fiture
 অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা: মানবতার আয়ুধ দিয়েই মনে হয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সফলতম সংগ্রাম সম্ভব। যুগে যুগে সেটাই পরিলক্ষিত হয়। সর্বাত্মক শোষণের সহায়ক,মানবতাবিরোধী ও বিভেদকারী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ও নিষ্ঠুর দংশন থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে যে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোন বিকল্প নেই তা শুধু যে গণতন্ত্রবাদীরাই বা সাম্যবাদীরাই উপলব্ধি করেছিলেন তা নয়। যুগে যুগে রুমি,কবীর,রবীন্দ্রনাথের মতো অনেক ঈশ্বরবিশ্বাসী সুফী সাধক,দার্শনিক ও ভাববাদী কবিরাও তা বুঝেছিলেন। রুমি তাই মুক্তকন্ঠে তাঁর কবিতায় বলছেন ‘না খ্রিস্টান, ইহুদী— না মুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, সূফী— অথবা জেন কোন ধর্ম কিংবা সাংস্কৃতিক রীতি থেকে নয় আমি আসিনি প্রাচ্য থেকে, আসিনি পাশ্চাত্য থেকে।‘ একই মরমী ও সেকুলার ভাবনা আমরা পাই কবীরের দোঁহাতেওঃ ‘১. মসজিদে যদি থাকেন খোদা বাকী জগৎটা কার? মূর্তিতে যদি রামের আবাস, তবে বাহিরে কি আছে তার ? ২. পণ্ডিতে খোজে জ্ঞান পুঁথির পাতায়, ভালোবাসায় ভরা চোখ যার- জ্ঞান সেই পায়। 
৩. কামনা করো সবার আনন্দ বিধাতার কাছে বন্ধু হোক, শত্রু হোক কী বা যায় আসে। ৪. হতাশায় খোজে বিধাতা সবাই, বিধাতা হারায় হাসির অজানায়। মনে রেখ, আনন্দে স্রষ্টা যদি থাকে পাশে তবে দু:খ হারায় অজানাতে। ৫. কেন খোজ আমায় মন্দিরে মসজিদে, গীর্জায় আর বেদীতে? পাবেনা আমায় কীর্তনে, আজানে আর ভজনের সুরে, রয়েছি আমি তোমারই পাশে- তোমারই অন্তরে। কবির বলে ভক্ত- জানো কি তুমি? ঈশ্বর লুকানো তোমারই হৃদয়ে। ৬. সাধু ,দেখ এই জগতে সবাই কেমন পাগল পানা, সত্য বললে মারে ধরে মিথ্যে কথায় নেই মানা। ৭. মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনামা, দু’জন মরে লড়াই করে মর্ম কথা নেই জানা।‘ ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হল ধর্মনিরপেক্ষভাবে মানুষের কল্যাণ করার জন্যে ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু ভাবে চালিত করার জন্যে রাষ্ট্র থেকে ও যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকুক। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া বা ধর্মের নাক গলানো নৈব নৈব চ। এটাই সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। এটাকে বাদ দিলে যেটা পড়ে থাকে সেটা হল ঐ ক্ষতিকারক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। ঈশ্বরে বিশ্বাস এ দুটোর কোনটারই বিকল্প নয়। তৃতীয় অপশন নয়। ঈশ্বরবিশ্বাস বা ভগবতপ্রেম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। যেমন তা ছিল রুমি,কবীর,রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি মনীষীদের,যাঁরা ঈশ্বর বিশ্বাসী হলেও ছিলেন প্রকৃত অর্থে সেকুলার। তাই রবীন্দ্রনাথের এই মানবতাবাদী সেকুলার মানসিকতার প্রতিফলন দেখি তাঁর বিসর্জন নাটকে যার অন্তিমে রঘুপতি দেবীপ্রতিমাকে গোমতী নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উচ্চরবে ঘোষণা করে বলছে যে ‘’দেবী নাই’’। বলছে ‘’কোথাও সে ছিল না কখনও’’। কিংবা রক্তকরবী নাটকের প্রায় অন্তিমে রাজা স্বয়ং ধর্মীয় ধ্বজা ভেঙে ফেলছে। এ সবই ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার শোষণের সহায়ক রূপ রবীন্দ্রনাথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন ঐ রক্তকরবী নাটকের গোঁসাইয়ের চরিত্রের মাধ্যমে। 
যেখানে গোঁসাই স্পষ্টভাবেই বলছে ‘’ফৌজের চাপে অহংকারটার দমন হয়। তারপর আমাদের পালা’’। মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতেও এই সেকুলারিজমের উদাহরণ আছে। সুলতান রাজিয়ার মানসিকতায় ও কার্যকলাপে তাঁর সেকুলার চরিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। আলাউদ্দিন খিলজীতো রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে উলেমাদের হস্তক্ষেপ করতেই দিতেন না। নেতাজী ও নেহেরু ছিলেন সম্পূর্ণ সেকুলার। ইন্দিরা গান্ধীও। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours