কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:
ফের সেই দৃশ্য।
ক্রিকেট
গ্রাউন্ডে টিম ইন্ডিয়া হারলো। আর একদল হইহই করে বাজি ফাটালো। আরেক দল
অপেক্ষা করছিলো ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই। তাদের কানে বাজির শব্দ পৌঁছতেই, রে
রে করে উঠলো। ক্রিকেটের মাঠ ছুঁয়ে, ফেসবুকে বান ডাকলো আধুনিক
সাম্প্রদায়িকতার।
- 'বেটাদের পাঠিয়ে দাও পাকিস্তানে। বড্ড বাড় বেড়েছে!'
আবার
শুরু হয়ে গেছে রাজনীতিও। টিম ইন্ডিয়ার পরাজয়ের পেছনে অন্য এক কারণ
আবিষ্কার করেছেন কিছু গবেষক। নীল ছেড়ে টিমের গায়ে গৈরিক জার্সি ওঠাতেই নাকি
বিপত্তি। নাক কাটা গেল টিমের।
বিশ্বকাপের
সেমি- ফাইনাল। টিম ইন্ডিয়া হারার পর, ঠিক ক'জনের কানে বাজি ফাটানোর আওয়াজ
পৌঁছেছিল? আর ঠিক ক'জনের চোখে পড়েছিল ফেসবুকের ওই আপডেট?
আমার মনে হয়, দ্বিতীয় দলের সংখ্যাটাই বেশি। কারণ শব্দবাজির আওয়াজের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপকতা ফেসবুক পোস্টের।
যার
সোজা মানে, প্রথম দলের বাজি ফাটিয়ে উল্লাস নির্দিষ্ট এক পরিধিতেই সীমাবদ্ধ
ছিলো। কিন্তু ফেসবুকপ্রেমীদের উৎসাহে, তাদের সেই বিচ্ছিরী অভিজ্ঞতাটা
ছড়িয়ে পড়লো সীমানা ডিঙিয়ে। বন্ধ ঘরে এসি'র হাওয়া খেতে-খেতে, গরমাগরম বুলি
ঝেড়ে তাঁরা চাইলেন বিপুল সংখ্যক মানুষকে গরম করে মজা দেখতে। হয়তবা নিজেদের
অজান্তেই সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর চটি পায়ে গলালেন তাঁরা।
বাজি ফাটিয়ে একদল চেষ্টা করেছিলেন ভারত বিদ্বেষ ছড়াতে। আরেকদল ফেসবুকে গলা ফাঁটিয়ে একই কাজ করলেন, জবাবী সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে।
যারা
ফেসবুকে গলাবাজি করলেন, তারা অবশ্য সাম্প্রদায়িকতার বিজ ছড়ানোর অভিযোগ
মানবেন না। প্রতিবাদী বলবেন নিজেদের। নিজেদের সাব্যস্ত করবেন চরম
ভারতপ্রেমী বলে। মুখর হবেন নিজেদের জাতীয়তাবাদের তীব্রতা প্রমাণ করতে।
তা
বেশ, ধরেই নিলাম টিম ইন্ডিয়ার পরাজয়ে যারা উল্লাস করে, তারা
রাষ্ট্রবিরোধী জনগোষ্ঠি। তারা গোটা দেশটাকেই দেখে ধর্মের চশমা পড়ে। তাই
আপনিও প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু আপনার চোখের চশমার রংটাই বা কী? সাদা নয়,
এটা হলপ করে বলাই যায়।
টিম ইন্ডিয়ার পরাজয়ে যারা বাজি ফাটায়, তাদের ভারতীয় জাতীয়তাবোধ নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলা যায়।
কিন্তু
সোশ্যাল মেডিয়ায় আপনার প্রতিবাদও তো সেই একই ধারায় বইলো! সাম্প্রদায়িকতার
কাঁধে চেপেই আপনি আরেক সাম্প্রদায়িক বিরোধিতার প্রচার করে ফেললেন।
দুটোই রাষ্ট্রবিরোধী। এবং দুটোই সর্বনাশা।
বরং ফেসবুকপ্রেমীরা আরও কয়েকটা অতিরিক্ত রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে ফেললেন, নিজেদের দেশভক্তি আবেগের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়ে।
ভেঙে
ফেললেন দেশের সাইবার আইন। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন ভারতের সংবিধানসম্মত
ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ। আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছেন, আপনার নিজের
সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠিকেও। যাঁরা আপনার বাণীতে উদ্দিপীত হয়ে আপনার মতো
ফেসবুকে না, সরাসরি ময়দানে নেমে প্রতিবাদ করতে আগ্রহী হবেন।
ফেসবুকপ্রেমীদের
উদ্দেশ্যটাও কিন্তু খুব পরিষ্কার না। সত্যিই কী চান আপনারা? আপনার
জাতীয়তাবাদ বোধকে নাহয় একেবারে নির্জলা খাঁটি বলে ধরেই নিলাম। তাহলে দেশের
আইন কানুনের ওপরেও আপনাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা।
কই
কিছুই মানলেন নাতো? প্রতিবাদ করারও তো আইন নির্দিষ্ট, কিছু রাস্তা আছে।
বলতে পারেন সেগুলো ঝামেলার। ওসবে কোনও কাজ হয় না। আপনার একথাগুলো অস্বীকার
করারও কোনও যুক্তি নেই। তবু আপনি কিছু করতে চান। টিম ইন্ডিয়ার পরাজয়ে কারুর
উল্লাস বরদাস্ত করতে আপনি রাজি না। সুতরাং অপশন হিসেবে আপনি বেছে নিয়েছেন
সহজলভ্য সোশ্যাল মেডিয়াকে।
তাহলে
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, ফেসবুকের হাত ধরে আপনারা কি নিজেরাই কোনও গ্যাং
তৈরি করতে চাইছেন? লাইক, কমেন্টস দেখে তো সেরকমটাই মনে হয়। আর মহিলার পোস্ট
হলে তো কথাই নেই। পুরুষের পক্ষপাত সাধারণত থাকেই। তাঁরাও বেশ ঢাকের সঙ্গে
কাসরঘণ্টার মতো বেজে চলেন। কিন্তু তাঁরা প্রস্তাবে সম্মতি দেন একটাই কারণে।
পোস্টের মালিক, সেই মহিলার টানে। কোনও জাতীয়তাবোধের টানে না।
কিন্তু মুশকিল দেখা দিতে পারতো অন্য জায়গায়।
সোশ্যাল
মেডিয়ার ব্যাপক ক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে বারবার। কয়েক পলকে আপনার উসকানি
বাস্তবেই পারে বাজারগরম করে দিতে। আর সত্যিই যদি তাই হতো, তাহলে দাঙা
বাঁধতো। বুক বাজিয়ে সেই দাঙার দায় নিতে এগিয়ে আসার হিম্মত রাখেন তো?
না রাখেন না। আপনার এ পর্যন্ত জীবদ্দশায় কি সেরকম কোনও একটি প্রমাণ হাজির করতে পেরেছেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন তো।
আর
ভারতের জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদের বোধকে টিম ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে
দিচ্ছেনটা কেন? আবার একদল রাজনীতির মেধাবান গবেষকদের দেখা গেল ময়দানে। টিম
ইন্ডিয়ার পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁরা জানিয়ে দিলেন- জার্সির
রংবদলই কাল হলো। নীল জার্সি ছেড়ে টিমের গায়ে গৈরিক জার্সি ওঠাতেই টিম
ইন্ডিয়ায় রাহুর গ্রাস হয়েছে।
টিম
ইন্ডিয়ার জিতে উল্লাস, পরাজয়ে হতাশাই কি দেশভক্তির নমুনা নাকি? নাকি
ছিদ্র অন্বেষণ করে বাজারগরম করা? ঠিক যেরকমটা করে ওই বাজি ফাটানেওয়ালারা।
ঢিলের বদলে পাটকেলের সূত্র শিরোধার্য করে আপনারাও সেই পথে হাঁটতে চাইছেন?
না, ভুল বললাম। ফেসবুকের প্রতিবাদীরা চাইছেন, তাঁদের হয়ে অন্যরা পাটকেলটা
ছুঁড়ে দিক। তাঁরা বলেই খালাস। তাহলে কি ধরে নেব, আপনারা দুজনেই এক শ্রেনীর?
ধর্মীয় মৌলবাদেই ভরসা আপনাদের।
এমনিতেই
গোটা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও ধর্মীয় মৌলবাদ সক্রিয়। এর মোকাবিলা করা কোনও
রাষ্ট্রশক্তির কাছে খুব সহজ কাজ নয়। ক্রিকেট দেখে আপনাদের উপচে পড়া
দেশপ্রেম, যেন কোনও সর্বনাশা ইঙ্গিত না দেয়। তাহলে সে দায় কিন্তু পোয়াতে
হবে আপনার প্রিয় রাষ্ট্রকেই।
মনে
রাখবেন, আমাদের রাষ্ট্রের মূল কথাটি আজ- সব কা সাথ। সব কা বিকাশ। সব কা
বিশওয়াস। সবের মধ্যে সেই জনগোষ্ঠিও আছে, যারা পাকিস্তানের ট্রেন মিস করেছিল
বলে আপনি আজ হা হুতাশ করছেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours