fiture
রুমকি রায় দত্ত, লেখিকা, হুগলি: হোয়াটসঅ্যাপে এক বান্ধবী তার খুব কাছের ক’জনকে নিয়ে একটা গ্রুপ খুলে ফেললেন। অনেকদিন সেই পুরোনো আড্ডা হয় না! সেই পুরোনো আড্ডা, যেটা কলেজের পিছনের বেঞ্চে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে হত অথবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ক্যান্টিনের পিছনের মাঠে। সবার ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে একটা কোলাজ ফটো দিয়ে ডি.পি সাজাল। প্রথমে একটা হাই, তারপর একটা চুমুর ছবি। ফ্রেন্ডস্‌ কতদিন আড্ডা হয় না বল, তাই এই গ্রুপটা ক্রিয়েট করলাম। একে একে বাকি ক’জনও ঝাপিয়ে পড়ল। সারাদিন আড্ডার জেরে কারও ভাত পুড়ে গেল, কেউ ছেলেকে স্কুল থেকে আনতেই ভুলে সময় পার করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটল। কারোর স্নান করতেই বেলা শেষ। সারাদিনে দু’হাজার মেসেজ। টানা সাতদিন ক্লান্তি, বিরামহীন। হঠাৎ একজন লেফ্‌ট করল। যাওরায় আগে লিখে গেল, ‘ কিছু মনে করিস না রে। এত মেসেজ যে ফোন ঝুলে যাচ্ছিল’। ফোন ঝুলে যেতে যেতে, গ্রুপটাই একদিন ঝুলে গেল অবশেষে।
আড্ডাটা ঠিক জমল না। অনেক কষ্টে কিছু বন্ধু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যদিও বা মিলল দীর্ঘদিন পর, তবু জমল কি আড্ডাটা? গ্রুপের সেই আন্তরিক বন্ধুটি সামনে এসে কেমন যেন চুপচাপ। কয়েকটা ঘণ্টা নিজেদের ব্যর্থতা লুকিয়ে, সাফল্যের মুখোশ পরে আড্ডার মাঠে নামলে, খাঁটি স্বাদটা তো মিশিং থাকবেই। ঠিক কতটা সময় নষ্ট হল, সে হিসাব খুঁজতে খুঁজতে সেলফি নিতে ভুললে চলবে না। হাসি হাসি মুখে সেলফি, জড়িয়ে ধরে সেলফি। ফেসবুকে পোস্ট না দিলে চলবে? পাড়ার মোড়ে ছেলে ছোকরাদের আড্ডায় অবশ্য খামতি নেই। বিকেল হতেই সবাই উপস্থিত। অনেক সাইকেল, অনেক মাথা, কিন্তু সবগুলো নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। হাতের আঙুল ব্যস্ত স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে। পাড়ার মোড়ে মা-কাকিমারা আর তেমন সময় পান না জমাটি আড্ডার। এখন তাঁদের আড্ডা চলে সেলিব্রিটিদের সাথে। সবাই যে ঘরে এসে আড্ডা দিয়ে যান। একে একে আসতেই থাকে জবা, কৃষ্ণকলি, বকুল। আহা! ঐ ত্রিকালদর্শী মেয়েটের কি কষ্ট! শুধু এই টুকু আলোচনা না করলে মনের শান্তি নেই, তাই সিরিয়াল শুরুর আগে একফাঁকে ছোট্ট একটা দু’মিনিটের আড্ডা এখনও নিঃশ্বাস নেয়। সেদিন, রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরছি কলকাতা থেকে। রাতের ট্রেনে লেডিসে? না না বাবা! পুরো ফাঁকা! তার থেকে সামনের জেনারেল কামরা অনেক সেফ। উঠে দেখলাম, আহা! কত মানুষ! একটা চলমান আড্ডা। রেল তো পাবলিকের নিজের সম্মত্তি। শুধু সীটের উপর কেন চাইলে সহযাত্রীর নাকের সামনে বা ঘারের উপরও পা তুলে দেওয়া যায়। আর এত বড় একটা ডাস্টবিন থাকতে নোংরা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা কেন বাপু? চলছে তুমুল আড্ডা, অফিস ফেরৎ পুরুষযাত্রীদের। তা আড্ডা দিচ্ছে দিক না, আমার তাতে কি? সমস্যা একটাই, নাকে কেমন ঝাঁঝালো গন্ধ ঠেকছে যেন! খাচ্ছে তো জল! ওই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জলের বোতল। কে জানত বলুন, যে জলের বোতলের ভিতরে আছে মাল। আড্ডার ভাষা আহা! মরি মরি। স্টেশনে ট্রেন থামতেই যেতে যেতে বলে যায়, ‘টা টা বাই বাই’। হাত নেড়ে অবশিষ্ট জন বলে, ‘তোর বাড়ির গাইটা বাপের বাড়ি থেকে ফিরলে জানাস।একদিন জমিয়ে আড্ডা দেব তোর বাড়ি। সত্যিই কি আর বাড়িতে বসে সেই আড্ডার দিন আছে? সেই নিখাদ আড্ডা। খোলা ময়দানে বসে অথবা সপ্তাহ শেষে বন্ধুর বাড়ি পাঁপড় ভাজার সাথে চায়ের আড্ডা। বাড়িতে বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন এমনকি শ্রাদ্ধ বাড়িও ক্ষনিকের জন্য শোক ভুলে যেতে পারত যে আড্ডার হাত ধরে, আজ সত্যিই কি সেই আড্ডার অভাব বোধ হয়?
‘‘সময় কোথায়, সময় নষ্ট করার?’’ তার চেয়ে এই ভালো। সোফায় বসে অথবা বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বৃহত্তর ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে ইচ্ছা মতো আড্ডা। মতের মিল না হলে ব্লকিয়ে দিলেই হল। বদলায় দিন, বদলায় মন আর আড্ডার বদল হবে না? আরে বাবা মানুষ বদলাতে বদলাতে যুগের বদল করে ফেলল আর আড্ডার বদল হবে না? হোক তবে বদল আমার তাতে কী? শুধু মাঝে মাঝে হ্যারিকেনের আলোয় সবাই মিলে বসে ভুতের গল্প শোনার দিনগুলোতে ফিরতে ইচ্ছা করে ভীষণ! ভীষণ ইচ্ছা করে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours