রণজিৎ গুহ, সমাজকর্মী ও লেখক:
অদ্বৈত মল্লবর্মন এর তিতাস কিংবা নলিনী বেরার শবর চরিত অথবা সেলিনা হোসেনের নীল ময়ুরের
যৌবন গ্রন্থগুলির পাশে রাখতে চাই মণিশঙ্করের কালু ডোমের উপাখ্যান কে।বিন্যাস আলাদা।
ন্যারেটিভ আলাদা। সময় প্রবাহের ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটও আলাদা। তথাপি প্রান্তজনের যাপনের
আন্তরিক বিবরণে সবকটি গ্রন্থই প্রশ্নহীনভাবে সমগোত্রীয় ।
কালুডোমের উপাখ্যান পাঠক হিসাবে আমাকে খানিক বেকুবও করেছে। বা বলা যায় ভেবেছিলাম এক
পেলাম আরেক। মণিশঙ্কর তার উপাখ্যানে দুটি পরিচ্ছদ নামাঙ্কিত করেছে মা। পাঠশেষে মনে হয়
বইটার নাম মায়েদের উপাখ্যান রাখলে কিছু অনুপযুক্ত হতো না।সনাতন মাতৃ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি
কমলি, বাসী, লক্ষ্মী এবং বিন্দি সব চরিত্রেই প্রতিভাত।সমাজচিত্রে সর্বদাই মা আবশ্যিক ভাবে
প্রধান চরিত্র। সে পশ্চাদপট আধুনিক নগর জীবন হোক বা প্রাকৃত ডোমসমাজ।মণিশঙ্কর মায়েদের
সন্তান আকাংখার অনিবার্যতার সাথে নিপুণ ভাবে জুড়ে দিয়েছেন নারীর স্নেহ, প্রেম ও শরীর
চাহিদাকে।সেকারণেই ঊর্মীও উপাখ্যানের মাতৃ বলয়ের অন্যতমা হয়ে ওঠে।ব্যাক্তি বা সমাজ
যাইহোক না কেন মা এক অনাবিল সর্বাঙ্গীণ আশ্রয়।
মণিশঙ্কর নিপুণ দক্ষতায় ডোম জীবনের ছবি এঁকেছেন। ডোম পরিবারের কথোপকথনে কয়েকটি
শব্দের বুঝি বেশী ব্যাবহার হয়।হতেই পারে।কিন্তু দম্পতির খুনসুটি বা পড়শীর ঈর্ষা কিংবা সামগ্রিক
অসহায়তা সবই লেখক আঞ্চলিক ভাষায় চমৎকার ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন।লেখকের মুন্সিয়ানায় এই
আঞ্চলিক ভাষার সাথে অনতিবিলম্বে পরিচিত ও একাত্ম হয়ে যাই। স্বজাতে প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্বর
কল্পকথা লেখক আগেভাগে জানিয়ে মুল উপাখ্যানের দরজা খুলে দেন পাঠকের কাছে। ফলে ডোম
দাওয়ায় মোড়ায় পঁদ পেতে বসতে অস্বস্তি হয়না।
মণিশঙ্কর এর উপাখ্যানে মধু ডাক্তার চরিত্রটি সময় প্রবাহের সুত্রধর।গ্রামীণ সমাজের
অবশ্যম্ভাবী এবং আবশ্যিক পরিবর্তন বা পরিনতির বিবরণ বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে নৈর্ব্যক্তিক
ভাবে জানিয়েছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। অদ্বৈতর মালো জীবন কথা যেমনটা এগিয়ে যায়
সাবলীলভাবে।অথচ প্রান্ত জীবনের প্রতি চুড়ান্ত সংবেদ নিয়েও মহাশ্বেতা দেবী তার লেখায়
বহিরাগতের ছাপ কাটাতে পারেননি। মণিশঙ্কর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ডোম সমাজের ভাঙ্গনের
কারণ নিজস্ব ভাবনায় পূর্বনির্ধারিত করে নেওয়ায় গবেষক দোষে খানিকটা দুষ্ট হয়ে পড়েছেন।
ফলে
তত্ব তুলে ধরার লোভ টুকু সামলাতে পারেননা।বিবরণের পরেও মধুডাক্তার ব্যাখ্যা ও নীতিকথা
উগরান।মানুষের সীমাহীন লোভপাঠক ঘটনার প্রেক্ষিতে ঠাউর পাবে না?কালু ডোম তার অভিজ্ঞতায়
যে উপলব্ধি জানান দেয় লেখক তাতে নিজেই সন্তুষ্ট নন। নিজমুখে আরও কিছু জুড়ে দেন।
সমাজতাত্ত্বিকরা একারণেই বৈজ্ঞানিক হিসাবে বিবেচিত হন না। গার্জেন হওয়ার এই ক্ষনিক সাধ
এ প্রজন্মের এক অতি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসকে সামান্য দুর্বল করে।
মণিশঙ্করের উপাখ্যান পড়তে পড়তে বারংবার তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলোর কথা মনে পড়ে। তুসু,
ঝুমুর ও অন্য পালার গানগুলো এই উপাখ্যানের অন্যতম সম্পদ।এই উপাখ্যানের আগাগোড়া সুরে সুরে
সুখদুঃখের প্রাকৃত উচ্চারণ।ওরে নিঠুর বিধি একটি বাছা দে' মাতৃ আকুতি আবহ যেন বাজতেই
থাকে।সাথে সাথে ডোম জনজাতির বিয়ের গান, সত্যনারায়ণ পালার গান, মেলায় ছেলেমেয়েদের
প্রেমপিরিতির গান বা শ্মশান ডোমের না সাধা গলার বাধ্যকতার গান।এগুলো লেখকের কষ্ট সাধ্য
সংগ্রহ না নিজস্ব রচনা তা জানিনা।যাই হোক না কেন এই গানগুলো অবশ্যই যত্নের সংরক্ষণ
প্রয়োজন।
মণিশঙ্করের উপন্যাসের মূল চরিত্র কোনটি? কল্পকথার কালুবীর না বিষাণের ব্যাটা কালু
বাদ্যকর? কিন্তু কাহিনী তো ধরে রাখছে ঐ মায়েরাই। সময়ই যদি একাধারে এ উপাখ্যানের নায়ক ও
ভিলেন তবে মধুডাক্তার নিছক সুত্রধর নয়। কালের সাক্ষী। সমাজ নিজেই কি কেন্দ্র চরিত্র?
লেখক সমাজ ও পরম্পরায় তফাৎ রাখতে চাননি।প্রশ্ন থেকেই যায় আরণ্যক সমাজ জীবন থেকে
গ্রামীণ সমাজে পৌঁছানো কি অগ্রগতি নয়? প্রযুক্তি বাস্তবতায় পরবর্তী ধাপে এগোতে পিছুটান
কেন? সামনের পথ সবটাই আবিল?
এসব প্রশ্ন অবশ্য খানিকটা অর্বাচীনও বটে।অস্তাদ পঞ্চ বিষাণ, সুর বিলাসী কালুডোম বা চটকদার
জীবনে আগ্রহী হৃদয় পরম্পরার নিশ্চিত পথ ফলক।তিনজনই অভ্যস্ত যাপনের বাইরে ছিটকে যাওয়ার
ছটফটানিতে দুকুল হারায়। আবার বিন্দি ভৈরবী সব হারিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তোলে নিজেকে।
পরম্পরাকে ভেংচি কাটে।এ উপন্যাসের লেখক কেন জানিনা দুরন্ত গতির নাগরদোলাকে গন্তব্য
নির্দিষ্ট করে দেন মধুডাক্তারকে দিয়ে।অথচ উপাখ্যানের সবকটি মূখ্য চরিত্র তো আপন আপন বেগে
গন্তব্যহীন যাত্রায় ধাবমান। লেখকেরই সৃষ্ট এই চরিত্রগুলোইতো আমাদের উদ্দিপনা যোগায়।
মণিশঙ্করের ' কালুডোমের উপাখ্যান ' শুধু এক অঞ্চলের ডোম জীবনকথা নয়।এই উপন্যাস সব
অর্থেই আমাদের আভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের সুসংহত বিন্যাস। (আলোচিত পুস্তকের
লেখক—মণিশঙ্কর, প্রকাশক-কবিতা আশ্রম ট্রাস্ট, বনগাঁ উত্তর ২৪ পরগণা।)
মণিশঙ্করের কালুডোম এক নতুন অবগাহন আমাদের সমাজ , জনজীবন , প্রান্তিকজনের জীবন কথা ও নগরজীবনক দেওয়া একটি জরুরি বার্তা । রঞ্জিত গুহা সঙ্গতভাবেই উপন্যাসটির যুক্তিযুক্ত আলোচনা করেছেন । ঔপন্যাসিক ও আলোচক উভয়কেই ধন্যবাদ ।
ReplyDelete