Fiture
শেখ ফরিদ, লেখক ও সমাজকর্মী, বাংলাদেশ: পরমাণূ ভাঙ্গার চেয়েও নাকি কুসংস্কার ভাঙা কঠিন, বলেছেন আইনস্টাইনের মত কালজয়ী বিজ্ঞানী। আসলেই কি তাই-ই? একটু খোজ নেয়া যাক। আমার ছোটবেলার বিশ্বাস ছিলো জলে দেও -দৈত্য আছে। যারা শিশুদের পা টান দিয়ে নিয়ে চলে যায় গভীরে। জলে দেও দৈত্য আছে এটা অপবিশ্বাস ই নয় কুসংস্কার। এ অপবিশ্বাস, কুসংস্কারে আক্রান্তছিলো আমার প্রতিবেশিরা, আমার সমাজের মানুষেরা। আক্রান্ত ছিলাম আমি ও আমার পরিবার। তবে আমার মায়ের মুখে কখনো দেও দৈত্যের কথা তেমনভাবে শুনিনি। যেমন ভাবে অন্যরা বলে থাকে। ছোট বেলায় আমার জগৎ ছিলো নিজের ঘর ঘরের সামনে সামনে হিন্দুপাড়া। ডানে প্রতিবেশি ছিলো স্বল্প সংখ্যক বিহারী। বাজার, নানার বাড়ি আর দু তিনটা সাপ্তাহিক হাট। সর্ব্বোচ্চ জেলা সদরে বছরে দু-একবার। এছাড়াও বাজারের বিহারি নরসুন্দরদের সাথে ছিলো আমার দহরম মহরম। যা,এখনো আছে। যেমন রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে ।
প্রতিবেশি বিহারীরা কেউ চলে গেছেন পাকিস্তানে কেউ চলে গেছেন ভারতের উত্তর প্রদেশে। কিছু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকও চলে গেছে ভারতে। কেজি স্কুলে পড়ার সময় হেটে স্কুলে যেতাম। তখনো রিক্সা চোখে দেখিনি সাদাকালো সিনেমার পর্দায় বা টেলিভিশনে দেখা ছাড়া। স্কুলে যাওয়া ও আসার পথে দেখতাম সাপুড়ে সাপ খেলা দেখাতো। আমার গলায় চার বছরে অন্তত ৫০ বার সাপ পেচিয়ে দিয়েছে। স্কুল ড্রেস থাকায় সাপুড়েরা উপস্থিত দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষন করার সুবিধা বেশি পেতো। সাপকে দুধ কলা খাওয়ার কথা বলে টাকা নিতো। অসুখ বিসুখ জাদু টোনার প্রভাবের কথা বলে তাবিজ বিক্রি করতো। যৌন সঙ্গমের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির কথা বলেও গাছের শেকড় বেচতো। মামার বাড়ি গিয়ে একটা গল্প শুনতাম, সাপ নাকি আমার মামিরও দুধ খেয়েছে! আমার স্কুলের শিক্ষকরাও বিশ্বাস করতেন সাপে দুধ খায়। বহুবার শুনেছি গরুর পা পেচিয়ে ধরে দারাইজ সাপ (দুধরাজ সাপ) দুধ খেয়েছে! আমিও ২১ বছর বয়স পর্যন্ত বিশ্বাস করেছি সাপে দুধ খায়। তারপর যখন সাপের মানুষের স্তন ও গরুর বাট চোষার অক্ষমতা বুঝতে পারলাম তখন থেকে সাপের দুধ খাওয়ার আষঢ়ে গল্প অবিশ্বাস করা শুরু করলাম। সমস্যাটা শুরু তখনি। সাপে কোন নারীর স্তনের দুধ বা গরুর বাট থেকে খায় না বা খেতে পারে না৷ তা বলার কারনে আমিই উল্টো বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হই। অনেকেই ক্ষুব্ধও হন। এমন কি সাপে দুধ চুষে খেতে পারে না বলাতে। দুজন আমাকে মারতেও এসেছিলো। একজন তো আমার বাবার বয়সিই। সাপে দুধ চুষে খেতে পারে না। এটা বলাতে কোন মানুষের ধর্মানূভূতি আহত হওয়ার কথা নয়। ইসমলাম ধর্মের লোকদের তো নয়ই। কিন্তু এই সাপুড়ে,বেদে ও ওঝাদের থেকে প্রাপ্ত অপজ্ঞানের বিরোধিতা করতে গেলে আমার উপর একশ্রেনীর লোক ক্ষেপে যায়! আসলে মানুষ তার অপজ্ঞান, অপবিশ্বাস, অজ্ঞানতা প্রকাশ হয়ে গেলে প্রথমে সে লজ্জিত হয়। তারপর নিজেকে পরাজিত ভাবে এবং ক্ষুব্ধ হয়। এটাই স্বাভাবিক। এতে অন্য বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়। একজন মানুষ যখন একটি কুসংস্কারে আটকে যায় তখন সে আর একটি কুসংস্কারেই আবদ্ধ থাকে না। কুসংস্কারের জালে আটকা পরে। তেমনি একজন মানুষ যখন একটি কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসে তখন সে একটি কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসে না। সে আসলে কুসংস্কারের একটি জাল ভেদ করে বেরিয়ে আসে এক সময়। অদ্ভুত বিষয় হলো আমি যখন দেও দৈত দানব পরী ভূত প্রেতের অস্তিত্ব অস্বীকার করা শুরু করলাম। তখন আমাকে নাস্তিক বলা শুরু হলো! আমি তখনো কমিউনিজমের রাজনীতিতে অংশ নেইনি। নাস্তিক হওয়ার মত সাহস শক্তি চিন্তা বুদ্ধি কোনটাই আমার ছিলো না। অপ্রাসঙ্গিক হলেও কথাটা এজন্য বললাম, আমরা তখন জানতাম কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক! কিন্তু আমাকে কমিউনিষ্ট রাজনীতিতে আাসার আগেই কেবল কুসংস্কার ও অপবিশ্বাস অস্বীকার করার কারনে শরীরে নাস্তিকতাবাদের লেবেল লাগিয়ে দেয়া হলো। ছোট বেলায়,শুনতাম বালিশে বসতে নেই অসুখ হবে। এদিকে বা,ওদিকে পেশাব করতে নেই পাপ ও অমঙ্গল হবে। ঘর থেকে বাইরে বের হলে পেছন থেকে ডাকতে নেই। আংটি ব্যাবহারে ভাগ্য ফেরে! ঢাকার অভিজাত বিপনীগুলোতে ভাগ্য ফেরানোর আংটিও কম বিক্রি হয় না! যাদের "ছোট ছোট ভাগ্য' তারা পথে হাটবাজারে কম দামের পাথরে শোভিত আংটি কেনে। ছাতা নিয়ে সিলেটের অজোপাড়া গায়ে একটি বাড়িতে প্রবেশের সময় তো অল্পের জন্য মার খাইনি। ছাতা নিয়ে কারো বাড়ি প্রবেশ করলে নাকি সে বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয় না! বিয়ে আটকে যায়। আমার এক বাল্যবন্ধুর বাবাকে তাবিজ কবজ বেচে চলতে দেখেছি। আমি নিজেও অনেকবার মসজিদে মাজারে গিয়েছি তাবিজ কবজ আনতে। টাঙ্গাইলের হামীদপুরে তো একবার এক কমবয়সী কিশেরের সর্বরোগের মহৌষধ "পানি পড়া " নিতে পিপিলিকার মত ছুটে ছিলো সারা বাংলার মানুষ! আমি নিজেও সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর অনুরোধ। দেখেছি হাজার হাজার নয় ; লাখ লাখ মানুষের সমাগম। মাইকে ফু দেয়া হয় আর আগত ব্যাক্তিরা সাথে আনা জলের পাত্রের মুখ তখন খুলে রাখে। বাড়ি ফিরে গিয়ে সে জল পান করে! আমার শ্বাশুড়ি আমার মেয়কে লুঙ্গি পরতে দেখে তা টেনে খুলে নেয়। আমি জিজ্ঞেস করলে আমার শ্বাশুড়ি জবাব দেন, মেয়েরা লুঙ্গি পরলে।দ্যাশে দুর্ভিক্ষ হয়! তিনি জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমরনীতি বুঝলে এ কথা বলতেন না। সে তো গেলো অনেক আগের কথা। ইদানিং সারা রাজধানী ঢাকা শহরে দেয়াল ছেয়ে গেছে। তান্ত্রিক নারী পুরুষের ছোট ছোট লিফলেটে। যা গ্রামে সাটালেও পাবলিকের হাতে মার খেতো। এই সকল তান্ত্রিকেরা মানুষের যে কোন সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন! এমন কি ভিসাও পাইয়ে দেন! তখনি কেবল এসব ছড়ানো সম্ভব যখন একটি দেশের মানুষ কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসে ডুবে থাকে। আমি এক নারীকে চিনি তাকে হাত বেধে বিয়ের পিড়ীতে বসানো হয়ে ছিলো। তাকে নাকি ধর্মগ্রন্থের "কিড়া' দিয়েছিলো । এটা বলে দিলে তার পাপ হবে,ক্ষতি হবে! (অন্যায় যে করলো তার ক্ষতি হবে না! ক্ষতিহবে অন্যায়,কারির!?) এ কথা তিনি তার ১৭ বছর বয়সি সন্তানকে বলেছেন মাত্র কয়েক মাস আগে। গতকাল প্রতারিত হওয়া একজন নারী আমাকে বলেছেন, প্রতারকের বিষয়ে তিনি বলতে ভয় পেয়েছেন; কারন তাকে গনক নামের সে প্রতারক বলেছে; তার বিরোধীতা,করলে নাকি ছেলে ঢাকায়,থাকতে পারবে না। তার মেয়েরও ক্ষতি হবে। কারন সেই প্রতারক গনক তাকে নাকি বান মারবে! মরনের পরে নরকে পুড়ে মরবে যদি ধর্মীয় শিক্ষকে ধর্ষন করতে না দেয় অথবা তা প্রকাশ করে দেয় ! কি ভয়বহ অবস্থা! কুসংস্কার ও অবিশ্বাস জমজ ভাইয়ের মত। ২০১৯ সালেও অবিশ্বাস, কুসংস্কার যে ভাবে জেঁকে বসে আছে তাতে বুঝা যেচ্ছে এ জাতি বিজ্ঞান চেতনা থেকে যোজন যোজন দুরে।
ভবিষ্যৎ কি তা ভাবলে গা শিউরে উঠে। আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, ৯০ দশকে শাহবাগের আজিজ সুপরমার্কেটে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদে বসার চেয়ার তো দুরের কথা আমরা দাড়িয়ে থেকেও আলোচনা শোনার জায়গা,পেতাম না। এখন ঠিক উল্টোটা দেখলাম সে দিন, লোক পাওয়া যায় না বসার মত। ২৫ টি চেয়ারও শুন্য থাকে। আমি জানি না বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, বিজ্ঞান বক্তা আসিফের বক্তৃতা দেয়ার সময় কতজন লোক উপস্থিত থাকে! অথচ আজো বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ সাপে দুধ খায় বলে বিশ্বাস করে! সাপুড়ে, গণক, আংটি বিক্রেতারা কাছে হাজার হাজার মানুষ যায় অসুখ সাড়াতে, ভাগ্য বদলাতে। পীর -দরবেশের মাজার ও সাধু সন্ন্যাসীর আখড়ার কথা বাদই রাখলাম




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. খুব সুন্দর একটি লেখা দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ .

    ReplyDelete