তববাদী? আদৌ কি আমার জীবনে আদর্শবাদের কোনো স্থান আছে? না থাকলে কেন নেই?তাহলে কি আদর্শ নিয়ে চলা বোকামি? তাহলে বোকামির নাম আদর্শবাদ হয় কি করে? তাহলে গোলমালটা কোনখানে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষের জানা থাকে না।তাই জীবনের গোলক ধাঁধায় মানুষ উত্তর না পেতে পেতে বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে।
প্রথমে জানা দরকার আমাদের সকলের, আমি কে? তাহলে জানতে পারব, আমার ভালো কোথায়।
চেনার চেষ্টা করব, কিভাবে ও কোন পথে আমরা সেই ভালো থাকার লক্ষ্যে পৌছতে পারবো?
এই ভাবনা চিন্তা নির্ভর করে মানুষের প্রকৃতির উপর। যে শারীরিক আনন্দে ভরপুর সে ত ত্যাগের আনন্দ বুঝবে না, চাইবেও না।যে ভ্রমণের আনন্দ চায় সে তো ঘরের কোণে থাকতে চায় না , আর যারা ঘরে থেকেই সুখ পায় তাদের সেই সুখ রাস্তায় পথে পথ চলার কষ্টে কোথায় খুঁজে পাবে?
তাই ভোজনরসিকদের সুখ ভোজনে, কবির সুখ নিভৃতে কবিতা রচনায়, রাজনীতিকের সুখ ক্ষমতার কাঁটা ঝোপে,সেলিব্রিটির সুখ মানুষের হাততালিতে।এভাবে যদি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আমরা মানুষের দুঃখের অবসানে একটা সুখের প্যারাডাইম রচনার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু আপেক্ষিক ভাবনার তারল্য নষ্ট করবে বিষয়টির দার্শনিক অভিক্ষা। আমাদের উচিত, তার আগে মানুষের প্রকৃতির বিশ্লেষণ করা।
মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই দ্বিচারী। তার মধ্যে বেঁচে থাকার সুখের সঙ্গে ভালো থাকার শান্তির দ্বন্দ্ব আছে।যাতে সে সুখ পায়, তার মধ্যে শান্তি নেই।আর যা তার শান্তির উৎস, সেখানে তার ভোগের তৃপ্তি নেই।তাই মানুষ নিজেই ভোগের জন্য জড়িয়ে পরে অশান্তিতে।তাই শেষে ঋষিরা বলেন,ত্যাগে শান্তি।
কিন্তু এই ত্যাগী ঋষিরাও ভয়ংকর ক্রোধে ফেটে পড়ছেন এমনটা প্রায়ই দেখা যায়। পুরানে বারবার দেখেছি। কেন? কারণ ইগো। ইগো মানুষের এক চরম অস্তিত্ব। যার উপরে সে নিজেকে নির্মাণ করে। যার মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পায়। তার নির্মাণ সেখানেই শুরু হয়। এখানে নির্মাণের নির্মাণ বস্তু তার প্রকৃতি ও পরিবেশ। জন্মগত প্রবণতা ও প্রবণতা অনুযায়ী মানুষ খুঁজে নেয় তার পরিবেশ থেকে নিজস্ব বিকাশের উপায় ও উপাদান। এ থেকেই তৈরি হয় তার জীবনের আদর্শ। আদর্শ অনুযায়ী লক্ষ্য। লক্ষ্য অনুযায়ী কর্মপন্থা। কর্মপন্থা অনুযায়ী কৌশল। কৌশল অনুযায়ী অগ্রাধিকার। অগ্রাধিকার অনুযায়ী সম্পর্ক। এই সিস্টেমের মধ্যে মানুষ নিরন্তর নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে, যেটা সে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় তার মতো করে সেটা হলো তার ইগো।এই ইগোর পাল্টা আরো এক দমিত ইগো আছে। যেটা মানুষের ঘুমন্ত সত্তা। চেতন সত্তা বা ইগো ও ঘুমন্ত সপ্তা র মধ্যে একটা আন্ত সম্পর্ক আছে।সেটা কখনো কখনো দ্বন্দ্বমূলক কিংবা পরিপূরক। এই দুই ইগোর মধ্যে একটা নিরন্তর মিথস্ক্রিয়া চলে। এ থেকেই মানুষের মধ্যে দু'রকম পরস্পর বিরোধী মূলক ভাবনা বা বস্তুর প্রতি অনেক সময় আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং একটি পরস্পর দ্বন্দ্বমূলক প্রকৃতি গড়ে ওঠে । যেমন যা একই সঙ্গে ভোগ মূলক ও ত্যাগ মূলক। একই সঙ্গে মুক্ত ও বদ্ধ হতে চায়। একই সঙ্গে নির্মাণের ভাবনা ও সৃজনের আকাঙ্খার সঙ্গে ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী মনোভাবেরও পরিচয় দেয়। এই কারণে মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দমনমূলক প্রবৃত্তি ও দমিত হয়ে থাকার নিবৃত্তি র মধ্যে সুখ খোঁজার চেষ্টা চলে। মানুষের এই প্রবণতা র উপরই নির্মিত হয় সমাজের ভাবনা, আদর্শ, আচরণবিধি, মূল্যবোধ যা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ এই ভাবেই সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে তার জীবনের সুখ ও ভালো থাকার উপায় খুঁজে নেয়। এই উপায় খোঁজার মধ্যে নিরন্তর ভাঙ্গা গড়া চলে। সময়ের হাত ধরে পরিবর্তিত হতে থাকে সমাজের ভাবনা, আদর্শ , আচরণবিধি , মূল্যবোধ। পরিবর্তিত হতে থাকে প্রযুক্তির কারণে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ। তার থেকে জন্ম নেয় সামাজিক শ্রেণী বিভাজন। সময়ের হাত ধরে বদলে যাওয়া প্রযুক্তি বদল ঘটায় অর্থনৈতিক উৎপাদনের ধারা ।
পরিবর্তন করে মানুষের বেঁচে থাকার অস্তিত্ব। তার প্রভাবে বদল ঘটতে থাকে সামাজিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ, আচরণবিধি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম করে এগুলি প্রভাবিত হয়। কিন্তু পুরোটাই ঠিকঠাক করে দিতে পারে না। এই না পারার কারণ মানুষের অন্তর সত্তা। যুগে যুগে এটাই মানুষের সভ্যতার মধ্যে বিলীন হয়ে থাকা এক অন্তর শক্তি যা সভ্যতার মোড় ও গতি পরিবর্তন করে দেয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরই নাম বিপ্লব। এর সূচনা ও ক্রিয়াকলাপ চলে চেতনায়। সর্ব সময় চেতন ইগো ও ঘুমন্ত ইগো র পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে , ঋদ্ধ হয় চেতনা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours