khaoa daoa
মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার, হুগলি: রসের মন্বন্তর। বাস্তবের মারে দেওয়ালে পিঠ বাঙালির। যাবতীয় রস শুকিয়ে কাঠ। তবে রসের ভাঁড়ারে টান লাগেনি বাংলার রসগোল্লার। আবার অনুকরণপ্রিয় বাঙালি। মেরো মিষ্টির দিকে ঝুঁকেছে সে। খোয়া, বেসনের সম্ভার। মিষ্টত্ব আছে রস নেই। মিষ্টি খাও। রুমালে হাতমুখ মুছে নিলেই হলো। ঝকঝকে সব দোকান, আর তকতকে মিষ্টির বাহার। তবু বাঙালির রসগোল্লা আছে রসগোল্লাতেই। সঙ্গে তার দেড়শো বছরেরও বেশি ঐতিহ্য। আভিজাত্যও অটুট। আর সব মিষ্টির পসরা দুয়োরানি, সুয়োরানি। মহারানি সেই আদি অকৃত্রিম ছানার রসগোল্লাই। রসগোল্লা। রসালো বাঙালির রসের গোল্লা। ফর্সার ওপর বাঙালির দুর্বলতা। সেই কলোনিয়াল এফেক্ট। তাই বাংলার সেরা মিষ্টান্নটাও যে ফর্সা হবে, বলাই বাহুল্য। তুলতুলে, গড়পরতা বাঙালির মনের মতোই। বাঙালি চরিত্রের মতোই রসে হাবুডুবু রসগোল্লাও। এক কথায়, বাঙালি চরিত্রের মূর্ত প্রতীক রসগোল্লা। দেশভাগ হয়েছে। রসগোল্লার ভাগ হয়নি। মধ্যে অবশ্য ওড়িশা ভাগ বসাতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ হাসি হেসেছে বাঙালিই। বাঙালির শুভ বার্তা বয়ে আনে, ছানার রসগোল্লা। শুভক্ষণে মিষ্টিমুখ মানেই ছানার রসগোল্লা।
সাইজে রাজকীয়, আর পেটের ভেতর যৎসামান্য ক্ষীর হলেই নামবদলে রাজভোগ। রসিকজনেরা আবার গরমাগরম রসগোল্লার মতো উপাদেয় আর কিছুই দেখেন না। আবার পেটরোগা বাঙালির পেটের অসুখের দাওয়াইও এই রসগোল্লা। পেট গড়বড় করলেই পেটে চালান করে দিন খানকয়েক গরম রসগোল্লা। পেটবাবাজি যাবেন শান্ত হয়ে। যত খুশি খান বাঙালির রসগোল্লা। নির্ভয়ে, রস বাড়বে। যার বড্ড অভাব আজকের দুনিয়ায়। রসিক বাঙালি। আছে আরও হাজারো রসের মিষ্টির সম্ভার। তাদের বৈচিত্র্যও নেহাত মন্দ নয়। রূপে গন্ধেও অনন্য। কিন্তু রসগোল্লাকে টেক্কা দেয় এমন সাধ্য কার? ভারী সুন্দর এক বিজ্ঞাপন দেখলাম। সিগারেট বিড়ি ওসব আজেবাজে জিনিস কেন খাবেন? খেতে হলে রসগোল্লা খান। মনে পড়ে গেল শিব্রাম চক্কোত্তির সেই কথা- নেশা করতে হলে রাবড়ির নেশা করাই ভালো। বাংলার রসের ভান্ডারে আছে আরও সহস্র আইটেম। একেকজন আবার তাতে মোক্ষলাভও করেছেন। যেমন নকুর, ভীমনাগের সন্দেশ। দ্বারিকের দই। শ্রীহরির ল্যাংচা। আবার স্থানবিশেষেও মাহাত্ম্য আছে মিষ্টির। যেমন বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা। শক্তিগড়ের ল্যাংচা। চন্দননগরের জলভরা। আর তা যদি হয় সূর্য মোদকের, তবে তো কথাই নেই। রিষড়ার দাপুটে রসের কারবারী ফেলু মোদক। জীবনে অন্তত একবার এদের স্বাদ চেখে দেখুন। নইলে বাঙালী জীবনটাই বৃথা। এখন আবার নব্য সংযোজন অবাঙালির কাজুসন্দেশ, কেশরিয়া লাড্ডুর মতো 'অরসালো' মিষ্টি। তবে রসিকজনের জাতবিচারে, বাংলার মিষ্টির সম্ভারের মতো অবাঙালি মিষ্টির কৌলিন্য নেই। রসগোল্লা কার? তা নিয়ে যুদ্ধও বেঁধেছিল। সে প্রায় হাতাহাতি বাংলা, ওড়িশার। কি বলবো একে মিষ্টিযুদ্ধ নাকি রসালোরণ? রসগোল্লা নাকি তাদের! এমনটাই আবদার করে বসেছিল প্রতিবেশি ওড়িশা। কেন? ওই মিষ্টি নাকি গত সাতশো বছর ধরে তাদের ইষ্টদেবতার খাদ্য। দেবতার ভোগের এক বিশেষ উপকরণ। প্রবাদ, প্রভু জগন্নাথদেব রথযাত্রায় লক্ষ্মীদেবীকে সঙ্গে নেননি বলে দেবী অভিমান করেছিলেন। সখীর মান ভাঙাতে প্রভু, দেবী লক্ষ্মীকে রসগোল্লা খাওয়ান। তা বেশ। কিন্তু প্রথা অনুযায়ী দেবতার ভোগের রসগোল্লা তৈরির রেসিপি তো গুপ্ত থাকার কথা। তা মন্দির থেকে বাইরে এলো কিভাবে? ভুবনেশ্বরের সামনেই এক গ্রাম। নাম তার পহালা। সেখানে রোজ প্রচুর পরিমাণে দুধ নষ্ট হতো। ওই দুধের অপচয় রুখতেই মন্দিরের এক পুজারি গ্রামের লেকদের রসগোল্লা বানানোর কৌশল শিখিয়ে দেন। তবে ওই রসগোল্লার রং হতো বাদামি। কারণ গ্রামবাসীরা দুধে কড়া পাক দিত। এরপরেই রসগোল্লা পৌঁছে যায় কটকের সামনে সালেপুর গ্রামে। সেখানেই প্রথম তৈরি হয় আধুনিক কেতার ফর্সা ধবধবে তুলতুলে রসগোল্লা। সৌজন্যে বিকলানন্দ কর। এদিকে বাংলার দাবি, ওসব অবান্তর কথা। রীতিমত গবেষণা করে রসগোল্লা তৈরি করেছিলেন কলকাতার নবীনচন্দ্র দাশ। সালটা ছিল 1868। নবীনচন্দ্র জোড়াসাঁকোতে মিষ্টির দোকান খোলেন। কিন্তু তা টেকেনি। বছর দুয়েক পর, তিনি দোকান খোলেন বাগবাজারে। কিন্তু তাঁর মাথায় ঘুরত নতুন কোনও মিষ্টি বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার কথা। চেষ্টা চালাতে চালাতে একদিন এলো সেই শুভক্ষণ। নবীনচন্দ্র বানিয়ে ফেললেন তাঁর স্বপ্নের মিষ্টি- রসগোল্লা। রসের লড়াইয়ে জিতে গেল বাংলা। পরাজিত ওড়িশা। জিয়োগ্র্যাফিক্যাল ইনডিকেশনসের সীলমোহর দেগে দেওয়া হলো বাংলার রসগোল্লার তুলতুলে শরীরে। এই লড়াইয়ের উপরি পাওনা হলো, বাঙালির সাধের রসগোল্লার মহিমান্বিত হওয়া। আমরা জানতে পারলাম রসগোল্লার অ্যাপ্রোচ শুধু ধরাধামেই নয়, দেবদেবীরাও মজেছেন রসগোল্লাপ্রেমে। স্বর্গীয় রসগোল্লা। নবীনচন্দ্রের রসগোল্লার স্বাদ চেখে সেদিন ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন রসিকজনেরা। "তা এবার পেটেন্ট নিয়ে নাও এই মিষ্টির!" ঘনিষ্ঠজনরা পরামর্শও দিয়েছিলেন নবীনচন্দ্রকে। কিন্তু সে কথা কানেই তোলেননি তিনি। নবীনচন্দ্রের চোখে তখন অন্য স্বপ্ন। গোটা দেশের মানুষকে তিনি রসগোল্লা খাওয়াবেন। কিন্তু কিভাবে? কলকাতাতেই থাকতেন এক অবাঙালি ব্যবসায়ী, ভগবানদাস বাগলা। কাজের প্রয়োজনে হামেশাই তাঁকে ছুটে বেড়াতে হতো এরাজ্য থেকে সেরাজ্য। আর প্রতিবারই যাওয়ার সময় তিনি নিয়ে যেতেন রসগোল্লা। এই ভগবানদাসের হাতঘুরেই রসগোল্লার স্বাদ পৌঁছে গেছিলো উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো সব ভিনরাজ্যে। আমি কলকাতার রসগোল্লা! শুধু যে বাংলাতেই রসগোল্লাকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছে এমনটা মোটেই নয়। বাংলার বাইরেও অনেকে গান রেকর্ড করেছেন রসগোল্লা নিয়ে। 'টপ টপ চুয়েলা রসগুল্লা'- ভোজপুরি এই গানতো রীতিমত হিট। সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে অবশেষে, রসগোল্লা পৌঁছে গেছিলো বিদেশেও। 1930 সাল নাগাদ কেসি দাশ রসগোল্লা রপ্তানি করতে শুরু করেন বিদেশের বাজারে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সাহেবদের দাপুটে শেফ উইলিয়াম হ্যারল্ড নিজের হেঁসেলে রসগোল্লা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক কেমন দাঁড়িয়েছিল জানা যায়নি। ব্রিটিশ রাজে বাংলার মিষ্টি খেয়ে মন মজেছিল গভর্নর জেনারেল লর্ড চার্লস ক্যানিং আর তাঁর স্ত্রীর। লেডি ক্যানিংয়ের সম্মানেই এক বিশেষ মিষ্টি তৈরি করেছিলেন কলকাতার ভীমনাগ। সেই মিষ্টির রসে মজে যান লেডি ক্যানিং। তাঁর নাম অনুসারেই ভীমনাগের সেই মিষ্টির নাম হয় 'লেডি ক্যানিং'। পরে বাঙালির মুখে-মুখে নাম দাঁড়ায় 'লেডিকেনি'। সাল-তারিখ বিচারে লেডিকেনি, রসগোল্লার বড়দি। বারো বছরের বড়। তবে লেডিকেনির জন্মস্থান নিয়ে দ্বিতীয় মতও আছে।
শোনা যায়, 1856 সালে লেডিকেনি তৈরি করেছিলেন বহরমপুরের ময়রারা। তবে শেষ পর্যন্ত, নবীনচন্দ্রের রসগোল্লার আভিজাত্য অর্জন করতে পারেনি ভীমনাগের লেডিকেনি। সবই তো হলো। কিন্তু বাংলার রসের সাগর কি রসগোল্লার স্বাদ পাননি? তাই কি আবার হয় নাকি! কবিগুরুর কথা বলছি। সে সময় রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করতেন স্বনামধন্য চিকিৎসক পশুপতি ভট্টাচার্য। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গেলেই, তিনি তাঁর মহামান্য রোগীর জন্য বাগবাজার থেকে রসগোল্লা নিয়ে যেতে ভুলতেন না। আজ বাঙালির পকেটে টান। খাওয়া-দাওয়ার শেষপাতে রোজ হয়তো আর রসগোল্লা জোটে না। তবু ওড়িশার সঙ্গে পাঞ্জা কষে বাঙালি ধরে রাখতে পেরেছে রসগোল্লার বাঙালিয়ানা। জিয়োগ্র্যাফিক্যাল ইনডিকেশনসের ট্যাগ আদায়ের ঘটনা স্মরনীয় করে রাখতে, গতবছর উদযাপন করা হলো প্রথম 'রসগোল্লা দিবস'। নভেম্বরের চোদ্দ তারিখ। কলকাতার নিউ টাউনের ইকো পার্কে বসেছিল রসগোল্লার সংসার। রসগোল্লাতেও এসেছে বৈচিত্র্য। যেমন নলেন গুড়ের রসগোল্লা। আবার চকলেট স্ট্রবেরির স্বাদও মিলেমিশে একাকার। কমলালেবুর মনমাতানো সুবাসে রসগোল্লা তখন কমলাভোগ। আম বরাবরই বাঙালির প্রিয় ফল। সেই আমের মিতালি হয়েছে রসগোল্লার সঙ্গে। তৈরি হয়েছে হালকা সবুজ রংয়ের ম্যাঙ্গো রসগোল্লা। মুখে দিলেই এক অন্য অনুভূতি। তবে রাজভোগ হোক অথবা কমলাভোগ, রসগোল্লা সবশেষে বাঙালিভোগ। পেটের ক্ষিধে মনের ক্ষিধে, দুই ক্ষুধাই মেটায়। সব মিলিয়ে বলতেই হয় 'জয়, রসগোল্লার জয়!'



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours