কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
তালাক তালাক তালাক।
শেষ
তিন তালাকের পালা, মঙ্গলবার থেকে। ব্যাপক রাজনীতির হার্ডল পেরিয়ে অবশেষে,
রাজ্যসভায় বিল পাশ। আল্হাদে আটখানা বিজেপি। মনখারাপ বিরোধীদের।
তাহলে
বুধবার থেকে মুসলিম মহিলাদের মাথায় নিরাপত্তার ছাতা ধরা গেল কী? তিন তালাক
বেআইনি হওয়ায়, হিমশীতল সম্পর্কে খানিক উষ্ণতার গ্যারান্টি সত্যিই দেওয়া
গেলো তো?
সমস্যাটা তো আসলে তালাক না। সমস্যা, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ওই ছোট্ট তিন অক্ষরের তিন শব্দে। সমস্যা মানসিকতায়।
তালাক
মানেই সম্পর্ক শেষ। শেষ দাম্পত্য। বিচ্ছেদ। কিন্তু তালাক না হলেও কি
সম্পর্ক টিকে থাকে? হারিয়ে যায় না দাম্পত্যের উষ্ণতা? উষ্ণতা হারিয়ে
সম্পর্ক জিইয়ে রাখা, সেটাও অসহনীয়।
ধরে
নেওয়া যাক এমন এক স্বামীর কথা। যিনি তালাক দিতে পারছেন না আইনের শাসনে।
তার তর্জনে গর্জনে। বহুদিন ধরেই চলছে দাম্পত্যের খটামটি। একদিন অফিস থেকে
সময় মতো বাড়ি ফিরে দেখলেন, টিভি রিমোটে চাপা দেওয়া ছোট্ট এক চিরকুট।
- ফিরতে দেরি হবে। খেয়ে নিয়ো।
ব্যাস,
দপ করে জ্বলে উঠলো মাথার আগুন। কী, এতো বড় স্পর্ধা! আমারটা খাবে, আমারটা
পরবে। আবার আমাকেই চোখ দেখাবে? এক লহমায় পুরুষ সিংহের বজ্র নির্ঘোষ।
- তালাক তালাক তালাক। তিন তালাক।
তবে ফাঁকা ঘরে। তাই কেউ শুনতে পায়নি।
আসলে
স্যার, আপনি যখনই ঘরে ফেরেন, আপনার সারা শরীরে সিগারেটের কটূ গন্ধ।
ম্যাডাম কোনদিনই মেনে নিতে পারেনি। আর পারবেই বা কিভাবে, অ্যাজমা পেশেন্ট
তো।
ম্যাডাম অনেকবার আপনাকে সেকথা বলেছেও। কিন্তু
আপনি পাত্তাই দেননি। অগত্যা, একদিন চুপ মেরে গেছিল আপনার স্ত্রী। কিই বা
করতো। আফটার অল, আপনারটাই তো খেতো, পরতো। থাকতোও আপনারই ফ্ল্যাটে।
সেদিন
ওঁর হাঁপানির টানটা খুব বেড়ে গেছিল। আপনি সব জেনেশুনেও, কফির কাপ শেষ হতেই
ডিভানে বসে পুরো সিগারেটটা ফুঁকেছিলেন স্যার। ইনহেলারের একটা পাফে হয়নি
ম্যাডামের। সেদিন ম্যাডাম পাশের ঘরে গিয়ে খুব কেঁদেছিলেন।
আর সেই মুহূর্তেই ম্যাডামের মন, আপনাকে তিন সহস্রবার তালাক দিয়ে শিউরে উঠেছিল। কিন্তু তালাক দেওয়ার অধিকার তো স্যার শুধু আপনার।
আপনিও
রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেন। বাথরুম ফ্রেশ হয়ে বসে, এক কাপ কফি খাওয়ার
অভ্যাস ছিলো আপনার। নিদেনপক্ষে চা। বিয়ের পর শুরুর দিকে নিয়মিতই পেতেন।
তারপরেই ডিভানে গা এলিয়ে, আয়েস করে সিগারেটে আগুন দেওয়া। ম্যাডাম অন্য ঘরে
চলে যেতেন। তবুও আপনার একরাশ নির্লিপ্ত উদাসীনতা। মেয়েমানুষকে অত পাত্তা
দেওয়ার আছেটাই বা কী? বহুযুগের সংস্কার।
তালাক না হলেও বিভাজন হয়ে গেছিলো বৈকি।
কিছুদিন
যেতে না যেতেই, ব্যাপারটা গেছিলো বদলে। আপনি চা বা কফি চাইলে, তবেই পেতেন।
আর সেই কফি বা চা খেয়ে, মেজাজটা ঠিক শাহেনশাহর মতো রং ধরতো না। একটু
টানটান চিনি আপনার পছন্দ। তখন যেন চিনিটা মাঝেমধ্যেই বেশি হতে লাগলো। আপনিও
হাফ কাপ খেয়ে, হাফকাপ জাস্ট ফেলে দিতেন।
"এটা কফি
নাকি শরবত?" যেদিন আপনি রেগেমেগে জানতে চেয়েছিলেন, মুখের ওপর তার জবাবটাও
পেয়ে গেছিলেন। মোক্ষম সে জবাব। আপনার কল্পনাতেও ছিলো না।
- "কাল থেকে নিজে বানিয়ে খেয়ো।"
মিষ্টি দাম্পত্যে সেদিনই তেতোর স্বাদ ধরেছিল।
তালাক না দিলেও চিড় ধরেছিল আপনাদের সম্পর্কটাতে। এই তালাক আরও ভয়ঙ্কর। না, আর কাছে আসতে দেয়। না দূরে যেতে দেয়।
সম্পর্কের
ভাঙনও যা, নদীর ভাঙনও তা। একই ধারার। অবুঝ অসহিষ্ণুতার ঘুনপোকা ফোঁপরা করে
দেয় নরম মনের এঁটেল মাটি। সেই মাটি ধীরে ধীরে, কিন্তু প্রতিনিয়ত, একটু
একটু করে খসে পড়তে থাকে নদীবুকে। আর সম্পর্কের শেকড় যায় আলগা হয়ে। তারপরেই
ট্রিপল তালাক। গোড়া থেকেই সম্পর্কটা যায় উপড়ে। কালকের সুখী দাম্পত্য, আজ
ভেসে যায় নদী উজানে।
আপনিও
ইজ্জতদার পুরুষ। কোনও লোকহাসানো ব্যাপারে যেতে চাননি। পরদিন থেকে মোড়ের
মাথাতেই চা খেয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকতেন। কলিং বেল বাজালেই দরজা খুলে যেত। কিন্তু
ম্যাডামের হাসিমুখ দেখে আর ফ্ল্যাটে ঢোকা হতো না। তিনি তখন অনর্গল বকে
চলেছেন মোবাইলে। ধীরে ধীরে পুরনো অভ্যাসের বদলে যেতে লাগলো অনেককিছুই।
আপনারা তখনও স্বামী- স্ত্রী। তবে দাম্পত্যের মহাসাগরে ভাসা দুজনেই দুই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা।
তালাক
আপনাদের বিচ্ছিন্ন করেনি। দুজনেই দুদিকে ছিটকে পড়েছিলেন পুরুষতন্ত্রের
ঢেউয়ের ধাক্কায়। সেই ঢেউকে উসকানি দিয়েছিল এক পাহাড় নারীসুলভ অভিমান। এক
মেঘ নির্লিপ্ততা।
আপনার
চব্বিশ ঘণ্টা, এবিপি আনন্দ দেখার সময় বাড়লো। ম্যাডামের কোনওকালেই সিরিয়াল
দেখার বাতিক ছিলো না। তিনি হলেন মোবাইলে বুঁদ। ভিডিও চ্যাট। এই হাসেন। আবার
এই কপট ঝগড়া করেন। ফিসফাস তো চলতেই থাকে। কার সঙ্গে ম্যাডাম অনবরত এসব
করে চলেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না আপনি। কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়। রাত দশটা
বেজে গেলেও খাবার টেবিলে ডাক পড়ে না। ওদিকে পেটেও ছুঁচোর ডন।
ভাবেন। ভাবতে বাধ্য হন, তালাক দিয়ে দেবেন। তাতে যা হয় হোক। আইনের নিকুচি করেছে।
আপনি
শুয়ে পড়লেও ম্যাডাম তখন অন্য ঘরে। ফোর্সড সিঙ্গল আপনি। বিছানায় পাক্কা
নিরামিষ। শরীরের যৌনপোকাগুলি কিলবিল করে উঠতো অনেক সময়। স্বামী বলে কথা!
ইচ্ছে হতো স্ত্রীকে টেনে এনে বিছানায় ফেলতে। তারপর কোনওরকম আদর ভালবাসা না,
পূর্বরাগ- টাগও না। নির্ভেজাল ধর্ষন। তাহলে হয়ত মন খানিকটা শান্ত হতো।
নইলে একেবারে তিন তালাক।
ভাবেন ঠিকই, কিন্তু মুরোদে কুলোয় না। না ধর্ষণ। না তালাক। ভদ্রলোক বলে কথা। সমাজে একটা মানইজ্জত আছে তো!
ম্যাডামও বুঝে ফেলেছিলেন আপনার সেই অক্ষমতার কথা। তাই তিনিও আপনাকে আর পাত্তা দিতেন না। নিউটনের তৃতীয় সূত্র স্যার।
প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।
আপনার
সারা শরীরে তখন যৌনবিষের জ্বালা। বৃষ্টিটাও আর হওয়ার সময় পায়নি। সেই থেকে
হয়েই চলেছে। যত সব অনাসৃষ্টি। ওদিকে ম্যাডামের কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
তিনি তখন পাশের ঘরে। ওঁর খাওয়া- দাওয়া হয়েছে কিনা, আপনি কিছুই জানেন না।
আর জানবেনই বা কী করে? আজকাল তো আর একসঙ্গে খেতে বসা হয় না।
বিছানায়
আপনি একা। একবার এপাশ, আরেকবার ওপাশ। ঘুম আর আসে না। আপনি জানতে পারেননি,
ম্যাডামের শরীরেও তখন বান ডেকেছে। আপনি একবার হাত বাড়ালেই, আপনাকে ভাসিয়ে
নিয়ে যেত। কিন্তু ওই যে আপনাদের জেদ!
আপনি
তখন বিষের জ্বালায় অস্থির। ভাবছেন তালাকটা একবার দিয়ে দিলেই মজাটা বুঝবে।
কত ধানে কত চাল। বিষে বিষক্ষয়ের মতো আর কী! তারপর? একজনের বিসর্জন,
আরেকজনের আগমন। কিন্তু সেই আরেকজনের সঙ্গেও সুরে সুর মিলবে তো? নেবেন নাকি
ঝুঁকিটা?
- তালাক তালাক তালাক।
আজ থেকে তো আবার সেই গুড়েও বালি।
স্বামী
স্ত্রী, দুজনে একই ছাদের তলায়। তবু মধ্যে দেয়ালের অভেদ্য আড়াল। দরজা
হাটখোলা। তবু বেরনোর রাস্তা নেই। একজন হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে না। হাত
বাড়াতে হবে দুজনকেই। ইগোর জার্সি খুলে বেরিয়ে আসতে হবে নগ্ন আদিম মনে।
মুসলমান না। হিন্দুও না। শিখ ক্রিশ্চান কিছুই না। শুধুই নির্ভেজাল মানব
মানবী। আদম ইভের মতো।
আপনার মনে হঠাতই সন্দেহ উঁকি দেয়। ম্যাডাম অন্য কারও সঙ্গে রোমান্স করছে নাতো! নইলে এত রাতে কার সঙ্গে সমানে বকবক?
- তালাক দিয়ে দেব?
আপনার
মন জিজ্ঞেস করে মগজকে। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষের মগজ। মনের আবেগকে
পাত্তাই দেয় না সেই মেধাবী মগজ। সে আবেগে চলে না। সে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ
করে। তবে যা সর্বনাশ হওয়ার তা কিন্তু ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ভেতরে
ভেতরে চলেছিলো তার প্রস্তুতি। জমা হচ্ছিল চাওয়া- না পাওয়ার রাগ, ক্ষোভ।
আপনাদের দুজনেরই। আর ততোই দুজনে দুদিকে সরে গেছেন। তবুও আপনি তালাক দেননি।
মুখে
হয়ত 'তালাক তালাক তালাক' উচ্চারণ করেননি। কিন্তু মনের ভেতর চাগিয়ে ওঠা, ওই
সন্দেহটাই তালাক। ওই তালাক আরও ভয়ঙ্কর। মনের ভেতর তোলপাড় করা এই তালাককে
আইন দিয়ে শাসন করা যায় না। লোকসভা রাজ্যসভায় ট্রিপল তালাক বিল পাশ করিয়েও
নয়। ওই বেয়াড়া তালাককে শায়েস্তা করতে পারে একমাত্র মানবিকতা। ভালবাসা।
ভালবাসাই একমাত্র নিরাপত্তা।
এবার
স্যারেরা পুরুষতন্ত্র ছেড়ে শুধুই একজন পুরুষে বদলে যান। আর ম্যাডামরাও
মেয়েলি মান- অভিমান শিকেয় তুলে, আপনার পুরুষের ওপর আরেকটু সহানুভূতিশীল
হোন। ম্যাডামরাই পারেন, স্যারদের পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে
দিতে। আপনারাই তো সমাজকে দিশানির্দেশ দেবেন।
তার আগে দুজনেই দুজনাকে একটু বদলান। একে অন্যের আশ্রয় হোন। দুয়ে ছাড়া দুজনেই অসম্পূর্ণ।
তালাকের স্পর্ধা কি, আলাদা করে সৃষ্টির আদিম সম্পর্ক দাম্পত্যকে!
আদম ইভের বিচ্ছেদ অসম্ভব।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours