কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:
'যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে...'
'তবু মনে রেখ'র দিন শেষ, গুরুদেব।
এখন, খেল খতম পয়সা হজম।
আর এই হজমে সেরা কিন্তু মেয়েরাই। আমার না, এমনটাই মত গবেষকদের।
বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আছে বৈকি।
সেই
নীল যন্ত্রণার ছোবলে জেরবার হয়ে যায় পুরুষ মহিলা দু'জনেই। তবে কষ্ট ভোগ
করে মেয়েরাই বেশি। গোটা আকাশটাই যেন সহসা ভেঙে পড়ে তাদের মাথায়। মেঘের তলায়
ছটফট। নীল যন্ত্রণায় ফ্যাকাশে দুচোখ। কিছুক্ষণ। আরও কিছুক্ষণ।
ব্যাস, তারপরেই ফর্সা।
হ্যাঁ। চমকে দেওয়ার মতোই ব্যাপার। কিন্তু বাস্তব এটাই। আবার অপ্রিয় সত্যও বলতে পারেন।
তখন মেঘের লেশমাত্র থাকে না। বিরহিণীর চোখের তারা ফের জ্বলে ওঠে চকচকে আশার আলোয়। 'আলোকেরই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও।'
ধুয়ে মুছে সাফ 'পুরাতন প্রেম'। অদূর অতীত। আরও একবার, নবীনবরণের জন্য সেজেগুজে প্রস্তুত মন।
'স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ আলোকে এসো/ মুগ্ধ এ চোখে!'
মোদ্দা কথা, মাত্র ক্ষণিকের অবসর। ব্রেক আপের যন্ত্রণা গায়েব। বিরহবেদনার রাহুমুক্তিও চটপট।
খেল খতম পয়সা হজম।
মেয়েরা
এ ব্যাপারটিতে সিদ্ধহস্ত। এমনটাই মত গবেষক ক্রেগ মরিসের। তবে এর ঠিক উল্টো
সুর আরেক গবেষক ক্রিস্টাল কাউডারের গলায়। বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় মেয়েরা না,
ভেতরটা বেশি দুমড়ে-মুচড়ে যায় ছেলেদেরই। তবে তা দেখে বোঝা যায় না। কারণ
পুরুষের গোঁয়ার্তুমি। তাদের বাইরেটা দেখে বোঝা যায় না, ভেতরে কী চলছে। এক
অনন্ত যন্ত্রণায় ভোগে পুরুষ। গোপনে গোপনে।
ছেলেদের
হজমে বড্ড গড়বড়। দুর্বল হজমশক্তি। মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি ক্যাবলা।
গার্লফ্রেন্ড কেটে পড়লেই হলো! বিচ্ছেদ যন্ত্রণা হজম করতে গিয়েই মুশকিল
বাঁধায়। যন্ত্রণার চোয়াঢেকুরে খেপে লাল। কখনও নিজের চুল ছেঁড়ে তো কখনও এক
ঘুষিতে ভেঙে চুরমার করে দেয় কাচের জানলা। পাগলের মতো বাইক ছোটায়। নেশা-ভাং
করে একেবারে কলির দেবদাস।
যন্ত্রণা দেয় নিজেকে। সেই
ছোটবেলা থেকেই তার রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষসিংহ- এর কনসেপশন।
দায়িত্ব বওয়ার জন্যই পুরুষের চওড়া কাঁধ, বিধাতার দান। জন্মাবধি এসব ডোজ
খাওয়ার ফলে, ব্রেক আপের গোটা দায়টাই সে তুলে নেয় নিজের কাঁধে। নিজেকেই
ভিলেন ঠাওড়ে বসে পুরুষ। অনেক সময় তা নিজের অজান্তেও।
আবার
খিস্তি মারতে থাকে প্রাক্তনিকেও। তবু মনের জ্বালা জুড়ায় না। কিছুতেই নেভে
না বুকের আগুন। কখনও দাউদাউ, কখনও ধিকিধিকি। ফোসকা পড়ে হৃদয়ের গায়ে।
স্বেচ্ছা অপরাধবোধে নির্বাসিত, অসহ্য যন্ত্রণার জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পেতে
এমনকি আত্মহননের রাস্তাতেও হাঁটতে পারে সেই ব্যর্থ প্রেমিক।
আর
যদি প্রাণে বেঁচেও যায়, তখনও প্রাক্তনি ঘাপটি মেরে বসে থাকে মনের গোপন
অলিন্দে। এমনকি নতুন প্রেমে পড়লেও, অতীতকে চট করে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। আর
ওখানেই পোঁতা হয়ে যায় পরের ব্রেক আপের বিজ। বাস্তবে অকম্মার ধারী। পুরনো
সম্পর্কের আবেগ থেকে কখনও, পুরোপুরী বেরিয়ে আসতে পারে না পুরুষ প্রজাতি।
লন্ডনের
বিংহামটন ইউনিভার্সিটির সমীক্ষা এরকমটাই বলছে। ব্রেক আপের যন্ত্রণায় ভোগে
বেশি মেয়েরা। কিন্তু তারা চট করে পুরনো সম্পর্কের খোলস ছেড়ে বেরিয়েও আসে।
ছেলেদের হাল গোবর গণেশ। সম্পর্কের ডোর কেটে গেলেও হাল হয় কলুর বলদের মতো।
আপনমনে গোল-গোল চক্কর মেরেই চলে। ছুটে পালাতে পারে না। আজীবন বয়ে বেড়ায়
প্রাক্তনির স্মৃতি।
'ভরা থাক স্মৃতিসুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি।' কথাটা কি তাহলে শুধু পুরুষের বেলাতেই খাটে?
ব্রেক আপের পরে ঠিক কী হয়?
কোন খাতে বয় জল?
মেয়েরা
'কুল কুল'। রাগলেও খেপে না। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসে। কেন এমনটা হলো! কথা
বলে সখীদের সঙ্গে। পুরো প্রেমপর্বের ময়নাতদন্ত থেকে নিয়ে ভিসেরা রিপোর্ট
পর্যন্ত খতিয়ে দেখা হয়। নিজেদের জড়িয়ে ফেলে নানা কাজে। নিজেকেই নিজে পাহারা
দেয়। যাতে ভুল করেও কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়। তবে ব্রেক আপের দায়ে, কোনও
অবস্থাতেই নিজেকে কাঠগড়ায় তোলে না মেয়েরা।
শুরু হয় অপেক্ষা, প্রেমের নতুন পর্বের।
'প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে!'
'ব্যর্থ
প্রেমের খেসারত মেয়েরাই দেয় বেশি,' বলেন বিংহামটন ইউনিভার্সিটির গবেষক
ক্রেগ মরিস। 'মাত্র একবারের যৌনমিলনেই গর্ভসঞ্চার হতে পারে প্রেমিকার। এরপর
ন'মাস সেই প্রেমের ফসল বয়ে বেড়ানো। প্রেমিক কিন্তু যৌনতৃপ্তির মজা নিয়েই
খালাস। ব্রেক আপ হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই।' স্বাভাবিকভাবেই প্রেমের
ব্যাপারে বেশি সিরিয়াস মেয়েরাই। তাই কিছুদিন প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পরেও,
পার্টনার পছন্দ না হলে তাকে ছেড়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না।
কিন্তু
মুড়ি-মুড়কির মতো কনট্রাসেপটিভ পিল, কন্ডোমের যুগে গর্ভসঞ্চারের আশঙ্কা
মেয়েদের ঠিক কতটা ভোগায় সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। বরং যৌনতার ব্যাপারে
মেয়েরাও এখন বেশ খোলামেলা, বেপরোয়াও।
প্রেমে
যেমন মানসিক, শারীরিক দুটো দিকই জড়িয়ে আছে, বিচ্ছেদেও তেমনি। বিচ্ছেদ
যন্ত্রণার বিশ্লেষণ করতে এই যন্ত্রণাকেও দুভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন বিংহামটন
ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণা। গবেষণায় গুরুত্ব
দেওয়া হয়েছিল স্থান কাল পাত্রকেও। তাই আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল মোট
ছিয়ানব্বইটি দেশের পাঁচ হাজার সাতশো পাঁচজন মহিলা পুরুষকে। যন্ত্রণার
মাপকাঠি ধরা হয়েছিল এক থেকে দশ অঙ্ক। সমীক্ষায় দেখা যায়, ব্রেক আপের পর
মেয়েরা মানসিক উদ্বেগে ভোগে 6.84 অঙ্ক। সেখানে ছেলেরা ভোগে খানিকটা কম,
6.58 অঙ্ক। আবার শারীরিক কষ্টের শিকার হয় মেয়েরা 4.21, ছেলেরা 3.75।
'বুক যে ফেটে যায় হায় হায় রে।'
যন্ত্রণার
স্কেলে পরিষ্কার, মেয়েরাই কষ্ট পায় বেশি। কিন্তু সেই কষ্ট ঝেড়ে ফেলতেও
তাদের জুড়ি নেই। তখন আর ওসব আবেগ-টাবেগ পাত্তাই পায় না।
পুরুষের বেলায় এই যন্ত্রণা কম কেন?
তাহলে
কী প্রেমে পুরুষের আনুগত্য কম? আবেগ, অনুভূতিও ভোঁতা। নাকি সেই পুরোন
বদনামটাই সত্যি, শধুই নারীশরীরের লোভে প্রেমের খেলা খেলে পুরুষ?
এ
ব্যাপারেও স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে গবেষণায়। সেই আদিকাল থেকেই লিঙ্গবৈষম্য
তৈরি করেছে সমাজ। পুরুষ মানেই কঠোর বাস্তববাদী। আবেগহীন। যে কোনও পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণের মূল দায় পুরুষের। কোনও অবস্থাতেই তাদের ভেঙে পড়া চলবে না।
চলবে না মনখারাপ করে বসে থাকাও। আর কান্নাকাটি করলে তো সেরেফ প্যাক মেরে
উড়িয়ে দেওয়া। ওসব মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার।
তাই
কলজে দিয়ে যতই রক্ত ঝড়ে ঝড়ুক। চোখ দিয়ে জল গড়ানো চলবে না। পৌরুষের মানহানি
হবে যে! বুক ফাটলেও মুখ ফোটায় মানা। মনের কথা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ারের অপশন
নেই। সেখানেও কেউ যদি হাসি- মশকরা করে! তাই নিজের বুদ্ধিতেই চলা। চোখে
আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভুল ভুলই থেকে যায়। জীবনে ফের প্রেম
এলেও ভুলের মাশুল দিতে, আরও একবার ব্রেক আপের মুখোমুখী হতে হলেও আশ্চর্যের
কিছু নেই।
'কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ মায়াবনবিহারিণী হরিণী!'
কষ্ট
যন্ত্রণা সব গিলে ফেলো। হজম না হলে তার ঝাঁজ বেরোলেও বেরোতে পারে! আর সেই
ঝাঁজে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরো। বোতলবন্দি আবেগের ঢাকনা আরও কষে দাও, হে
পুরুষপুঙ্গব।
সকালে চোখ কচলাতে কচলাতে চশমাটা চড়িয়ে নাও। আর অপেক্ষা কর, ফেসবুকে তোমার প্রাক্তনী কখন নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে স্টেটাস আপডেট মারছে!
কপালে থাকলে একদিন ড্যাবডেবে চোখ মেলে দেখতে পাবে, নতুন প্রেমিকের গায়ে গা লাগিয়ে প্রিন্সেপ বা বাবু ঘাটে কেমন গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছে!
'হঠাত দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামেনা যে-
ভোলার তলে তলে ছিল অশ্রুজলের খেলা।।'
Post A Comment:
0 comments so far,add yours