কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:
না। তারা হবো না।
কিছুতেই না।
বড্ড ভয় লাগে। কী একা ওই তারারা!
কেমন যেন একেকটা অতৃপ্ত আত্মা। পৃথিবীর দিকে তাকিয়েই থাকে নিমেষে। মিটিমিটি চোখে। কিছু যেন খুঁজে বেড়ায়। বিচ্ছিরী রকমের একা ওরা।
কত
সহস্র আলোকবর্ষ দূরে দূরে একেকজন। ছায়াপথ বেয়েও কোথাও পৌঁছনো যায় না। যখন
বসন্ত আসে গুমরে মরে তারারা। নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতার ভার যখন চেপে বসে, অসহ্য
হয়, খসে পড়ে তারা। নিঃশব্দে। হারিয়ে যায় চিরতরে।
মৃত্যু তারার।
শিল্পীকে মারে কে?
বিধাতা? ধুস, তাঁরও ক্ষমতা নেই।
আমার কল্পলোকেই তো বিধাতার সৃষ্টি। ছবিতে গানে গল্পে কবিতায় আমিই তো সেই সৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়েছি জগতমাঝে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।
আমি স্রষ্টা। তিনি সৃষ্টি। তিনি সুন্দর।
সুন্দরের
ব্যাখ্যাও একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে সুন্দর আর শিল্পীর সম্পর্ক
প্রজাপতি টগরের। শরীরের রাস্তা বেয়ে ওস্তাদ শিল্পী উঁকি মারে মনের গহীন
আঁধারে। 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো'য় অবগাহন শিল্পীর। তাই সোনাগাছির
বেশ্যার প্রেমেও অনায়াসে হাবুডুবু খায় শিল্পী।
তবে আলোতেই কিন্তু আবার চোখ জ্বালিয়ে দেয়।
শিল্পী যাকে ভালবাসে, তারমধ্যেই ঈশ্বরদর্শন করে।
তুই তো আমার প্রেম। বিধাতাও তুই। 'তুমহি মেরি মঞ্জিল, তুমহি মেরি পূজা।'
'তুমি বোঝ না। তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়!' আয়ুব বাচ্চুর সেই অসম্ভব সুন্দর আর্তনাদ।
ঘরছাড়া আমি। ডেকে নিলাম তোকেও। কতশত অস্বস্তি। সঙ্কোচের লক্ষণ রেখা পেরিয়ে সাড়া দিলি তুই।
'আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।'
নইলে
তো সেই আটটা ছটার কলমঘেঁষা। বাড়িফেরত রান্না করতে বসা। টিভিতে সোপ অপেরা
দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া সারা। শরীর আর টানে না। বুজে আসে চোখ। আবার সকালে
উঠেই কোনরকমে রুটি জেলি অমলেট খেয়ে, ট্রেন ধরতে ছোটা।
'তেরে সাথ হমভি সনম মশহুর হো গয়ে।'
অনেকেই
চিনে গেছিল আমাদের। আজ পাশে আমি আছি বলে কিছুই বুঝতে পারছিস না তুই। অফিস
কেটে গঙ্গার হাওয়া খেতে ছোটা। একটু আগে অফিস থেকে বেরোতে পারলে,
মাল্টিপ্লেক্সের আবছা আঁধারে গা-ঘেঁষাঘেঁষি। কনুই দিয়ে তোর বুক ছুঁয়ে
যাওয়া। যাই বল, নিষিদ্ধ আপেলে ছোঁয়ার মজাই আলাদা!
হোটেলে
খেয়ে বাড়ি ফেরা। রাত বেশি হয়ে গেলে পাড়ার মুখে ছেড়ে দিয়ে যেতাম তোকে। তোর
পাড়ার স্বঘোষিত পাহারাদাররা তোকে তো চিনতোই। আমায় দেখেও আর চেঁচামেচি জুড়ে
দিতো না। তোর ফ্ল্যাটে আর যাওয়া হলো না আমার। সিঙ্গল তুই। ফিসফাস হওয়ার ভয়।
ফ্ল্যাটের মালিক উঠে যাওয়ার কথা বললে বিপদ।
তবে অনেকেরই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। নন্দন, অ্যাকাডেমিতে কতজনেই তো চিনে গেছিল তোকেও।
আমাদের
মিলনেই জন্ম কত ছবির। তোকে ভেবেই লেখা কত কবিতা। কত গল্প। তারা গ্রহ
নক্ষত্র সবেতেই তুই। এরা সবাই তো তোর আমার প্রেমের ফসল। রাতের আকাশ আমি
দেখবো বলেই তারারা রোজ ফুটতো। তার স্নিগ্ধ আলো নিয়ে অপেক্ষা করতো চাঁদ।
চরাচর ভেসে যেত সেই মায়াবী আলোয়। সেই আলো গায়ে মেখে যেন আমার সামনে এসে
দাঁড়াতি তুই। রাতপরী। একপিঠ খোলা চুল। আমার সবকিছুতেই বারেবারে ঘুরেফিরে
আসতি তুই। আমাদের প্রেমের রঙেই সবুজ উপত্যকা। তুই না থাকলেও যা। আমি না
থাকলেও তা। অসম্পূর্ণ এক বৃত্ত। ব্যর্থ সব সুন্দরের সমাহার।
আমি
যতক্ষণ আছি, ততক্ষণই আমার কথা। সকালে নিখুঁত হাতে হকার ছুঁড়ে দেবে তোর
সেদিনকার আনন্দবাজার। যে সকালে আমি থাকবো না সে সকালেও ছুটবে ট্রেন। ব্যস্ত
শহরে কেউ খোঁজও করবে না আমার। কে কার অপেক্ষা করে বলতো? তুইও অফিস দৌড়বি।
রিক্সায় ওঠার সময়, রিক্সাওয়ালা হয়ত একবার তোকে জিজ্ঞেস করবে- 'আজ একাই যাবে
দিদি?'
অফিস থেকে ফিরে
সেই পুরনো রুটিনে ফিরে যাওয়া। না। আমি তারা হয়ে তখন তোর দিকে তাকিয়ে থাকবো
না। বাতাস হয়েও আদর করে যাবো না তোকে। আমি তো তখন বাতাসের ইথার তরঙ্গে।
নিজের ইচ্ছেয় ভাসার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। বাতাস যে দিকে ভাসায়, সে দিকেই
ভাসি।
বিছানায় উঠে একবার হোয়াপ খুলে দেখবি তুই, কোনও
মেসেজ পাঠিয়েছি কিনা। মেসেঞ্জারেও আমি নেই। আমার নামের পাশে সবুজ আলো চোখ
বুজে। না। ফেসবুকেও কোনও আপডেট নেই। আর কোথাও নেই আমি। সেই খসে পড়া তারার
মতো।
ততক্ষণে শরীর ছেড়ে দিয়েছে তোর। ক্লান্তি ভর করে তোর দু'চোখে।
ছুটির দিনে তুই একাই নন্দনে। অলস বিকেল।
- 'আজ একা যে?'
কী বলবি তুই চট করে বুঝে উঠতে পারিস না। তোর জবাবের অপেক্ষা না করেই আগন্তুক বলে- 'চলুন একটু চা খেয়ে আসি।'
এমনি
হঠাত করেই একদিন, নিজের পরিচয়েই বাঁচতে শিখে গেলি তুই। ঠিক এটাই চেয়েছিলাম
আমি। বন্ধ মন্দিরের দেবী না হয়ে, বাঁচ মানুষের মতো। তীব্র ভাবে বাঁচ।
সময়ের সাধ্য কী তোর গায়ে হাত তোলে! বাইরে বেরো। কিছু সৃষ্টি করো তুই।
দীক্ষা নে সৃষ্টিমন্ত্রে। জীবন থেকে তো কত কিছুই না নিলি। জল বাতাস আলো
আঁধার। কিছু তো ফেরত দিয়ে যা।
বেঁচে থাকতে আমিও যা, তুইও তাই।
একজন
সরে গেলেই বোঝা যায়, মনের কতটা জুড়ে ছিল অন্যজন। যে যায়, সে চলে যাওয়ার
জন্যই যায়। সাঁকো ভেঙে দিয়েই যায়। যাতে আর ফেরার রাস্তা না থাকে। কিছু
নিয়ে যায় না। সব পেছনে ফেলেই যায়। সেই পেছনে ফেলে যাওয়া কিছু লেখা, কিছু
আঁকাতে জড়িয়ে থাকে বিদায়ীর গায়ের গন্ধ। অস্তিত্ব।
ভরা
আকাশ থেকেও তারা হারিয়ে যায়। দেবদেবীর নিরঞ্জন। হয় গঙ্গাপ্রাপ্তি। আমি
চিরসবুজ তোর মনে। শহরের রাস্তার রেলিং, গঙ্গার পাড়, ময়দানের চওড়া বুকে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সেই আমি। বৈশাখের দুপুর। গাছের ছায়ায় মিলেমিশে আমার কায়া।
আমি
তখন শ্যাওলা। দিঘির পাড় ছুঁয়ে। জানিস, আজ আর আমি একা নই। জল আমায় বুকে ধরে
রেখেছে। পুঁচকে পুঁচকে মাছেরা সময় নেই অসময় নেই আমায় ঠুকরে দিয়ে যায়। খেলা
করে। রায় ননদিনী আলতো হাতে আমায় ভাসিয়ে দেয়। বুকের কাপড় সরিয়ে জলে ডুব
মারে। ভাসতে-ভাসতে আড়চোখে সব দেখি আমি। কখনও আবার ছুঁয়েও যাই।
'মরণ!'
কপট রাগ দেখায় ননদিনী। ভরা শরীরে যেন বান ডেকেছে। আক্ষেপ একটাই। আজও
সৃষ্টিসুখ পেলো না। গর্ভধারণ করতে পারলো না যুবতী রায় ননদিনী।
অপেক্ষা আষাড়ের।
একদিন
দিঘির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে বর্ষা। আনন্দে লাফিয়ে উঠবে দিঘির জল। ভেসে যাবে
পাড়ের সিঁড়ি। স্নানের বাঁধানো ঘাট। দিশেহারা প্রেমের উপচে পড়া রোমান্স।
মহামিলন।
সেদিন তোর কথা মনে পড়বে। বৃষ্টিতে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হবে আমার মনটাও।
'ভুলিয়ো স্মৃতি মম
নিশীথ স্বপনসম!'
এরকমই
কোনও এক দুর্যোগের রাত। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে শহর ডুবে আছে
অন্ধকারে। ভাসছে জলে। আনমনা তুই। ফেসবুকের পাতায় আচমকাই ভেসে উঠলো আমার
কোনও এক ছবি। আবার লেখাও হতে পারে। মনে পড়ে যাবো আমি। পুনর্জন্ম হবে আমার,
তোর সেই রাত আবেগে। সারারাত কাটবে আমার, তোরই আশ্রয়ে।
শ্যাওলা
হয়ে বাঁচবো। তবু তারা হয়ে বাঁচবো না। ভীষন ভয় লাগে যে একা বাঁচতে। আর কিছু
না হলে, তোর মধ্যেই বাঁচবো। লজ্জার প্যারাসাইটের মতো। তবু বাঁচবো।
মরেও বেঁচে থাকবো আমি।
ভীষন ভালোবাসি যে বেঁচে থাকতে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours