সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়, ফিচার লেখিকা , কলকাতা: কথা , শব্দ , বাক্য , ছন্দ - বাংলা ভাষায় এই বিশেষ শব্দগুলো যে মানে প্রকাশ করে হিন্দিতে , ইংরাজিতে বা অন্যান্য ভাষায় এই একই অর্থ অন্য শব্দের দ্বারা বোঝানো হয় । গ্রামার বা ব্যাকরণের এই সাধারণ বিষয়গুলো বোঝার জন্য আমাদের বিশেষ পড়াশুনো করতে হয় নি । খুব ছোটবেলাতেই এ ফর অ্যাপেল , অ্যাপেল মানে আপেল পড়তে গিয়ে এই ভাষাগত তারতম্যটা আমরা বুঝে ফেলেছিলাম । কিন্তু মনে করুন , কোনদিন কেউ আপনাকে এসে বলল যে ফলটিকে আপনারা আপেল বলে জেনে এসেছেন এতদিন , সেটির নামে একটি বড় ফোনের কোম্পানি রয়েছে এবং তাতে এই ফলেরই লোগো রয়েছে অতএব এই ফলটিকে অন্য কোন নামে ডাকতে হবে । অথবা প্রেমিককে আদুরে গলায় সেই চির পরিচিত তিনটি শব্দ বললেন আপন ভাষায় "তোমাকে আমি ভালোবাসি" , তক্ষুনি হইহই করে কিছু লোকজন এসে বলল , "একটু আগেই অমুক প্রেমিক তার প্রেয়সীকে একই কথা বলেছে , অতএব আপনারা নিশ্চয়ই ওই প্রেমিকের ভাবনা চুরি করেছেন , শব্দগুলো টুকেছেন । চলবে না এসব টোকাটুকি । নিজে ভালোবাসার শব্দ বানিয়ে তারপর বলুন ।"
কি , ভাবতেই মারাত্মক হাসি পাচ্ছে তো ?
মনে হচ্ছে তো এ আবার কেমন বোকা বোকা কথা ! আসলে ভাষাগত , জাতিগত অথবা যেকোন গোষ্ঠী তৈরীই হয় সাধারণ কিছু মিলের ওপর ভিত্তি করে । তাইতো বিদেশ বিভুঁইতে এক বাঙালী অপর এক বাঙালীকে খুঁজে পেলে আত্মহারা হয়ে যান ঠিক লালমোহন বাবুর মতোই । কবিরাও সেই চেনা পরিচিত ভীষণ আপন শব্দগুলোকেই নিজেদের দক্ষতায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসান , এবং তাতে আপন মনের মাধুরী মিলিয়ে ছন্দ দান করেন । এই পৃথিবীতে গদ্যের আগেও ছন্দের বা কবিতার জন্ম । এবং ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে একই শিরোনামে রবি ঠাকুর , শক্তি চট্টোপাধ্যায় অথবা আধুনিক কোন কবির কবিতা রয়েছে । আচ্ছা , তার মানে কি এই আধুনিক কবি রবি ঠাকুর বা শক্তিবাবুর ভাবনা চুরি করেছেন অথবা টুকেছেন ? তবে তো বলতে হয় রবিবাবুও প্রেমের ধারণা টুকেছিলেন বিদ্যাপতি , চন্ডীদাসের থেকে । আসলে এই ফোন ল্যাপটপ নির্ভর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সামনের মানুষের দিকে আঙুল তোলা এতটাই সহজ যে একটা আঙুল সামনে তুললে যে তিনটে আঙুল নিজের দিকেই নির্দেশ করে এই সহজ সত্যটা আমরা ভুলে যাই । তাই তো এই প্রজন্মের উদীয়মান কবিরা তাদের লেখার নিচে নামের বদলে সংগৃহীত লেখা থাকলে দুঃখ পান । তাদের অনুসরণ করেই যদি কেউ ছন্দ , অন্ত্যমিল ইত্যাদি গঠন করার চেষ্টা করেন , এই উদীয়মান কবিরা সেইসব চেষ্টাকে দাগিয়ে দেন ভাবনা চুরির দায়ে । আসলে নাম , স্বীকৃতির মোহ এই প্রজন্মের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এবং এই বিষয়টা ঠিক তেতো ওষুধের মতোই বড্ড কঠিন সত্য , যেটা গিলতে ভয় লাগে । রবীন্দ্রনাথ দেশের জন্য হাসতে হাসতে 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন , জীবনানন্দের গভীরতম জীবন বোধের কবিতাগুলি তাঁর ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া গেছিলো মৃত্যুর পর , শক্তি চট্টোপাধ্যায় আকন্ঠ পান করে দেখতে পেয়েছিলেন "অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে" ।
কোন সোশ্যাল ফলোয়ারের পিছু পিছু তাদের কোনদিন ছুটতে হয় নি স্বীকৃতির আশায় । শক্তি , সুনীলের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের লেখার স্টাইল আজও নকল করে নবীন কবি । একবার বুকে হাত রেখে বলুন তো ছন্দের ওপর অন্ত্যমিলের ওপর ট্যাক্স বসাতে চাওয়া নব্য সোশ্যাল মিডিয়া কবির দল , কখনও মনে হয় নি "ইশ যদি ওই জায়গাটায় আরেকটু শক্তির মতো লিখতে পারতাম"... বলি মশাই , এটাকে অনুপ্রেরণা বলে , ভাবনা চুরি নয় । ভাবুন , বুঝুন , আর কবি হতে চাইলে একটু নিরালা খুঁজুন , ফলোয়ার বা ভাবনা চোর খুঁজবেন পরেই নাহয়। পরিশেষে বলি ,
"ছন্দ আমার , ছন্দ সবার
ছন্দ কিনবে কবি ?
এই প্রকৃতির আপন ছন্দে
কবিতা লেখাই হবি"
দেখবেন , দয়া করে কেউ যেন আবার ছন্দ চোর বলে পুলিশ ডাকবেন না । প্রকৃতির ছন্দকে চুরি করার সাধ্য এই অধমের নেই ।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours