fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা :                     
                        
 "কে করতো এই কাজগুলি?
এই যে এত লেখা, এত আঁকা কে করতো?"

- "কেন, এই ছাইপাশ না করলেই বা কী হতো? দুনিয়ায় কারুর কোনও একটি মহার্ঘ্য চুলও ছেঁড়া যেত না। 

'ওই তো চুলের একটু আহা অথবা উহু, এরজন্যই তো ফেসবুকে এত লিখে ফাটাস।' 
কিরে, আঁতে ঘা লাগলো নাকি? শিল্পীমানুষ বলে কথা। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিস নাতো? এখনই হয়ত বলবি- কথা তো না, যেন চরকিবাজি। অনবরত মাথায় পাক খেয়ে বেড়ায়। তা বাপু আমি তো বলবোই,
নিজের ঢাক নিজেই পেটাস। ওই শুধু একটু তারিফের আশায়। 
'দে বাবা এক লাইক দে দে। এক কমেন্ট দে মা, ভগবান তোর ভালো করবে।'

ওটা নিয়ে ভাবিস না, বুঝলি! ওটা আর কিছুই না, বুড়ো বয়সের ভীমরতি। আদিখলা হয়ে যায়। একটু প্রশংসা, একটু সহানুভূতি পাওয়ার জন্য এক্কেবারে হ্যাংলা হয়ে যায়। অনেকের হয়, কারুর-কারুর হয় না। তোর হয়েছে। কী আর করবি?
শরীর-মনের হাড়-হাভাতে দশা হলে এরকম ভিখারিপনা দেখা দেয়। আমার কথাটা হজম করা শক্ত। তবে পা দিয়ে সাপ পেষার মতো পিষে ফেলতেও পারবি না। তুই তো আবার অনেক কিছুই পারিস। বিষের দংশনে দেখ নীলকন্ঠ হতে পারিস কিনা!
নে এবার ঘুমো। অনেক রাত হলো।
নাকি চোখের ঘুম গেল উড়ে।
তা বাপু আমি আর পারছি না। চোখ জুড়ে আসছে। চললুম ঘুমোতে।

তুই আসলে নিজেকেই চিনিস না।
জানিস তো, সেদিন নরেনও নিজেকে চিনতে পারেনি বলে রক্ষা। দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর তো বলেই দিয়েছিলেন, নরেন যেদিন নিজেকে চিনতে পারবে সেদিন আর দেহ রাখবে না। তুই নিজেকে চিনতে পারলে কী করবি কে জানে?

দেখবি অনেকেই বলে, 'আমি ভাই স্পষ্ট কথার মানুষ।' আবার কেউ বলে, 'আমি ভাই সিম্পল। অত ভাবাভাবির মধ্যে নেই।'
'তোর পোষালে সম্পর্ক রাখ। নয়তো ঘুড্ডি ওরা। আমি সোজা কথার মানুষ।'
দেখ দেখি, এরা তো দিব্য নিজেদের চেনে। আবার বেশ বেঁচে-বর্তেও আছে। তোফা দিন কাটে। হাসে, মস্করা করে। সেজেগুজে সেলফিও পোস্ট করে। কেউ দেহ রাখে না!
এই এরাই আবার খোঁচা খেলে বলে, 'ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের কথা সবাইকে বলে বেড়াতে হবে নাকি?' 
ঠিকই তো! তোর কী মনে হয়, এরা ভেতরে এক বাইরে আরেক? মুখোশধারী জীব একেকজন? মুখোশটা সরলেই একেকটা আস্ত ঢ্যামনা। অন্যের রাতের ঘুম কেড়ে, নিজেরা কুন্ডলি মেরে ঘুমায়।

গানটা শুনেছিস?
'তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা ও মন জান না?'
                        
সেদিন ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখেছিলি? 
'বাহ রে ভাই, তুই তোর মতো গোছাতে চাইলে ভালো। আর আমি আমার মতো গোছাতে চাইলেই দোষ?' বেড়ে বলেছে কিন্তু। তা নিজেরটা কে না গোছায় বল?
হ্যাঁ, তুই তো আবার 'চোখে আঙুল দাদা। অন্যের ভুল খুঁজে বেড়াস। তুই বলতেই পারিস, তা বলে নিজেরটা গোছাতে চেয়ে অন্যেরটা তছনছ করে দিবি? 
এতসব বলাবলির কি আছে? তুইও নিজেরটা তোর মতো করে গুছিয়ে নে না বাপু, কে মানা করেছে?
ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজলেই আমার তো দিব্য ঘুম আসে। আর তুই এসব ভাবতে বসিস বলেই তোর ঘুম আসে না।

আরে বাবা এতে লোকঠকানোর কী আছে?
জানিস তো, ঠকার জ্বালা বিষের জ্বালার চেয়েও ভয়ঙ্কর। 
তুই তো আবার বিদ্বজ্জন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চোখের বালি'র সেই ডায়লগ নিশ্চয়ই ভুলিসনি? 'বিষ মনে প্রবেশ করিলে তা মৃত্যু আনে না- মৃত্যুযন্ত্রণা আনে।' প্রাণ কাড়ে না, তিলে-তিলে শেষ করে। তুসের আগুনের মতো। রাতের অন্ধকারে, অলস অবসরে দগ্ধে-দগ্ধে মারে। দিনে জাগতে পারবি না। আবার রাতেও ঘুমোতে পারবি না। ঠকলে ঘুম আসে না।

ভেবে দেখ তো, তুইও কাউকে ঠকাতে চেয়েছিলি কিনা? আর সেই ঠকাতে গিয়ে নিজেই ঠকে যাসনি তো?

আমার তো বাপু সব অঙ্ক কষা হয়ে গেছে। ঘুমিয়েই জীবনের অনেকটা সাবড়ে দিলাম। রাত এগারোটা থেকে সকাল ছটা। সাত ঘণ্টার টানা ঘুম। চব্বিশ ঘণ্টার প্রায় সাড়ে তিন ভাগ। ষাট বছরের কর্মজীবনে তেইশটা বছর সাবড়ে দিলাম ঘুমিয়েই। অজগরের ঘুমের মতো? রাত হলেই একটা শরীর গিলি। আর পেট ভরে গেলেই পড়ে ঘুমাই। তোর মতো ওসব মন-টন ভরানোর বালাই নেই।
ছুটিছাটার দিনেও তোফা কাটাই।
গাড়ি চড়ে শপিং করতে যাই। ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়া, রাত হলে দু-তিন পেগ মেরে দেওয়া। সবশেষে যৌনতার বিছানায় আত্মসমর্পণ। ছিঁড়ে সাপটে-সুপটে খায় আমায়। রতিক্লান্ত আমি। হাপড়ের মতো আমার ভারী নেতানো বুকের ওঠানামা দেখে ওর আবারও সুরসুরি হয়। সাপের মতো জাপটে ধরে পিষে ফেলতে থাকে আমার শরীরের ভেতরটা। সে কী ফোঁসফোঁসানি! ছোবলের পর ছোবল। ছলকে বেরোয় তাজা রক্ত। আঁসটে গন্ধ আর রক্তময় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শরীরটা একসময় নিস্পন্দ হয়ে আসে। 
তা বাপু, এটুকু তো সহ্য করতেই হবে। এতো আরামের জীবন কাটাচ্ছি।

তবে মেজাজ আমারও খারাপ হয়। কখন জানিস?
যখন সাতসকালে আমার ঘুম ভাঙিয়ে চা করতে পাঠায়। চা খেতে-খেতে বলে, 'তোমার সঙ্গে আর শোয়া যাবে না। গরুর মতো নাক ডাকো আজকাল।'

কিন্তু কী করবো বল? 
আমার রাতবাসরে ওই পশুর মতো যৌনতা চাই, বুঝলি? ওরজন্য আমি নিজেকেও ঠকাতে রাজি। দুনিয়া তো কোন ছাড়!
কখনও জেনে ঠকিয়েছি, কখনও নিজের অজান্তেই।

আমি জানি তো, যে ঠকেছে সে তোর মতো রাত জাগছে। তার চোখের পাতা চট করে ভারী হয়ে আসে না। তার যত না শরীরের কথা, তারচেয়ে অনেক বেশি মনের কথা। রাতের গাঢ় অন্ধকারে সব গলগল করে বেরিয়ে আসে লাভাস্রোতের মতো। নিজেকে পোড়ায় অন্যের গায়েও ফোসকা ধরায়। তবু তোর কলম থামে না, প্যালেটের রংয়ে টান পড়ে না। 

জীবন তোকে ঠকায় নি। 
জাগিয়ে রেখেছে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। তোর কোনও এক লেখা পড়ে, এক সুন্দরী ভক্ত যখন হইহই করে ওঠে, তখন তুই আমার বুকে মুখ গোঁজার আনন্দ পাস। আবার যখন কোনও ঝিংকু মাল বলে, 'বস এতো আমার কথা। তুমি জানলে কী করে?' আমার সঙ্গে যৌনতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলিস। ছবি দেখে একটু-আধটু তারিফ করলেই গলে জল। রতিক্লান্ত তুইও। 

তোর আমার পার্থক্য অল্পই। তোর বাস কল্পলোকে। আর আমার গোটাটাই বাস্তবে। তোর সুখ মনে। আমার সুখ শরীরে।

সবার মধ্যে তুই। সবাই তোর মধ্যে। অনেক কাজ তোর, জানি। কাজ কখনও ঠকায় নারে। পরিচিতও ঠকায় না। ঠকায় ভালোবাসার মানুষ।

কী আর করবি বল! 
এবার দেখ তুইও যদি ঘুমিয়ে পড়তে পারিস। চিরতরে। সে ঘুম যেন আর না ভাঙে। পারলে, আমিও তোর দু'চোখে খানিকটা ঘুম দিতুম। তোর সারা শরীর মন জুড়িয়ে যেত। 
আর একবার ভরসা করে দেখ আমায়। প্লিজ। আমি তোকে এক অনন্ত ঘুমের দেশে নিয়ে যাব।
তখন তুই না ঠকেও ঘুমাবি।"


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours