politics
শম্পা ঘোষ, সহকারী অধ্যাপিকা, হাওড়া: পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র আজ সংকটের সম্মুখীন। সংকট কেবলমাত্র একারণে নয় যে, ক্ষমতায় কোন বিশেষ এক রাজনৈতিক দল আসীন যারা সংখ্যাগরিষ্টের মধ্যে হিন্দুত্ব জিগির তুলেছেন বা সংখ্যালঘুর মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ সঞ্চার করেছেন, বরং সংকট একারণে যে গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য যে বিতর্কের আবহে বিচরণ করা সেই বিতর্কের পরিমণ্ডল ক্রমশঃ অন্তর্হিত। অনেকেই বলছেন ফ্যাসিবাদের পদধবনি শোনা যাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা অত সহজ নয়। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ হঠাৎ করে এসে পড়ে না , দীর্ঘ একটা হতাশার প্রক্রিয়া কাজ করে অনেক যুগ ধরে। এর উৎস খুঁজতে হলে স্বাধীনতাপর্বের দিকে আলোকপাত করতে হবে। দুশো বছর বিদেশী শাসনের পর একটা দেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল তার যে আশা-উত্তেজনা তা হতাশায় পর্যবেশিত হতে খুব বেশী সময় লাগেনি দারিদ্র ও অশিক্ষার আক্রমনে। স্বাধীনতার মূল কাণ্ডারী জাতীয় কংগ্রেস যখন দেশবিভাগ মেনেই নিয়েছিল তখনও একথা মনে রাখতে হবে যে সেটা কিন্তু কোন আগুনকে প্রশমিত করতে পারেনি বরং এক ছাইচাপা আগুন থেকেই গিয়েছিল। অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধীও ৪৬-এর দাঙ্গা দেখেছিলেন নির্বাক হয়ে। 
তার ইচ্ছার ওপর স্বাধীনতার গতিপ্রকৃতি নির্ভর করেনি। তার অনিচ্ছাতেও কংগ্রেস নেতৃত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে প্রত্যক্ষ করেছিল। সাম্প্রদায়িকতার বীভিৎস রুপ তার মৃত্যু দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমকালীন অনেকেই দেশভাগের মধ্যে একটা মুসলমান তোষন লক্ষ্য করেছিলেন, যা জাতীয় কংগ্রেসের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে। সদ্যজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার প্রত্যক্ষ করেও স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরনের নীতি ভারতরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারের কাজটিকে আরো জোরদার করেছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্তানের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গুলোর অন্দরে এই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনির্মানের বিষয়টি ছাইচাপা আগুনের মত ধিকিধিকি করে জ্বলেছিল। বারেবারেই এই আগুন তার জ্বলন্ত তার জ্বলন্ত রুপ দেখিয়েছিল, কখনো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধী হত্যার মধ্য দিয়ে, আবার কখনো কাশ্মীরে পণ্ডিত নিধন বা গুজরাট দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। আসলে ধর্মভিত্তিক এই দেশভাগের দায় কোনভাবে কংগ্রেসের গায়ে লেগে গিয়েছিল। তাই এই ‘অর্ধ-স্বাধীনতা’ নিয়ে যারা ঊচ্ছাসে ভেঙ্গে পড়েননি, তাদের হতাশা আসলে আরো একটা সংকটের ভিতকে মজবুত করেছিল আর সেই সংকটই হল ‘হিন্দুত্ব’। স্বাধীনোত্তর ভারতে আর এস এস- বিজেপি প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’-এর সাথে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিবেকানন্দ-বঙ্কিম-নবগোপাল মিত্র প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’এর একটা প্রভেদগত অমিল ছিল। উনিশ শতকের হিন্দুত্বের প্রণেতারা যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন সেখানে ‘হিন্দু’ বলতে তারা একটা জাতীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যার একটা ভৌগোলিক বিন্যাস কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সিন্ধু থেকে ব্রহ্মপুত্র (ভৌগলিক দিক থেকে বর্তমান পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ) অবধি কল্পনা করতেন। এই ‘হিন্দুত্ব’ অতীতের ঊজ্বল স্মৃতিকে তারা বর্তমানের ভারতরাষ্ট্র নির্মানের ধারণার সঙ্গে তারা মেশাতে চাইতেন। স্বাভাবিকভাবে সেই হিন্দু আদর্শের সাথে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নয়, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলেই অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছিল যারা জাতী হিসাবে ভারতীয় বলে গণ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বিংশ শতকের স্বাধীনোত্তর ভারতে ‘হিন্দুত্ব’-এর ধারণার সঙ্গে দেশভাগজনীত কারনে একটা মুসলমান-বিদ্বেষের বীজ থেকে গিয়েছিল। দেশভাগের প্রাক্কালে যে হিন্দু-মুসলমান বৈরীতা ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল, সেই দাঙ্গার ক্ষত স্বাধীন ভারতে মেরামত করা যায়নি, যার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি আমরা আজও। তাই কাশ্মীর সমস্যা সদ্য স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের দেহে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক ভেদরীতির মধ্যেও যে সহাবস্থানের উদাহরণ এই উপমহাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে তার একটা চ্যুতি ঘটতে শুরু করেছিল সদ্য স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কের মাধ্যমে। একবিংশ শতকে বিশ্বায়ন ও তার পরবর্তীকালে সামাজিক মাধ্যমের অগ্রগতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে একটি ছাতার তলায় এনে দেয়। বর্তমান বিশ্বে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে যখন মৌলবাদকে চিহ্নিত করা হয় ঠিক সেরকমই একটা সময়ে আমাদের দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসারে ভারতের অ-হিন্দু জনগোষ্টীর প্রতি এক ধরণের বিদ্বেষ মনোভাব তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। ফলতঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের মূল ভিত্তি বাক-স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান যে বিতর্ক সেই বিতর্ক ক্রমশ রাজনৈতিক দাঙ্গায় পরিণত হচ্ছে। বিরোধীতাকে দাগিয়ে দেওয়ার রাজনীতি এক ধরনের উগ্র মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপদজনক এক প্রবণতার সৃষ্টি করছে। সরকারের দায়-দায়ীত্বগুলি পালন না করার ব্যর্থতা চাপা পড়ে যাচ্ছে যুদ্ধের আশংকা বা ভীতির তলায়। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারনে বৃহৎ পূঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে। সব থেকে আশংকার জায়গা দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে। গোটা পৃথিবী জুড়ে ওষুধ নির্মানকারী কোম্পানীগুলি যেভাবে মানুষকে আরো বেশী করে ওষুধের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার নীতি
গ্রহণ করেছে তাদের কাছে ভারতের বাজার একটা উন্মুক্ত ক্ষেত্র। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যনীতিও সেই পূঁজিপতিবর্গেরই স্বার্থ রক্ষা করছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসরকারী পূঁজিকে স্বাগত জানানোর প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর করা হয়েছে। সারা দেশে সরকার পরিচালিত স্কুল্গুলির তুলনায় বেসরকারী স্কুল্গুলির অগ্রগতি সেই স্বাক্ষ্যই বহন করে। ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যারা দারিদ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের কাছে দুটি স্তম্ভ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটি ক্ষেত্রেই আঘাত দারিদ্রতা দূরীকরণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলির তুলনায় সবথেকে আশংকার ক্ষেত্রটি হল মুসলমান-বিদ্বেষজাত দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘পাকিস্তান’ নামক যুযুর ভয়ে সদা দেশবাসীকে সন্ত্রস্ত রাখা। যাবতীয় রাজনৈতিক বিরোধীতাকে পাকিস্তানপন্থী আখ্যা দেওয়া, যুক্তির ওপর গুরুত্ব না দেওয়া, বিতর্ককে এড়িয়ে চলার প্রবণতা যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায় তখন তা এক ধরণের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার জন্ম দেয়, যা গণতন্ত্রের অস্তিত্বের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক মন্দার বর্তমান প্রেক্ষিতে এই প্রবণতাটি ভারত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূলে আঘাত হানতে পারে। শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে তাই এই প্রবণতা রোধে সচেতন হতে হবে। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours