fiture
মুজতবা আল মামুন, সাংবাদিক, কলকাতা : প্রাণে মারার হুমকি উপেক্ষা করে, অপর্ণা সেনদের পাশে এসে দাঁড়ালেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকশো বিশিষ্টজন। সমর্থন জানিয়ে তাঁরা বলেছেন,  আপনারা মাত্র ৪৯ জন নন। আমরাও আপনাদের সঙ্গে আছি। চলুন,  প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হই।  

দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু হত্যা চলছে। কোথাও বিশেষ শ্লোগান বলতে বাধ্য করা,  কোথাও গরু পাচারের মিথ্যে অভিযোগে  গণপ্রহার করা হচ্ছে। মেরে ফেলাও হচ্ছে। এর সঙ্গে চলছে দলিত হত্যাও। এর প্রতিবাদ জানিয়ে অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেনের নেতৃত্বে  সংবেদী উনপঞ্চাশজন  নামি-দামি মানুষ প্রধানমন্ত্রী মোদিকে কড়া চিঠি লেখেন। তাতে ক্ষেপে গেছে বিজেপি সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলগুলো। তাদের পক্ষ থেকে বিহারের মুজাফ্ফরপুর আদালতে মামলা ঠোঁকা হয়েছে। এমনকী অভিনেত্রী কঙ্গনা  রানাউতকে দিয়ে একষট্টিজনের একটা চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো হয়েছে, অপর্ণা সেনদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে। 

হুমকি ও মামলাতে একটুও বিচলিত নন দেশের মানবতাবাদী বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারার উল্লেখ করে বলছেন,  কাউকে সরকারের বিরোধিতা করার জন্য দেশবিরোধী বা আরবান নকশাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না । শাসক দলের সমালোচনা করার অর্থ দেশের সমালোচনা  নয়। শাসক দল ও দেশ এক নয়।  সমার্থক তো নয়ই। ফলে সরকারবিরোধী অবস্থানকে দেশবিরোধী অবস্থান হিসেবে পরিগণিত করা যায় না। তাঁরা পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছেন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর খতিয়ান মোতাবেক ২০১৬ সালে দলিতদের উপরে কমপক্ষে ৮৪০টি অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে। ফ্যাক্টচেকার.ইন ডাটাবেসের তথ্য অনুযায়ী ১ জানুয়ারি, ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত  ২৯৭টি ধর্মীয় পরিচিতি ভিত্তিক ঘৃণা-অপরাধ (হেট ক্রাইম)  সংঘটিত হয়েছে, যেখানে অন্তত ১০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে ও ৭৩৮ জন আহত হয়েছে। ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্তরা মুসলমান (জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলমান হলেও), ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে  আক্রান্তরা খ্রিষ্টান (জনসংখ্যার ২ শতাংশ খ্রিষ্টান হলেও), ১৪ শতাংশ হিন্দু (জনসংখ্যার ৭৮ শতাংশ হিন্দু হলেও)।  ওই অপরাধগুলির ৯৩ শতাংশ মে, ২০১৪র পরে ঘটেছে।২০১৩-র পর থেকে প্রতি বছরে অনুরূপ ঘটনা বেড়ে চলেছে। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯-এর জুলাই পর্যন্ত ধর্মের ভিত্তিতে অপরাধের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯, ১৮, ৩০, ৪২, ৭৩, ৯২ ও ১৯। অন্তত ২৭ শতাংশ  ক্ষেত্রে গোরক্ষার নামে, ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ভিনধর্মে সম্পর্করোধের জন্য আক্রমণ করা হয়েছে। কমপক্ষে ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা ছিল হিন্দু, ১২ শতাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান।

এরকম একটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাতাবরণের প্রেক্ষিতে অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগাল অনুরাগ কাশ্যপ, আশীষ নন্দী, কৌশিক সেন, বিনায়ক সেন, জয়া মিত্র, ড: দেবল সেন, জয়া মিত্র, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে চিঠি লিখে মুসলমান, দলিত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দানবিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে হত্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিটিয়ে হত্যা বন্ধ করার জন্য যথাবিহিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন যে, একটি বিশেষ শ্লোগানকে  একটি যুদ্ধ ধ্বনিতে পরিণত করা হচ্ছে ও বহু পিটুনিই ওই ধ্বনি তুলে করা হচ্ছে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের কাছে রামের নাম পবিত্র ও দেশের মুখ্য প্রশাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা অনুরোধ করেন যে, এই ভাবে রামের নামকে অপবিত্র করার দুষ্কর্মকে বন্ধ করতে সচেষ্ট হতে।  তাঁরা সমস্ত পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্তদের জামিন অযোগ্য অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন।  

দেশজোড়া অসহিষ্ণুতাবিরোধী এই চিঠিকে বিরোধিতা করে সরকারি চাটুকার ও সুবিধাভোগী বা প্রসাদাকাঙ্খিরা সাম্প্রতিক কালে নির্বাচন পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গে দলিত সমেত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণের ঘটনাকে হয় এড়িয়ে যান।  নয় সমর্থন করেন। ধর্মভিত্তিক হেট ক্রাইমের ঘটনার বাড়বাড়ন্তকে তারা অস্বীকার করে ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তির বক্তব্যকে মিথ্যা বলতে কোন লজ্জা তাদের হয় না।   মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিকে তারা গুরুত্বহীন বলে মনে করে।  তাদের লেখা চিঠিকে দেশের বিরুদ্ধে জাতিকে অবমাননা করার চক্রান্ত হিসেবে ঘোষণা করে। 

অপর্ণা সেনদের  বিরোধিতা করে শাসকের তাঁবেদারদের চিঠিটিই একটি চক্রান্ত, ধর্মের ভিত্তিতে হেট ক্রাইমকে স্বাভাবিক হিসেবে মান্যতা দেওয়ার চক্রান্ত বলে মনে করেন অপর্ণাদের সমর্থনকারী বিশিষ্টজনদের। 

৪৯ জনের ওই চিঠির প্রেক্ষিতে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়েছে, বিহারের মজফফরপুর আদালতে।  তাতে সম্মানহানি, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে । 

 দেশের মানবতাবাদী সর্বজনশ্রদ্ধেয় এইসব ব্যক্তিত্বরা দৃঢ়চিত্তে বলেছেন,  অপর্ণা সেনরা যদি দেশের সম্মানহানি করার জন্য অভিযুক্ত হন, আমরাও তাদের সাথী, আমরাও দেশদ্রোহী। আমাদের নামেও মামলা করুন। দরকারে গ্রেফতার করুন। কিন্তু থামান এই পরিকল্পিত সংখ্যালঘু ও দলিত হত্যা। এতে বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা হচ্ছে। মানবতাও কলঙ্কিত হচ্ছে। ধ্বংস হতে চলেছে ভারতে গর্বের বহুত্ববাদ। 
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours