saromeyo kahini
মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার, হুগলি: সেরেফ পিটিয়েই মেরে ফেলা যায় ওদের। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কলকাতার এক সরকারি হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যেই। রাতে নার্সিং ছাত্রীরা হোস্টেলে ফেরার সময় ওই ছানাগুলি নাকি কামড়াতে আসতো। সেই ভয়েই লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল ষোলটা কুকুরছানাকে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে- গিভ দ্য ডগ আ ব্যাড নেম। ব্যাস, তাহলেই হলো। এবার নেড়িদের যেমন খুশি তেমন মারো-এর ছাড়পত্র চলে এলো আপনার হাতে। কেউ বলে কামড়ানো স্বভাব। কেউ বলে পাগল কুত্তা। অতএব অত ভাবাভাবির কী আছে? পিটিয়ে মারো। তবে এই নেড়িরা কিছুতেই বনে-বাদাড়ে থাকতে পারে না। মানুষের গন্ধ তাদের চাই। একতরফা প্রেম। যদিও টেকে না। পরিণতিও মর্মান্তিক। তবু প্রেম তো প্রেমই। কে আর কবে, অত হিসাব-কিতাব করে প্রেম করেছে? মাঝেমধ্যে একটু আধটু হিংসে হয় বটে নেড়িদের। সেই আদিযুগ থেকে মনুষ্যসমাজে সহাবস্থান, আর হিংসেটুকুও শিখবে না? যখন দেখে আপনার পোষ্য হাই পেডিগ্রির বিদেশি ডগিকে নিয়ে বেরিয়েছেন হাওয়া খেতে, অথবা তার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে, মনের ভেতরটায় কেমন নাড়া খায় নেড়িরা। তখন হয়ত কোনও নেড়ি একটু খ্যাঁক-খ্যাঁক করে ওঠে। ব্যাস ওই পর্যন্তই। এর বেশি সাহস পায় না। এছাড়া চলনে-বলনে ওরা দার্শনিক। আপনাকে দেখলেই টিংটিংয়ে লেজ নেড়ে প্রেমিকসুলভ আনন্দ জাহির করা। কড়া রোদ, শীতের রাত, ভরা বর্ষাতেও ওদের কোনও আপত্তি নেই। আপনার শত হ্যাটাতেও ওরা নির্লিপ্ত। ওরা তো সেই রাস্তার নেড়ি। স্ট্রিট ডগ। কিন্তু হঠাত কোনও নেড়ি খিদের চোটে খেপে গিয়ে আপনার পায়ে কামড় বসিয়ে চলে গেছে এমনটা মোটেই নয়। বরং উল্টোটাই। সাত চড়েও রা নেই ওদের। দুষ্টু ছেলেদের ইটের ঘায়ে মরতে বসেছিল মাস পাঁচেকের এক কুকুরশাবক। কপাল ভালো ছানার। কলকাতা পুলিশের নজরে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সেই নেড়ির বাচ্চা। খেতে পাক না পাক, এই নেড়িরাই কিন্তু পাড়ার মাগনার রাত পাহারাদার। ওদের বীরবিক্রমেই কোনও কোনও দিন কেঁপে ওঠে পাড়া। রাত বিরেতে বেপাড়ার লোক পাড়াতে ঢুকলেই হলো। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলবে ওই নেড়িরাই। বারান্দায় কোনও কাপড়-চোপড় মেলা নেই তো? জানতে চান গিন্নীর কাছে। গিন্নী পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- গলির দরজাটায় তালা লাগাতে ভোলোনি তো? নেড়িদের চিৎকারে গোটা পাড়া তখন সতর্ক। একদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে বেরোতেই চোখে পড়ে, রাতের পাহারাদার এক নেড়ি। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুখ দিয়ে গলগল করে উগড়ে দিচ্ছে ফেনা। নিষ্প্রভ করুণ চোখ আপনাকে দেখছে। নেড়ি ধীরে ধীরে লাশ হয়ে যাচ্ছে। উৎসাহী দর্শকদের কেউ একজন বিশেষজ্ঞর রায় দিয়ে যায়- বিষ খেয়েছে। খেয়েছে নাকি খাওয়ানো হয়েছে? পাড়ার বাইকগুলি এমনিতে ওদের থোড়াই কেয়ার করে। তবে নেড়িরাও বাবুদের কায়দা কানুন ধরে ফেলেছে। জানে কিভাবে ভদ্রজনের হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হয়। তবু কখনও ভুল করে বসে। কাঁটাতার গলে বাবুর বাগানে ঢুকে পড়ে। পেছনের নালাতে যদি কিছু ভাত-টাত ভেসে আসে। ম্যাডাম দেখতে পেয়েই কিচেনের জানলা থেকে হাঁকডাক জুড়ে দেন। বাড়ির কাজের মেয়ে তেড়ে যায় হাতের ঝাঁটা উঠিয়ে। সাঁড়াশি আক্রমণে ভয়ের চোটে নেড়ি ঝড়ের বেগে একলাফে ডিঙোতে যায় কাঁটাতারের বেড়া। ব্যাস, পটাস করে নেড়ির ডান বা বাঁ চোখে বিঁধে যায় ছুঁচলো লোহার কাঁটা। সেই থেকে পাড়ায় এক নাম পেয়ে যায় নেড়ি- কানাকুত্তা। পাড়ায় যেকটা নেড়ির এক স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, আছে নাম, তার পেছনে এমনই এক নিষ্ঠুর ইতিহাসও জুড়ে আছে। আবার কিছু ক্ষেত্রবিশেষে নেড়িরা নিজের চেষ্টাতেই পাড়ায় নাম পেয়ে যায়। রোগে ভুগে গায়ের সব লোম ঝরে গেলে, তেলেভাজা। শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে ঘেয়ো। সব নেড়িরা তো আর সমান মেধাবী না। তাই কখনও কোনটা একটু বেখেয়াল হলেই পায়ের ওপর দিয়ে বাইক ছুটে চলে যায়। তখন সেটার নাম হয় ল্যাংড়া। আর এসবের কিছুই না হলে ওদের গণপরিচয় ওই একটাই- কমন অ্যান্ড সিম্পল। রাস্তার কুকুর।
খেঁকি কুত্তা। স্ট্রিট ডগ। সব নেড়িরা তো আর আশার মতো ভাগ্য করে জন্মায় না।আপনারা চিৎকার করে দাম্পত্যকলহ করুন বা পাড়া প্রতিবেশীদের ঝামেলা করে পাড়া মাথায় করুন দোষ নেই।ওদের গলার আওয়াজে আপনার ঘুম আসে না। মাস পাঁচেকের এক পুঁচকি কুকুরছানা ধুঁকছিল কলকাতার এক রাস্তায়। দুষ্টু মানবশাবকদের ইটের ঘায়ে বিশ্রীরকমের জখম। কোনও এক সহৃদয় কলকাতা পুলিশ কুকুরছানাকে বাঁচায়। এরপর হাতঘুরে তা চলে যায় ব্যারাকপুর ডগ স্কোয়াডের ডেপুটি পুলিশ সুপার সজল কুমার মন্ডলের আশ্রয়ে। তিনি ঠিক করেন ওই কুকুরছানাকে পুষবেন। আদর করে নাম দেন আশা। কিছুদিনের মধ্যেই আশা ছটফটে হয়ে ওঠে। সজলবাবু খেয়াল করেন, আশার ঘ্রানশক্তি বেশ তীব্র। স্কোয়াডের ল্যাব্রেডর, জার্মান শেপার্ডের সঙ্গেই ট্রেনিং শুরু হয় তার। প্রথম দিকে আশা অল্পতেই ভয় পেত, বলেন সজলবাবু।ও জীবনের প্রথম পাঁচ-ছ মাসের অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারছিলো না। কিন্তু হ্যান্ডলার সত্যেন্দ্রনাথ দে অল্প সময়ের মধ্যেই ওর ভয় কাটিয়ে দেন। এবার কামাল দেখায় আশা। বরং কিছু জায়গায় ও টেক্কা দেয় ওর কুলীন সতীর্থদের। অন্যরা তিন ফুটের বেশি উঁচু লাফাতে পারতো না। আশা লাফাত তার দ্বিগুণ। ঠিক মতো খেতে-পড়তে পেলে নেড়িরাও যে অভিজাত, বিদেশী সারমেয়দের পাল্লা দিতে পারে তার প্রমাণ অজ্ঞাত কুলশীল স্ট্রিট ডগ আশা। নেহাতই সখের বশে পড়ার বাচ্চারা যেমন কুকুরকে ঢিল মারে, বড়রাও তেমনি নেড়িদের শিক্ষা দিতে বেশ কিছু বিধানব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এরমধ্যে জনপ্রিয়, নেড়ির গায়ে ভাতের গরমা-গরম ফেন ঢেলে দেওয়া। বহুদিনের পুরনো রেওয়াজ। আর আছে চরম দন্ডবিধানের ব্যবস্থাও। মৃত্যুদন্ড। বিষ খাইয়ে। আবার প্রকাশ্যেই পিটিয়ে মারাও চলে। তবে সেক্ষেত্রে ওই কুকুরটিকে একটা ব্যাড নেম দেওয়ার প্রথা আছে এলাকার গণআদালতে। ওই নেড়ি নাকি মানুষ দেখলেই খ্যাঁক-খ্যাঁক করে তেড়ে আসে। পাড়ার অমুক বাবুর গিন্নী শাড়ি থাকায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। আর তমুক বাবুর ছেলের কপাল খারাপ। তার তো পায়েই কামড় বসিয়েছে। গোটা পাড়া কেন, মহল্লায় চিরুনি তল্লাশি চালান। সিবিআই করুন। তদন্ত চালিয়েও ওই অমুক বাবুর গিন্নী আর তমুক বাবুর ছেলের হদিশ পাবেন না। ঠিক এই কান্ডটাই সেদিন দেখা গেছিলো নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল ক্যাম্পাসের ভেতর। ডিউটি সেরে রাতে ফেরার সময় ওই ছোট্ট কুকুরছানাগুলি নাকি কামড়াতে আসতো। তাই ষোলটা ছানাকে লোহার রড দিয়ে সেরেফ মাথা, পেট ফাটিয়ে মেরে ফেলেছিল দুই ট্রেনি নার্স। তাও দুপুর পোনে বারোটা নাগাদ, খোলাখুলি দিনের আলোয়। কেউ ওই দুই খুনী নার্সদের হাত থেকে লোহার রড কেড়ে নিতে এগোয়নি। পাড়ার ছবিটা খানিক আলাদা। সেখানে উৎসাহী জনগণের অভাব নেই। রাস্তার ওপর নেড়ির লাশ হয়ে যাওয়ার খুল্লম- খুল্লা দৃশ্য দেখে অনেকেই অনুপ্রেরণা পেলেন। ছুটে গেলেন বাড়িতে। নিয়ে এলেন ছোট এক বালতি জল। তারপর হাত তিনেক ওপর থেকে নেড়ির গায়-মাথায় ছরছর করে ঢেলে দেওয়া হলো সেই জল। খালি বালতি নিয়ে ঘরে ফেরার আগে বলে যান- বিষের জ্বালা তো, একটু জুড়োবে। দুচাকা, চারচাকা সে মুহূর্তে ভীষন সাবধানি। জ্যান্ত নেড়ির ঠ্যাং পিষে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু মৃত নেড়িকে ছোঁয়াও চলবে না। নেড়ির মৃত্যুর তামাশা দেখতে আসা ভদ্রজনের ভিড় একসময় পাতলা হয়ে আসে। তখন নেড়ি একটা লাশ। এবার একজন দুজন নেড়ি আসে। সঙ্গীর গায়ের গন্ধ নেয়। মুখের কাছে মুখ ঠেকিয়ে হয়ত বিদায় সম্ভাষণ জানায়। নেড়িটারও প্রেমিক ছিল। যৌনসঙ্গী ছিল। তবে ভদ্রজনের খোকাখুকুরা দিনে-দুপুরে বাবুঘাট, ভিক্টোরিয়ায় খোলাখুলি প্রেম, যৌনকর্মের প্রদর্শন করতে পারলেও, নেড়িদের তা মানা। ওদের রোমান্স করতে দেখলেই চটে যান বাবুরা। অসভ্য, ইতর! শুধু বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনো! এমনকি নেড়িদের পেটাতেও কসুর করেন না। আবার কুলীন, অভিজাত বংশের ডগিদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে অন্য ট্র্যাজেডি। সন্তান স্কুল চলে যায়। বাবু আপিসে। তারপর থেকে আর সময় কাটে না বিবির। একখানা ডগি চাই, বিবির আবদার ফেলতে পারলেন না বাবু। সবসময় বেশ বিবির পায়ে-পায়ে ঘুরবে। মনিববাড়ির খুব সেবা-যত্ন খেয়ে সন্তান স্নেহে বেড়ে উঠলো আদরের ডগি। এরপর একদিন আপিস নোটিশ ধরালো বাবুর বদলির- দিল্লি থেকে হিল্লি। যাওয়ার আগে ডগিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে দিয়ে গেলেন বিবি। নে এবার চরে খা দেখি! সেই একতরফা প্রেমের নিষ্ঠুর পরিণতি। একজনের পৌষমাস। আরেকজনের সর্বনাশ! বাইরের অজানা দুনিয়ার পাঠ পড়ানো হয়নি ডগিকে। রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরতে থাকে সে। উচ্ছিষ্ট তার মুখে রোচে না। নালার দুর্গন্ধ জলে মুখ ঠেকিয়েও সরে আসে। ক্লান্ত ডগি বাজারে, ফুটপাথে এক টুকরো ছায়া পেলেই শরীর এলিয়ে দেয়। ব্যাস, অমনি তেড়ে যায় নেড়িরা। নিজেদেরই পেট চলে না, তার ওপর আরেকজন। অনুপ্রবেশ রুখতে হবেই। এমনিতেও চেহারায় চলন-বলনে ডগির সঙ্গে নিজেদের কোনও মিল খুঁজে পায় না নেড়িরা। অনেকটা যেন ভিনদেশের জঙ্গির মতো অবস্থা দাঁড়ায় বাড়িখেদানো ল্যাব্রেডর, স্পিৎজ বা ডোভারম্যানের। অসহায় ডগি। সেই সহৃদয় কলকাতা পুলিশের মতো কারুর চোখে পড়লো তো রক্ষা, নইলে শেষের দিন গোণা শুরু ডগির। নেড়িরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। দরকারও পড়ে না। জন্মের পরেই তারা পড়ে ফেলে তাদের ভাগ্যলিপি। রাস্তায় জন্ম রাস্তাতেই মরণ। মধ্যের জীবনটুকু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর মতো তাড়া খেয়ে বেরানো। নালার জলে পিপাসা মেটে। হোটেল, পাবলিক প্লেস, ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্টে ক্ষুন্নিবৃত্তি। রোগ হলে, অসুস্থ হলে রাম ভরোসা। পেট শুকিয়ে মরা। তবু এই নেড়িরাই মহাপ্রস্থানের দুর্গম পথে সঙ্গী হয় যুধিষ্ঠিরের। মাঝপথ থেকেই সারমেয়টি পিছু ধরেছিল পান্ডবশ্রেষ্ঠর। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে জাতবিচারে ওটি ছিল স্ট্রিট ডগ। কিন্তু নির্বিচারে এই নেড়ি নিধন যজ্ঞ চলতে থাকলে ভবিষ্যতের ছবিটা কী হবে? বিনি পয়সায় কোথায় পাওয়া যাবে এমন বিশ্বস্ত রাতপাহারাদার? আগামীর যুধিষ্ঠির কি তাহলে সঙ্গী ছাড়াই মহাপ্রস্থানের পথে এগিয়ে যাবেন? একা, একেবারে নিঃসঙ্গ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours