fiture
শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ: আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। তাঁর বিজ্ঞানচেতনা সম্বন্ধে আলোচনা করতে বসলে আমাদের তাই বারংবার বিস্মিত হতে হয়। আমরা দেখেছি 'বালক' ও 'সাধনা' পত্রিকাদুটিতে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানালোচনায় প্রথম উদ্যোগী হন যাহাতে তিনি বেশ কযেকটি বিজ্ঞানপ্রবন্ধ লিখেছেন। ভারত উপমহাদেশ তিন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে বরাবরই তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ১৯০১ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি 'জড় ও সজীব' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তবে বঙ্গসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান 'বিশ্বপরিচয়', যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। এতে তিনি পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগত, গ্রহলোক ও ভূলোক - এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশ্বপরিচয় বইটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। গ্রন্থটির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, "শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক।" আমরা মনে করতে পারি বিজ্ঞান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার প্রকৃত প্রকাশ এই মন্তব্যটিতে। একই সঙ্গে আমরা এক অন্য রবীন্দ্রনাথকেও পাই। দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধসমুহের প্রায় সবটাই "বিভিন্ন নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক বিষয়ের প্রকাশকে ঘিরে, দু-একটি অতি বিরল ক্ষেত্র ছাড়া বিজ্ঞানমনস্কতা বা বৈজ্ঞানিক দর্শনের প্রশ্ন সেখানে প্রায় ওঠেনি বললেই হয়।"
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গবেষক আশীষ লাহিড়ী দেখিয়েছেন, ১৮৭৬ সালে মহেন্দ্রলাল সরকারের তৈরি 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স' সংস্থাকে রবীন্দ্রনাথ প্রবল সমালোচনা করেছেন। মহেন্দ্রলাল চেয়েছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে পুরোদস্তুর এক শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান গড়তে। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত এক রচনায় মহেন্দ্রলাল ও তাঁর তৈরি সংস্থ‍াকে "নিজের ঘরদুয়ার ফাঁদা", "বহুব্যয়সাধ্য আসবাব সংগ্রহ" বা "স্থায়ী অর্থের সংস্থান" নিয়ে তীব্র বক্রোক্তি করেন। "রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান গ্রন্থে বিজ্ঞানী দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন, টেকনোলজিকে তিনি মোটেই পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেন নি।" এরপর যখন আমরা জানতে পারি প্রেতচর্চায় প্রবল আগ্রহ ছিল কবির, তখন আমরা রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান সচেতনতা নিয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ হয়ে পড়ি। "রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চার প্রসঙ্গটি যতটা কৌতুহলোদ্দীপক, এ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য ঠিক ততটাই বিরল" হলেও তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ থেকেই বোঝা যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেটের চল ছিল। রানী মহলানবীশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সূত্র ধরে অমিতাভ চৌধুরী কবির পরলোকচর্চা বিষয়ে আগ্রহী হন। কৌতূহলের বশেই তিনি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে খুঁজে পেয়েছিলেন আটখানি খাতা। প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে অমিতাভ 'রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা' শীর্ষক এই বেষ্ট সেলার গ্রন্থও লিখে ফেলেন। দেখা যায় যে প্ল্যানচেট করবার বিষয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না৷ ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত 'ভারতী' পত্রিকার আশ্বিন, ১৩০১ সংখ্যায়, প্ল্যানচেট করার জন্য এক আশ্চর্যজনক ভৌতিক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। যন্ত্রটি ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল, তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটির বাংলা নামকরণ করেছিলেন, ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’৷ এমনকি 'থিওসফিক্যাল সোসাইটি'র সদস্যদের বাড়ির মেয়েদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল মহিলা থিওসফিক্যাল সভা, যার অধিবেশন বসত ঠাকুরবাড়িতে। স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন তার প্রেসিডেন্ট। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এইভাবেই যন্ত্রের সাহায্যে প্ল্যানচেট করে কবির সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের প্রথম আলাপ হয়েছিল। মধুসূদনের মৃত্যুর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স বারো বছর, সুতরাং সেই আলাপচারিতা তাঁর কৈশোরের অভিজ্ঞতা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে কারণ সেই সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত প্রেতচক্র বসতো এবং কিশোর কবিরও সেই চক্রে বসার স্বাধীনতা ছিল৷ মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিষয়ে কিছু মনে আছে কি না, জানতে চাওয়ায় প্রমথনাথ বিশিকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমি তাঁকে দেখিনি, একবার প্রেতবাণী চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আদালতে সাক্ষ্যরূপে গ্রাহ্য হবে না।’’ কুড়ি-একুশ বছর বয়সেও তিনি প্ল্যানচেট করতেন, তার লিখিত প্রমাণ রয়েছে৷ কিন্তু সেই চক্রের আয়ুও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কারণ, অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু৷ ‘জীবনস্মৃতি’ তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরলোকের ব্যবস্থা কেমন, গুরুজনেরা প্ল্যানচেটযোগে একবার স্বভাব-রসিক কৈলাসকে এই প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছিল, ‘‘আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।’’ অনেক বছর পরে, তখন কবির বয়স আটষট্টি বছর, রবীন্দ্রনাথ আবার পরলোকচর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন৷ ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয হয় প্রেতচর্চায় অলোকসামান্য ক্ষমতার অধিকারিণী এক তরুণীর৷ শরতের শেষ, আশ্রম জনশূন্য, রবীন্দ্রনাথ একাই ছিলেন উত্তরায়ণ ভবনে৷ তাঁর অতিথি হয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথের পুরোনো বন্ধু ও তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা, ডাকনাম বুলা৷ কয়েক দিনের মধ্যেই কবির কানে খবর গেল, উমা একাধারে কবি এবং ভাল মিডিয়াম৷ উমাদেবীর ভাল মিডিয়াম হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে জানতে পেরে কবি খুবই আগ্রহী হয়ে নিয়মিত প্রেতচক্রের আয়োজন শুরু করেন৷ তিনি প্রেতলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সরাসরি মিডিয়ামের সাহায্য নিয়ে শুরু করলেন প্ল্যানচেট৷ প্ল্যানচেটে মিডিয়াম হতেন উমা। আহ্বায়ক রবীন্দ্রনাথ। লিপিকর অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। প্ল্যানচেটের সঙ্গী হতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, মীরা দেবী প্রমুখরা। প্রাথমিক ভাবে মিডিয়াম নিয়ে কবির সন্দেহ থাকলেও আত্মাদের উত্তরের প্রকৃতি দেখে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস জন্মায় এ বিষয়ে। আর কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে কবি জাস্টিফিকেসন দিতেন, "নূতনকে জানার আগ্রহ কেন হবে না, জানতে দোষ কী !" প্ল্যানচেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, ছোট বউ মৃণালিনী, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা, অজিত চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়- এছাড়াও আরো অনেকে। প্ল্যানচেটের সময় অনেক অযাচিত আগন্তুকরাও আসতেন। কখনোই আসেননি পিতা দেবেন্দ্রনাথ, মাতা সারদা দেবী, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ। যাইহোক, মিডিয়াম উমা দেবী ১৯৩১ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে নিজেই চলে গিয়েছিলেন তথাকথিত পরলোকে। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘পারলৌকিক যোগাযোগের সেতু’। উমা মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য, "তরুণী কবি উমা সরন বা 'বুলা'-ই সবসময় কেন মিডিয়াম হন? স্রেফ রাজি ছিলেন বলে, না নেহাৎই ঘটনাচক্রে, নাকি কোনো বিশেষ মানসিক বৈশিষ্ট্যের কারণে? মাঝে মাঝে অনাহুত যে অপরিচিত আত্মারা আসরে ঢুকে পড়ে তারা প্রায় সবাই কেন কাব্যিক বোধসম্পন্ন রবীন্দ্রভক্ত তরুণী? সে কি এই কারণেই যে বুলা স্বয়ং তা-ই-ই ছিলেন।কেন কবি কেবল বন্ধুস্থানীয় ও স্নেহভাজন আত্মাকেই ডাকেন, দেবেন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রনাথের মতো কড়া ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিভাবকস্থানীয়দের কদাপি নয় বা এমনকি তাঁর মা-কেও নয়? প্ল্যানচেটের পেছনে কি তাঁর এমন কোনও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা ছিল যা এঁদের দ্বারা মেটাবার প্রত্যাশা তিনি করতে পারেন নি? কবির একদা-সচিব ও গুণগ্রাহী পিয়ারসন সাহেবের আত্মাই-বা ডাকলেও কখনও আসে না কেন - মিডিয়াম বুলা তাঁর মতো করে ইংরেজি বলতে পারবেন না বলেই কি?" হয়তো প্রথমে বিশুদ্ধ কৌতূহল থেকে আরম্ভ করলেও, রবীন্দ্রনাথ যে প্ল্যানচেটে রীতিমত বিশ্বাস করতেন তা পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জানা যায়।
অলৌকিকতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর গৃহে অবস্থানকালে যখন রবীন্দ্রনাথ কথাপ্রসঙ্গে অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, "তোমরা সব ভারি মস্ত বড় সায়েনটিস্ট হয়ে উঠেছ কিনা। যা systematicaly proved হবে না তাতেই অবিশ্বাস। কটা বিষয় প্রমাণ হয়েছে সংসারে? তাছাড়া এমন কিছু থাকা খুবই সম্ভব, যা প্রমাণ হয় নি, হতে পারে না। কারণ তা সব মানুষের জ্ঞানের গম্য নয়।" বিতর্ক চলতে থাকে এবং রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, "পৃথিবীতে কত কিছু তুমি জানো না, তাই বলেই সেসব নেই? কতটুকু জানো? জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম।" অবশেষে প্ল্যানচেট বিষয়ে গোঁড়া বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ একজন নিতান্তই ভাববাদীর মতো নিজস্ব সিদ্ধান্ত জানান, "আর তাছাড়া এত লোক দল বেঁধে ক্রমাগত মিছে কথা বলে, এ আমি মনে করতে পারি নে।" উপরোক্ত কথোপকথন থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনাকে যথেষ্ট পরিমাণে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় তাঁর কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞানের অগাধ বিশ্বাস। কারণ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানমনস্কতার থেকেও বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে। (তথ্যসূত্র : বঙ্গসাহিত্যে বিজ্ঞান - বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ; যুক্তিবাদীর মর্মকথা - দেবাশিস ভট্টাচার্য ; মংপুতে রবীন্দ্রনাথ - মৈত্রেয়ী দেবী ; রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান - আশীষ লাহিড়ী ; ভূতেদের ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পাননি বিশ্বকবিও - এবেলা.ইন, ৯ই জুন ২০১৭ ; প্রেতবৈঠক - আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours