fiture
স্বরূপ গুপ্ত, লেখক, কোচবিহার: পর্যটন শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গে প্রতি বছর বাড়ছে টুরিস্টের সংখ্যা। টুরিস্টদের পছন্দের তালিকায় দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ইত্যাদি রয়েছে একেবারে প্রথম সারিতে। জলদাপাড়া, লাটাগুড়ি, চিলাপাতা, চাপরামারি, বক্সা, জয়ন্তী ইত্যাদিও পিছিয়ে নেই। আজকাল প্রায় সারা বছর এসব জায়গায় টুরিস্টেরা ভীড় করছে। জুনের ১৫ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৫ পর্যন্ত বর্ষা ও বন্যপ্রাণীদের মিলনের সময় হওয়ার জন্য জঙ্গলে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও লোকজনের বেড়াতে আসার খামতি নেই। ভরা বর্ষাতেও তাই দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গের পথেঘাটে টুরিস্টদের ভীড় চোখে পড়ে আজকাল। টুরিস্টদের এই ভীড় উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। শিল্পহীন উত্তরবঙ্গে পর্যটনের এই প্রসার বহু লোককে কর্মসংস্থান যোগাচ্ছে। পর্যটনকে ঘিরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছে। ফলে বেড়েছে হোটেল থেকে শুরু করে হোম স্টে-এর সংখ্যা, বেড়েছে যাতায়াতের জন্য গাড়ির সংখ্যাও। নিত্য নতুন নানা জায়গা আবিষ্কার হয়ে চলেছে। টুরিস্টরা পৌঁছে যাচ্ছেন এমন সব জায়গায় যা আগে কোনোদিনই ভাবা সম্ভব ছিল না। আর এখানেই কিছু প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। উৎসাহ অতি-উৎসাহে পরিণত হয়ে আখেরে খারাপ হচ্ছে না তো? প্রশ্নটা আসছে সঙ্গত কারণেই। একটু দেখে যাক। প্রথমেই ধরা যাক দার্জিলিঙের কথা।
গত শতকের সত্তর-আশির দশকের দার্জিলিঙকেও যারা চিনতেন তারা কিন্তু আজকের দার্জিলিঙের সঙ্গে তার কোনো মিল পান না। দার্জিলিঙে হু হু করে বেড়ে চলেছে বাড়িঘরের সংখ্যা। এর মধ্যে হোটেলের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। সমতল থেকে ক্রমাগত গাড়ি ছুটছে দার্জিলিঙের দিকে। ফলে যানজটে সৃষ্টি হচ্ছে এক ভয়াবহ অবস্থা। ভুক্তভোগী মাত্র জানেন যে, কী নিদারুণ হতে পারে সে দশা! এর ওপর রয়েছে জলের সমস্যা। দিনের পর দিন টুরিস্টের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আজকাল মিরিক পথে সীমানা, শুকিয়াপোখরি, লেপচাজগত, ঘুম ইত্যাদি সর্বত্র হোম স্টে'র ছড়াছড়ি। এককালের শুনশান নির্জন রাস্তার সেই পথ আজ কেবল স্বপ্ন। একের পর এক গাড়ির আওয়াজ, হর্ণ, চিৎকার ও অতি উৎসাহে অদ্ভুত কিছু করবার তাগিদ পাহাড়ের নির্জনতাকে একেবারেই বিনষ্ট করে দিয়েছে। ভোরের টাইগার হিল বা সকালের বাতাসিয়া লুপ দেখলে যে কেউ মেলা বসেছে ভেবে ভুল করবে। ওদিকে লেবং অবধি বাড়িঘর প্রায় ঠেকে গেছে। সন্ধ্যার ম্যালে বসবার ফাঁকা জায়গা মেলে না। কেভেনটারস বা গ্লেনারিজেও ভিড় গিজগিজ করছে। অনেকটা একই চিত্র লাটাগুড়িতে। বিখ্যাত এই অরণ্যকে ঘিরে এখন 'এক সে বড় কর এক' হোম স্টে'র ছড়াছড়ি। মজার কথা হল যে, সেগুলি খালি পাওয়া দুষ্কর, বরং বুকিং করতে হয় বহু আগে থেকে। পিছিয়ে নেই জলদাপাড়া, জয়ন্তী বা চিলাপাতাও। অত্যাধিক টুরিস্ট সমাগমে অনেক সময় হোম স্টে-গুলি প্রতিশ্রুত সেবা দিতে না পারায় বিবাদও বাঁধে এবং কখনও তা এতটাই উচ্চকিত যে, অরণ্যের শান্তি বলে কিছু আর থাকে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু টুরিস্টের অতি আগ্রহ। এর ফলে তারা যেমন বন্যপ্রাণকে বিরক্ত করছে, তেমনি প্রকরান্তরে নিজেদের বিপদও ডেকে আনছে। আসলে জঙ্গলের একটি নিজস্ব নিয়ম আছে। সে নিয়মকে না জানলে বা না বুঝলে যা হওয়ার তাই-ই হচ্ছে। টুরিস্টদের এক শ্রেণীর মধ্যে সচেতনতার অভাব আবার অন্য বিপদের সৃষ্টি করছে। জঙ্গল বা পাহাড়ের মতো জায়গায় প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার একেবারেই উচিত না। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বন্যপ্রাণেরাও বিপদগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু আজ, পাহাড় তো বটেই, ডুয়ার্সের সবুজ অরণ্য এই দূষণের শিকার হচ্ছে নিত্যদিন। ভাবতে অবাক লাগে যে, এসবের জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো দূরের ব্যাপার, সামান্য সাবধান করার ব্যাপারটিও নেই। তাই জল খেয়ে প্লাস্টিক বোতলটিকে জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলার কাজটি করতে স্থানীয় বা বহিরাগত সকলেই একরকম। কারো কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। বারংবার নিষেধাজ্ঞাও এক শ্রেণীর চালককে গাড়ির হর্ণ অযথা বাজানো থেকে বিরত করতে পারে নি। আবার জঙ্গল বা পাহাড় ঘেঁষা পিকনিক স্পটে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে প্রকৃতিকে ধর্ষণ করতে দেখা যায় প্রায় সর্বস্তরের লোককে। এই শব্দ দূষণ তে অত্যন্ত ক্ষতিকারক তা বুঝবার বোধটুকুও লোপ পেয়েছে বলে মনে হয়। 
এই ব্যাপারে পিকনিক করতে আসা লোকজন যেমন দায়ী, তেমনি এই পিকনিক স্পটগুলির দায়িত্বে যারা আছেন তারাও সমান দায়ী। সাধারণত, কোনো নদী বা ঝোরার পাশে এই জায়গাগুলি বেছে নেওয়া হয় পিকনিক করবার জন্য। পিকনিক শেষে বর্জ্য ফেলা হয় সেই নদী বা ঝোরাতেই। এই বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিক থাকায় নদী বা ঝোরাটিরও নাভিশ্বাস ওঠে। অদূর ভবিষ্যতে সেই প্রবাসটির কী দশা হতে পারে তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। পর্যটন প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তাই একান্ত দরকার সচেতনতা। এই সচেতনতা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বা বলে কয়ে আনা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন বোধের। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা একটা বোধহীন সমাজে বড় হচ্ছি আর আমাদের দশা হয়েছে কালিদাসেরই মতো...যে ডালে বসেছি সেই ডালটিকেই কাটছি। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours