কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:
"হে রাম!"
এত নাক সিঁটকানো কেন মশাই রামকে নিয়ে?
জাতির জনকের মুখ থেকে শেষবারের মতো যে ছোট্ট বাক্যবন্ধটি বেরিয়ে এসছিলো, তা ছিলো- হে রাম।
'জয় শ্রীরাম'! হুঙ্কার দিলো গৈরিক বাহিনী।
আসলে
প্রথমটা ছিল রামচন্দ্র। শেষ বিদায়ের সম্ভাষণ। ঠান্ডা, হিমশীতল এক অনুভূতির
সংক্রমণ। আর দ্বিতীয়টা রামচিমটি। তা রামচিমটিতে জ্বালা তো ধরবেই। আর সেই
জ্বালায় অস্থির রাহুল গাঁধি।
গত লোকসভা নির্বাচনে
বিজেপি'র রামধাক্কায় ভরাডুবি হলো কংগ্রেসের। আর তাতেই পায়ের তলার মাটি
কেঁপে উঠেছিলো রাহুলের। ইস্তফা দিয়ে বসেছিলেন দলের সভাপতি পদে।
পুরুষোত্তম
রাম। কিন্তু 'হে রাম' থেকে 'জয় শ্রীরাম'- এ পৌঁছতে সময় লেগে গেলো কয়েক
দশক। নয়াদিল্লির বিড়লা হাউস থেকে যুগপুরুষ রাম শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন
অযোধ্যায়। কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রাপথে 'রাম' এর মানেটা গেল পাল্টে। বিড়লা
হাউসের 'হে রাম' ছিলো এক অনুশোচনার প্রতীক। যা বেরিয়ে এসছিলো বুকফাটা
দীর্ঘশ্বাস হয়ে। আর অযোধ্যার 'জয় শ্রীরাম' এক নির্ভেজাল হুঙ্কার।
অযোধ্যার
রাম সঙ্কেত দিলেন এক দীর্ঘ মেয়াদী লড়াইয়ের। আজকের রাম যেন কুরুক্ষেত্রের।
'যুদ্ধং দেহী" রূপে দেখা দিলেন সঙ্ঘ পরিবারের কলির রাম। 'মরা মরা' আওড়াতে
আওড়াতে এক সময় দস্যু রত্নাকরের মুখ থেকে বেরিয়ে এসছিল- রাম রাম। দিন
পাল্টেছে। বদলেছে যুগ। সত্যযুগ থেকে কলি। বদলেছে রামনামের অনুরণন। রাজনীতির
রত্নাকরদের মুখেও এখন সততই রামনাম। ক্ষমতা লুটের অস্ত্র।
ব্যাপারটা যখন লড়াই, প্রতিদ্বন্দী তো থাকবেই। তাই একপক্ষ যখন জয় শ্রীরাম-এর স্বপক্ষে আরেক পক্ষ তখন বিপক্ষে।
প্রশ্ন একটাই, শেষটা হবে কী দিয়ে?
রামনামেই সিদ্ধিলাভ। উচ্চাশার ভান্ডার পূর্ণ করা। সেই পথেই একদা পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি।
অযোধ্যার
রামমন্দির। সোনার লঙ্কায় বন্দি ছিলেন সীতা। আর নিজের জন্মভূমি অযোধ্যাতে
তালাবন্দি হয়ে প্রিয়া সীতাকে নিয়ে বসেছিলেন খোদ রাম। রামসীতার যুগলমূর্তি।
অবশেষে মুক্তি রাজীব জমানায়। মহামান্য আদালতের আদেশে খোলা হয়েছিলো মন্দিরের
তালা। দিনটা ছিল 1986 সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি।
বন্দীদশার থেকে মুক্তিতো পেয়েছিলেন সস্ত্রীক রঘুকূল বীর। কিন্তু তিনি নিজেও হয়ত দেখে চমকে গেছিলেন, গোটা দেশটাই চলেছে 'রাম ভরোসায়'।
কিন্তু এ কেমনতরো দেশ?
না
রামরাজত্ব না সোনার লঙ্কা! সুশাসনের প্রতীক রামরাজ্য। এমনকি খোদ রাবণও
নিজের রাজ্যকে উন্নয়ন বিমুখ করেননি। লোকমুখে তার প্রচার হয়েছিল সোনার
লঙ্কা নামে।
তা রাম হোন কিম্বা রাবণ, স্বাধীনোত্তর সুজলাং সুফলাং দেশটার এই হতচ্ছারা হাল করলেনটা কে?
রাজধর্ম
পালনে কংগ্রেস কতটা পারদর্শী ছিল, আজ তা নিয়ে রাজনীতিবিদরা যতোই বিতর্কের
ঝড় তুলুন না কেন, মানুষের কাছে গোটা অধ্যায়টা জলবৎ তরলং। দেশের মাথায়
একচেটিয়া ছড়ি ঘুরিয়ে গেছে কংগ্রেস।
'জয় শ্রীরাম!'
হুঙ্কার
দিয়ে গৈরিক বাহিনী নেমে পড়েছে ধর্মযুদ্ধে। বিজেপি বিরোধীরা বলছেন, এ
যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধের নামে ক্ষমতা হাতানোর যুদ্ধ। রামবাহিনীর এই 'সর্বদলমেধ
যজ্ঞে' খেপে লাল কংগ্রেস। ক্রমেই আয়তনে বাড়ছে বিজেপি শিবির। সঙ্গে তাল
মিলিয়ে বাড়ছে ক্ষমতার ব্যাপকতাও। সেই সঙ্গে দেশে যেন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে,
এক দলীয় শাসনব্যবস্থা। মূল বিরোধী শিবিরের প্রতিপত্তি বাড়তে দেখে
স্বাভাবিকভাবেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে ভারতবর্ষের আদিশাসক দল কংগ্রেস।
কোণঠাসা হতে হতে আপাতত দলের পিঠ ঠেকেছে দেওয়ালে।
বিষে
বিষক্ষয়ের রাস্তা নিয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন(!) সভাপতি রাহুল গাঁধি।
কখনও নিজেকে ব্রাহ্মণ বংশজাত প্রতিপন্ন করে গলায় পৈতে ঝুলিয়েছিলেন। আবার
রামের মোকাবিলায় শরণ নিয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের। মাত্র কয়েকমাস আগে,
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মশিবিরকে রুখে রীতিমত চমকে দিয়েছিল
কংগ্রেস। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে ভক্ত রাহুলকে বিমুখ করলেন শিব।
কংগ্রেসের
সঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্কটা বরাবরই ননদ-বৌদির মতো। এই মুখ দেখাদেখি বন্ধ
তো এই গলায়-গলায়। তবে গত লোকসভা নির্বাচনী আসরে সেই পুরনো সম্পর্কের
রিনিউয়াল হওয়া ভেস্তে গেছিল। এই ভেস্তে যাওয়ার কারণগুলির ময়নাতদন্তের
দায়িত্ব ওই দুই শিবির, আর দেশের দাপুটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
তবে
একটা ব্যাপার সর্বজনবিদিত, ধম্ম-কম্মে একেবারেই বিশ্বাস নেই বামপন্থীদের।
মহাদেবে আস্থা নেই তাদের। আবার বিষ্ণুর নবম অবতার রামও তাদের কাছে অর্থহীন।
ওদিকে বামপন্থীদের চারণভূমি বাংলাতে, সেই কবেই বেসুরো গেয়ে বসে আছেন
দ্বিজেন্দ্রলাল- 'সাথে আছে ভগবান হবে জয়।'
কবিগুরু আবার পাক্কা ওস্তাদের দক্ষতায়, দুয়ের সমন্বয় করেছিলেন। 'শাসনে যতোই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও/ হও না যতোই বড় আছেন ভগবান।'
আবার
যেই না কানে এলো, 'বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান', খোঁচা খেয়ে
গেলেন বামপন্থীরা। বিধির বাঁধনটা আবার কী মশাই? কার্লমার্ক্স আছে, লেনিন
আছে, স্তালিন আছে। বিধিটা আছে কোথায়?
ব্যাস
আর যায় কোথায়? পত্রপাঠ কমরেডরা সীলমোহর দেগে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের
জোব্বায়- বুর্জোয়া কবি। এদিকে বাঙালি তখনও গেয়ে চলেছে কবিরবির গান।
'বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক হে ভগবান।'
দমবার
পাত্র নয় বামপন্থীরাও। তাঁরাও পাল্টা সুর ধরলেন- 'আমরা করবো জয়'। তবে
কবিগুরুর বেলায় বামপন্থীরা যে সাহস দেখিয়েছিলেন, বাপুজির বেলায় সেটা দেখাতে
পারেননি।
কেন? কারণ দেশবাসীর কাছে বাপুর
বিশ্বাসযোগ্যতা। সাবরমতি আশ্রমে তখন রামধুন। 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।' শ্রী
লক্ষণাচার্যের লেখা এই গান ছিল গাঁধিজির প্রিয়। সুর দিয়েছিলেন বিষ্ণু
দিগম্বর পালুসকার। দেশে রামরাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে বাপু তখন বিভোর।
বামপন্থীরা
নিজেদের হামেশাই বিজ্ঞানমনস্ক বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম
পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন, অসাধারণ এক বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। তিনি বললেন,
ভিলাই, রাউরকেল্লা, দুর্গাপুরের ইস্পাত কারখানাগুলিকেই আধুনিক ভারতের
মন্দির।
গাঁধি-নেহরুর মতের ফারাক ছিল অনেকটাই। তবে
জাতির জনককে চটিয়ে দেওয়ার সাহস পন্ডিতজিও রাখতেন না। আর তাতে ফায়দাই
হয়েছিল পন্ডিতজির। গাঁধিজিকে ঢাল করে কংগ্রেসের মাথায় চড়ে বসেছিলেন তিনি।
নেহরু পরিবারের সেই ধারা আজও অক্ষুন্ন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিল নেহরু
পরিবারে গাঁধি নাম ভাঙানোর।
একশো
চৌত্রিশ বছরের পুরনো দল কংগ্রেস। প্রবীণ, অভিজ্ঞ নেতার সংখ্যাও নেহাত কম
নয়। তবু দলের সভাপতি আসনের কথা উঠলেই, এক থেকে দশ নাম্বার পর্যন্ত নাম থাকে
ওই গাঁধি-নেহরু পরিবারের কোনও এক সদস্যের। যুক্তিহীন ওই আনুগত্যের সিঁড়ি
বেয়েই দলের সভাপতির কুর্শিতে চড়ে বসেছিলেন রাহুল গাঁধি। ভাগ্যবান রাহুল।
তাঁকে কোনও যোগ্যতার পরীক্ষায় বসতে হয়নি।
কথায়
আছে, সফলতার মুখ দেখা কঠিন। কিন্তু আরও কঠিন সফলতা ধরে রাখা। মাসকয়েক আগেই
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস যে সফলতার মুখ দেখেছিল, লোকসভায়
সেই সফলতা ধরে রাখতে মুখ থুবড়ে পড়লো দল। অগত্যা দলের ব্যাটন অন্যের হাতে
গছাতে চাইলেন রাহুল। স্পর্ধা হারিয়ে ফেললেন রামবাহিনীর মোকাবিলায়
সম্মুখসমরে যাওয়ার। লোকসভা নির্বাচনীপ্রচারে রাহুলকে ঠিক যতটা আক্রমণাত্মক
সেনাপতির ভূমিকায় দেখা গেছিল, নির্বাচন পরবর্তী অধ্যায়ে ঠিক ততটাই অসহায়
দেখা গেল। এমনকি একলাফে নেমে পড়লেন দলের সভাপতির কুর্শি থেকেও।
একটা
খুব চলতি কথা আছে, জাহাজ ডুবতে বসলে সবচেয়ে প্রথমে জাহাজ ছেড়ে পালায়
ইঁদুর। আর জাহাজের সলিল-সমাধি হওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি লড়াই চালিয়ে
যান, তিনি ক্যাপ্টেন। কংগ্রেস নামক জাহাজের ক্যাপ্টেন পদ থেকে সরে
দাঁড়িয়েছেন রাহুল।
তাহলে
ডুবতে বসা জাহাজের ক্যাপ্টেন হবেনটা কে? কংগ্রেসের সব নবীন, প্রবীণ নেতারাই
কি তাহলে দায়িত্ব বিমুখ? নাকি অভাব আত্মবিশ্বাসের। আবার মনের কোনে অন্য
কোনও ভয় থাকাটাও মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়- ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার ভয়।
মহাত্মা
গাঁধি আজ কালের গর্ভে গিয়েও, সমসাময়িক রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি।
ওদিকে কংগ্রেসের ওপর দারুণ প্রতাপশালী নেহরু পরিবারের আধিপত্য আজও একতরফা
স্বীকৃত। পরিবারতন্ত্রের এই ভারতীয় নমুনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন
আজকের কংগ্রেসীরাও। 1939 সালে কংগ্রেস অন্দরমহলের যে ছবিটা দেখা গেছিল তাও
ছিল একইরকম। গাঁধি-নেহরুর সঙ্গে মতের ফারাক হওয়ায় একদিন কংগ্রেস সভাপতি পদ
থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল নেতাজিকেও। বলাবাহুল্য, সেই ইতিহাস কারুরই অজানা
নয়। সুতরাং কংগ্রেস সভাপতির কুর্শিতে বসে কেই বা, আর কেনই বা নিজের
অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে আনবেন?
ওদিকে
রামফৌজের সঙ্গে লড়তে গিয়ে কংগ্রেসের কেউ নিজেকে রাবণ প্রতিপন্ন করতে চান
না। গাঁধি-নেহরু নামের ছাতার তলাতেই তাঁরা সাবলীল এবং অভ্যস্তও। এদিকে
রাহুল ইস্তফা দেওয়ার পর ইতিমধ্যেই কেটে গেছে প্রায় মাস দেড়েক। শূন্য পদ
পড়ে আছে কংগ্রেস সভাপতির। অতএব আপাতত পরিস্থিতি ঘোরালো। কংগ্রেসের ভবিষ্যত
সম্ভবত শিবেরও অজানা!
ওদিকে গৈরিক বাহিনীর জয় শ্রীরামের ধ্বনিতে অশ্বমেধ যজ্ঞ চলেছে দেশময়। আর রামচন্দ্র আপাতত বন্দি হয়ে বসে আছেন অযোধ্যার মন্দিরে।
রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তে পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে একটাই কথা বলা যায়- হায় রাম!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours